পিরিয়ড মানেই বেশ একটা ঢাকঢাক গুড়গুড় লুকোছাপার ব্যাপার। আপনার ওই সদ্য কৈশোরে পিরিয়ড জিনিসটা যে আদতে কি, সেটা নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে বসার পরপরই বিষয়টার প্রতি আপনার প্রথম যে অনুভূতিটা তৈরি হয়েছিল, সেটা যতটা না একটা নতুন জিনিসকে ভয় পাবার ছিল, তার থেকেও বেশী ছিল লজ্জার অনুভূতি। পিরিয়ড মানেই যে লজ্জার, সেটা যে খুল্লমখুল্লা চারপাশের লোককে জানানো যায় না, এমনকি বাবাকেও জানানোর বিষয় নয়—সেটা বুঝে নিতে কারুরই দেরী হবার কথা নয়, আপনারও হয়নি!
প্রথম পিরিয়ড মানেই অস্বস্তি, সেটা শরীরেও, মনেও। তারপর নিজেকে সেই নতুন পালটে যাওয়া পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া, বন্ধুদের ফিসফাস, হাসি, কৌতূহল—ছোটবেলায় প্রত্যেকটা মেয়েকেই কমবেশি এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। গার্লস স্কুল হলে তো ভালো, কিন্তু কো-এড স্কুল যদি হয়, তাহলে চিন্তার আর শেষ নেই! আপনারও, আপনার মায়েরও! মেয়ে বন্ধুরা জানলো, ঠিক আছে। কিন্তু যদি ছেলে বন্ধুরা জেনে ফেলে এই গোপন জিনিসটার কথা? ইসস! কি লজ্জা, কি লজ্জা! তার থেকে বরং মাসের ওই কটা দিন কামাই করাই ভালো!
আগে তো ‘আলাদা’ করে রাখা হতো!
কিন্তু ভেবে দেখুন তো, পিরিয়ড নিয়ে মেয়েদের মধ্যে আজও কেন এত লজ্জা? এত লুকোচুরি? আগেকার দিনে মা-ঠাকুমারা, এমনকি আপনি হয়তো আপনার মা-কাকিমাকেও পিরিয়ডকে একটা ‘খারাপ’, ‘নোংরা’, ‘অচ্ছ্যুৎ’ বিষয় বলে মনে করতে দেখেছেন। আগে তো পিরিয়ড হওয়া মানে ছিল রীতিমতো একটা ব্যাপার! শুনেছেন নিশ্চয়ই, মেয়েটিকে আলাদা ঘরে রাখা হতো, তার বাইরে বেরোনো মানা ছিল। ওই ঘরের মধ্যেই তাকে সব কাজকর্ম নাকি সারতে হতো!
ভেবে দেখুন, পিরিয়ড, যেটা কিনা একটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, বৈজ্ঞানিক ঘটনা, সেটাকে অস্বাভাবিক বড় করে দেখানোর কি বিপুল প্রচেষ্টা থাকত গোটা জিনিসটার মধ্যে! বাড়ির মধ্যে একটা মেয়েকে আলাদা করে রাখা হয়েছে, মানেই কিন্তু পিরিয়ডের বিষয়টা আর লুকোনো রইলো না। এও কিন্তু একভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে মেয়েটির পিরিয়ড হয়েছে, আর হয়েছে বলেই সে ওই ক’দিন সবার সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারবে না, মাসের অন্য কটা দিনের মতো।
এখন নাকি অন্য যুগ?
এখন সে যুগ আর নেই, মানছি। আপনাকে, আমাকে আমাদের মা-কাকিমারা যদি বলতেন ওই নির্দিষ্ট কটা দিনে বাড়ির একটা ঘরে আটকে থাকতে, আপনি ‘বিদ্রোহ’ করতেন, নিশ্চিত! কিন্তু ভেবে দেখুন, পিরিয়ডকে ঘিরে ট্যাবু কি আজও নেই? আজও কি আপনি, হ্যাঁ, আপনিই, একুশ শতকের আধুনিক, জিন্স-টপ পড়া, ফটাফট ইংরিজি বলা কেতাদুরস্ত আধুনিকা হয়েও, পিরিয়ড কি, কেন হয় ইত্যাদির বিজ্ঞানসম্মত কারণ জেনেও সেই গুচ্ছ ট্যাবুগুলোকে মেনে চলেন। কি? অবাক হলেন? প্রতিবাদ করে লাভ নেই। লিস্টি বলে দিতে পারি। আপনি মিলিয়ে নিন। তারপর নাহয় যুক্তি সাজাতে আসুন।
ঠাকুর ঠাকুর! তোমায় ছুঁতে যে মানা!
মাসের ওই কটা দিন—ঠাকুরঘরের থেকে আপনি দশ হাত দূরে। কি ঠিক বলছি তো? ওই যে ছোটবেলায় পিরিয়ডের প্রথম দিনগুলোতে বাড়ির বড়রা আপনাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন ওই ক’দিন মন্দিরে যেতে নেই, ঠাকুরের কাজ করতে নেই, এমনকি ওই দিনের মধ্যে যদি সরস্বতী পুজো পড়ে? তাও অঞ্জলি দিতে নেই! কি খারাপ ভাবুন তো! এক স্কুল মেয়ের মধ্যে আপনি একা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, চোখ ফেটে জল আসার যোগাড় হবে, সেও ভি আচ্ছা। কিন্তু অঞ্জলি দেওয়া যাবে না। কারণ তাহলে যে ঠাকুর পাপ দেবেন! ঠাকুর অবশ্য মেয়েদের জন্য এসব আজব নিয়ম কোন ধর্মগ্রন্থে বলেছেন জানি না।
তবে এটা জানি যে ওইসব ‘ধর্মগ্রন্থ’ বলে যেগুলোকে চিনি, যাতে নাকি ঈশ্বরের বাণী লেখা আছে, সেগুলো কোনোদিনই ঈশ্বর নিজের মুখে বলেন নি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধ্বজাধারী পণ্ডিতরা (পণ্ডিতরা অবিশ্যি বেশীরভাগ সময়েই পুরুষই হতেন, মেয়ে পণ্ডিতের কথা আর সেকালে কে শুনেছেন!) সেগুলো লিখে ঈশ্বরের বাণী বলে চালিয়ে এসেছেন। কার যে এতে লাভ সে কথা তো বোঝাই যায়! আর আমরাও দিব্যি এখনও সেসব মেনে চলেছি, এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদে আরও হাজার বছর ধরে মেনেও চলব। কারণ, হাজার হোক, ঐতিহ্য আর পরম্পরা বলে তো একটা ব্যাপার আছে নাকি? তাকে কেই বা কবে খুব সহজে বিসর্জন দিতে পেরেছে? আর তাই তো এখনও কেরলের শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী মেয়েদের ঢোকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়! কারণ ওই একই? একটা মেয়ের পিরিয়ড হওয়া মানেই ইসস কি খারাপ, নোংরা! ব্যাস, তাকে আলাদা করে দাও, দেগে দাও। খেল খতম!
আরও ট্যাবু?
এরকম অবশ্য আরও আছে। শুনতাম পিরিয়ডের ওই কটা দিন নাকি সাবান মাখা যাবে না, শ্যাম্পু করা যাবে না! মানে ‘নোংরা’র মধ্যে আপনাকে যতটা ‘নোংরা’ রাখা যায় আর কি, তারই বন্দোবস্ত! দৌড়োদৌড়ি করা যাবে না, টক খাওয়া যাবে না, তেঁতুল খাওয়া যাবে না। ফলে ফুচকাও, আমের আঁচারও ওই কটা দিন বাদ! ভাগ্যে শুধু জুলজুল করে ফুচকাওয়ালার দিকে চেয়ে থাকা! এরকম আরও হরেক আজব ট্যাবু তো ছিলই।
ট্যাবু তো আছে। লজ্জাও?
এখন মেয়েরা নাকি ‘আধুনিকা’! পিরিয়ডের তিন-চারটে দিন ঘরের মধ্যে না, ঘরের বাইরে তাকে বেরোতেই হয়। কিন্তু পিরিয়ড নিয়ে ট্যাবু আজও কাটেনি। পিরিয়ড তো একটা নর্মাল বিষয়। আপনার শরীরের হরমোনের কিছু পরিবর্তন ও অন্যান্য নানা কারণে হয়। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। আপনিও এটা মানেন, মাসের ওই কটা দিন ঠাকুরঘরে যেতে আপনার বাঁধো বাঁধো হয় ঠিকই, কিন্তু এর বাইরে বাকি কিছুই আপনি মানেন না। দিব্যি টকজলও ফুচকাওয়ালার থেকে চেয়ে চেয়ে খান, দৌড়ে বাসেও ওঠেন, হরবখত শ্যাম্পুও করেন।
পিরিয়ড নিয়ে আপনার নাকি আপনার মায়ের মতো ট্যাবুই নেই! তাই যদি হয়, তাহলে বলুন দেখি, কেন বয়ফ্রেন্ড আপনাকে ডেটে যাবার প্ল্যান বললে আপনাকে অন্য কাজের অজুহাত দিতে হয়? কেন আপনি আজও, এই একুশ শতকেও তাকে সরাসরি বলতে পারেন না যে আপনার পিরিয়ড হয়েছে? বিষয়টা আর কিছুই না! পিরিয়ডকে নিয়ে সেই যে লজ্জা, লুকোচুরির ব্যাপার ছোট থেকেই আপনার মধ্যে আছে, ওটার ফাঁদ থেকে বেরোনো সম্ভব নয় এত তাড়াতাড়ি, তা সে আপনি যতই আধুনিকা হন না কেন! আর বয়ফ্রেন্ডকে বলে দেখুনই না যে আপনার পিরিয়ড হয়েছে, তার এত কৌতূহল, আর হাজারো প্রশ্ন থাকবে এই ‘স্বাভাবিক’ বিষয়টাকে ঘিরে, যে আপনারই মনে হবে শেষে যে কেন বললাম!
আসলে স্বাভাবিক জিনিসকে স্বাভাবিকভাবে দেখার শিক্ষা তো সমাজে আমাদের ছোট থেকে দেওয়া হয় না। তাই টি.ভি.তে স্যানিটারি ন্যাপকিনের অ্যাড দেখলে আমরা অন্য চ্যানেল করে দিই। বাচ্ছারা প্রশ্ন করলে বলি, এসব বড় হয়ে জানবে! আর এই গোপনীয়তা, ঢাক ঢাক গুড়গুড় ব্যাপারটাই তাই পিরিয়ড জিনিসটাকে আমাদের স্বাভাবিকভাবে নিতে শেখায় নি, সেটা ছেলেদের ক্ষেত্রেই হোক, কি মেয়েদের ক্ষেত্রে! একটু সুস্থভাবে, খোলাভাবে বিষয়টাকে দেখুন, অন্যদেরও দেখতে শেখান। দেখবেন সময় হয়তো লাগবে, কারণ অভ্যেস বদলাতে সময় লাগে। কিন্তু পিরিয়ডের ট্যাবু মুক্ত সমাজ গড়ে উঠছেই!
মন্তব্য করুন