কথায় বলে শরীর হলো পরম ধন আর স্বাস্থ্য সমস্ত সুখের চাবিকাঠি। আর সেই শরীরে অসুখের আনাগোনাতে বিদেয় হয় সব সুখের। শরীরকে ভালো রাখা কোনো রকেট সায়েন্স নয় বরং সহজ সাধারণ কিছু নিয়ম যা মেনে চলা একটা সুন্দর অভ্যাস।
শরীর মন একে অন্যের সাথে যুক্ত। তাই উভয়ের মেলবন্ধনেই আছে সব অসুখ বিসুখ নির্মূল করার ফর্মুলা। সুস্থ থাকার জন্য ইম্যুনিটি অক্ষুন্ন রাখাও সবচেয়ে দরকারী। না হলে যেকোনো ছোটখাটো রোগ আপনাকে কাবু করে ফেলতে পারে,শঙ্কা বাড়ে প্রাণহানির ও। ঠিক যেমন সাম্প্রতিক কালের করোনা ভাইরাস এর প্রকোপ দেখা গেছে তাদের উপর যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একদমই কম।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি কি? কিভাবে কাজ করে?
- দেশের সেনাবাহিনী যেমন আমাদের সীমান্তে নিযুক্ত থেকে পাহারা দেয় ঠিক তেমনি আমাদের শরীরের ভেতরেও এমন এক সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে যা বাইরের ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি দেখলেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের বাঁচায়।
- এটি হলো জৈবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা যা সবদেহেই থাকে। এই সেনারা যদি দুর্বল হয়ে পড়ে তবে বাইরের শত্রুরা আমাদের নানা রোগজ্বালা বাঁধিয়ে আমাদের জীবন ওষ্ঠাগত করে।
- এই সিস্টেমের অনেক ভাগ আছে যেমন, সারফেস ব্যারিয়ার, ইনেট, কমপ্লিট ও এড্যাপ্টিভ ইমিউনতন্ত্র।
- আমাদের সবচেয়ে বড় সৈন্য হলো ত্বক। বাইরের ধুয়ো ধুলো দূষণ ইত্যাদি এটার মিউকাসে ফিল্টার হয়ে যায় এবং আমাদের শরীরে সরাসরি প্রবেশে বাধা দেয়।
- তারপর আসে মাইক্রোওরগানিজম যা টক্সিন এর সাথে যুদ্ধ করে। এরপর থাকে শ্বেত কণিকা যা ভাইরাস ও জীবাণু খুঁজে মারে।
- এরপর থাকে ডেনড্রাইক সেল ও এন্টিবডি যারা জীবাণু চিহ্নিত করে নিষ্ক্রিয় করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমার উপসর্গ:
- আধুনিক জীবনযাত্রা আমূল বদলে যাবার মাশুল দিতে হচ্ছে আমাদের।ক্রমশ কমছে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা। বয়স, খাদ্যাভ্যাস, মানসিক প্রতিক্রিয়া এবং শারীরিক অনুশীলন এর মত ফ্যাক্টরগুলি প্রভাব ফেলে এতে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবার কিছু কমন উপসর্গ হলো – বারবার ঠান্ডা লাগা, কাশি হওয়া, এলার্জি, ত্বকে রাশ বেরোনো, ফাঙ্গাল ইনফেকশন, মাড়ি ফুলে থাকা ইত্যাদি।
- শরীরে অন্যতম রোগ প্রতিরোধক উপাদান হলো ভিটামিন ডি। তার অনুপস্থিতিতে ক্লান্তি, ঝিমুনি, হতাশা, দুর্বল ভাব আস্তে পারে।
- প্রয়োজনে জ্বর হওয়াও কিন্তু সুস্থতার লক্ষণ। অনেকেই জ্বর আসার আগেই ওষুধ খেয়ে নেন। এটা ঠিক নয় তাতে শরীরের জ্বর এর সাথে লড়াই করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। তাই সময়ে জ্বর হোক আর ভালোও হোক নিজে থেকেই।
- এসিডিটি, পেটের কোষ্ঠকাঠিন্য এবং হজমে গোলমাল হওয়াও কিন্তু এক ধরনের উপসর্গ।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাপোর্ট দিন:
- শরীরের অনাক্রম্মতা বাড়ানোর প্রথম মন্ত্র হলো স্বাস্থ্যের জীবনধারা নির্বাচন।একটি সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে আপনি দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।
- এভাবেই কিন্তু একটি আদর্শ লাইফস্টাইল গড়ে ওঠে। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও।
যেসব জিনিস জীবন থেকে বাদ দেবেন:
- এবার দেখে নিন কি কি জিনিস নিজেদের রোজকারের জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে।
- চা, কফি, চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য খাবেন না। এতে শরীরে স্থূলতা আসে আর রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ও বাড়ে।
- ভাত বেশি নয়। কারণ আমাদের শরীরে ৬০% খাদ্যই আসে কার্ব থেকে, বাকি ৩০% প্রোটিন ও বাকিটা ফ্যাট ও অন্যান্য ভিটামিন ও মিনারেল থেকে। তাই অতিরিক্ত ভাত শরীরে ফ্যাট হিসাবে জমা হয়ে নানান ক্ষতি করে।
- ধূমপান ও অতিরিক্ত চিন্তা ইত্যাদি জীবন থেকে বাদ দেবেন।
শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কিছু উপায়:
- বিশ্বজুড়ে গবেষকরা বলছেন যে যাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম তাদের অল্প রোগেও সুস্থ হতে সময় লাগে ও ভবিষ্যতে বড়ো রোগে ভোগার চান্স বাড়ে।
- জার্নাল অফ সায়েন্স এবং মেডিসিন জানাচ্ছে যে দুগ্ধজাত খাবার অর্থাৎ দই, ছানা, পনির ইত্যাদি পাকস্থলীতে একধরনের আবরণ তৈরি করে যাতে সেখানে উপকারী জীবাণু বেড়ে উঠতে পারে।
- এই জীবাণু গুলি আমাদের শারীরবৃত্তীয় কাজে সহায়তা করে। এগুলোর সংখ্যা কমে গেলে আমরা অসুস্থ হই। তাই বেশি করে মিল্ক প্রোডাক্ট খান।
- ভিটামিন বি ও সি সমৃদ্ধ নানা ফল ও টাটকা সব্জি খাবার টেবিলে রাখুন। কারণ ভিটামিন বি নার্ভাস সিস্টেমকে তরতাজা রাখে, প্রদাহ রোধ এবং কোষ মেরামত করে।
- ভিটামিন সি অন্যদিকে ত্বক ও চুলের যত্ন নেয়। এতে থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট হার্ট এটাক ও ক্যান্সার এর ঝুঁকি কমায়।
- মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি প্রোটিন জাতীয় খাদ্য খান যাতে শরীরের ওজন এর অনুপাতে ভারসাম্য তৈরি হয়। প্রোটিন দেহের অভ্যন্তরীণ শক্তি বাড়ায় এবং মেয়েদের প্রোস্টাগ্ল্যান্ডডিন হরমোন ক্ষরনে সাহায্য করে যা খুবই উপকারী।
- এর সাথে দেহে শ্বেতকনিকা অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়াতে বাদাম, শিম ইত্যাদি খান এতে জিঙ্ক থাকে যা ফুসফুসে আক্রমন প্রতিহত করে।
- ভিটামিন ডি লাভের জন্য রোদে দাঁড়ান, পালং, বিন্স, মাশরুম, কড, স্যামন মাছ খান তাতে সেলেনিয়াম, কপার, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি থাকে যাতে হাড়ের ও দাঁতের গঠন ঠিক থাকবে।
নিয়মিত শরীরচর্চা করুন:
- প্রাত্যহিক পরিশ্রম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সচলতা, কর্মক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়তা করে। শরীরচর্চার ফলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়।
- চেষ্টা করুন দিনে অন্তত কুড়ি মিনিট হাঁটাহাঁটি করার ফলে ঘাম ও ঝরে এবং কোষে কোষে অক্সিজেন গেলে আপনি ভেতর থেকে চাঙ্গা অনুভব করবেন।
- আসন ও ধ্যানের দ্বারা মনের একাগ্রতা ও প্রশান্তি লাভ করুন। এগুলির ফলে শ্বাস ক্রিয়া উন্নত হয় আর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হবার ভয় কমে।
- স্মরণশক্তি বাড়ে ,রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে সাথে হাড়ের গঠন মজবুত হয়। শরীর ও নমনীয় হয়ে ওঠে। আত্মশৃঙ্খলার পাঠ ও নিতে পারেন এর থেকে।
যে গুলো ভুলেও ভুলবেন না:
- হাসি সবচেয়ে বড় মহা ঔষধ। হাসিতেই অর্ধেক রোগ সারে। আন্তরিক ভাবে হাসলে স্ট্রেস হরমোন কমে ও ডোপামিন নিঃসরণ বাড়ে যাতে আমাদের প্রাণবন্ত ফিল হয়।
- আশাবাদী হোন। ইতিবাচক চিন্তা আপনার মন ভালো রাখবে। জীবনীশক্তি বাড়লে আপনি সক্রিয় থাকবেন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবেন সহজেই।
- কিছুটা এলোমেলো থাকুন। বেশি পরিপাটি থাকা আমাদের দুর্বল বানায়।অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতা আমাদের জীবাণুমুক্ত করে ঠিকই কিন্তু তার সংস্পর্শ থেকে দুরেও করে দেয় ফলে বডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজেকে সেগুলোর বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে তুলতে পারেনা।
- রাত্রে ৭ঘন্টা ঘুমোন। যাতে শরীরে টি সেল গুলি নিজেদের কাজ করার শক্তি ফিরে পায়। অনেকটা আমাদের ফোনে ব্যাটারি চার্জ দেবার মতোই।
- মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান করুন। আর বাথরুম এ তো সবাই সিঙ্গার। এর ফলে ইমিউনোগ্লোবিন হরমন বাড়ে যেটা আমাদের জন্য একান্ত উপকারী।
মন্তব্য করুন