কথায় বলে, একটি বেলপাতাতেই তিনি তুষ্ট। কাল থেকে শুরু হচ্ছে শ্রাবণ মাস, মানে বাবার মাস। এই মাসে আমরা সবাই শিবলিঙ্গে পুজো করি মহাদেবের আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য।
আর মহাদেবকে তুষ্ট করার জন্য সবচেয়ে দরকারী উপকরণ যেটি সেটি হল বেলপাতা। এটি ছাড়া শিবের পুজো অসম্ভব। কিন্তু শিবপুজোয় কেন বেলপাতা এতো গুরুত্বপূর্ণ, জানুন আজকের এই লেখায়।
১. পার্বতীর থেকেই নাকি বেলগাছের জন্ম
পুরাণে বেলগাছের জন্ম নিয়ে একটা গল্প আছে। একবার দেবী পার্বতীকে তাঁর সখীরা মানে জয়া, বিজয়া, জয়ন্তী বলেছিলেন ঘুরতে যাবেন। পার্বতী সিংহকে ডেকে তাঁর পিঠে চড়ে সখীদের নিয়ে গেলেন একটি পর্বতে। এবার যাওয়ার সময়ে যাত্রার ধকলের ফলে পার্বতীর কপালে স্বেদবিন্দুর জন্ম হয় মানে ঘাম দেখা যায়। সেই স্বেদবিন্দু মাটিতে পড়ার পর তার থেকে একটি ছোট গাছের জন্ম হয় যার তিনটি পাতা। তখন সখীরা পার্বতীকে বললেন এই গাছের একটি নাম দিতে। পার্বতী তখন এই গাছের নাম দিলেন বিল্ব গাছ।
তিনি নিজের নানান অংশ এই গাছে স্থাপন করেন। যেমন গিরিজা রূপে তিনি রইলেন শিকড়ে, কাত্যায়ণী নামে ফলে, দুর্গা রূপে ফুলে। তিনিই নিজে ঘোষণা করেন মহাদেবকে এই গাছের পাতা আর ফুল দিয়ে পুজো করলে তিনি সবচেয়ে তুষ্ট হবেন।
দেবী পার্বতী নিজে এই গাছে অধিষ্ঠান করছেন। তাই এই গাছের পাতা বা ফুল মহাদেবকে দেওয়া মানে আসলে পার্বতীকেই মহাদেবের কাছে অর্পণ করা। এই গল্প থেকেই বেলপাতা মহাদেবের পুজোর অন্যতম অঙ্গ হয়ে গেল।
২. বেলপাতায় লক্ষ্মীও করেন অবস্থান
বেলপাতা শিবের কেন এতো প্রিয় সেটা নিয়ে আরেকটি কিংবদন্তী আছে। পুরাণে বলছে, লক্ষ্মী নাকি মহাদেবের পুজোয় ১০০০টি পদ্মফুল দিতেন মহাদেবকে। একবার এরকমই পুজোর সময়ে তিনি দেখলে দুটি পদ্মফুল নেই। তিনি তো চিন্তায় পড়ে গেলেন। তখন নারায়ণ লক্ষ্মীকে বললেন, লক্ষ্মীর দুটি স্তন পদ্মের মতোই পবিত্র, তিনি দুটি স্তন অর্পণ করতে পারেন মহাদেবকে। লক্ষ্মী তখন তার দুই স্তন কেটে মহাদেবের উদ্দেশে নিবেদন করলেন। দেবী লক্ষ্মীর এই নিষ্ঠা দেখে মহাদেব তাঁকে আশীর্বাদ দিলেন এবং বললেন লক্ষ্মীর স্তন বেলগাছে বেলফল হিসেবে থাকবে। অর্থাৎ দেবী লক্ষ্মী স্বয়ং বেল গাছে অবস্থান করবেন। যিনি এই গাছের ফল বা পাতা দিয়ে মহাদেবের পুজো করবেন তিনি পরম শান্তি আর শ্রী লাভ করবেন।
৩. শিবরাত্রির কাহিনীতেও বেলপাতার মাহাত্ম্য
আমরা সবাই শিবরাত্রির কাহিনী জানি। কী সেই কাহিনী! একবার এক ব্যাধ সারা দিন শিকার করার পর সেই শিকার করা পশুর মাংস বিক্রি করতে পারলেন না। ফলে হাতে অর্থও এলো না। তিনি মনের কষ্টে না খেয়ে একটি গাছের ওপর রাত কাটাতে থাকলেন। সারা দিন না খাওয়া, মনের কষ্ট, সব মিলিয়ে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন আর কাঁদছিলেন। ঘটনাক্রমে সেই গাছটি ছিল একটি বেলগাছ আর তার নিচে একটি শিবলিঙ্গ ছিল।
ব্যাধের চোখের জল মিশ্রিত বেলপাতা মহাদেবের মাথার ওপরে পড়ল এবং তিনি সন্তুষ্ট হয়ে ব্যাধকে পরম শান্তি আর মোক্ষের আশীর্বাদ দিলেন। এর থেকে যেমন শিবরাত্রির ব্রতকথার প্রচলন হল, তেমনই বেলপাতার মাহাত্ম্যও অন্য পর্যায়ে গেল। কারণ ব্যাধ তো অন্য কিছু দিয়ে মহাদেবের আরাধনা করেননি। শুধু একটি বেলপাতাতেই ব্যাধ শিবপ্রাপ্ত হলেন। তাই শিবের পুজোয় বেলপাতার অবদান অসীম।
৪. বেল মহাদেবকে শান্ত করে
শিবলিঙ্গ পরম তেজোময়, জ্যোতির্লিঙ্গ। শিবলিঙ্গ আগুনের মতো তেজ ধারণ করে নিজের মধ্যে। তাই শিবলিঙ্গের পুজো হয় স্নান করিয়ে, অর্থাৎ তাঁকে শীতল করে। বলা হয়, জল ছাড়াও বেলপাতা মহাদেবকে শান্ত আর শীতল রাখে। তাই যারাই মহাদেবকে বেলপাতা দিয়ে শীতল রাখবেন তারাই তাঁর আশীর্বাদ পাবেন।
৫. বেলপাতায় তিনের গুরুত্ব
বেলপাতাই সেই একমাত্র পাতা যেখানে একসঙ্গে তিনটি পাতা দেখা যায়, একই বৃন্তে। তিনটি পত্র মিলেই একটি বেলপাতা হয়। এমনকি এই তিনটি একসঙ্গে ছাড়া একটি একটি করে বেলপাতা আমরা ভাবতেই পারি না।
আমাদের শাস্ত্রে তিনের খুব গুরুত্ব। আমাদের গুণ তিনটি- স্বত্বঃ, রজঃ আর তমঃ। আমাদের পরম দেবতাও তিনজন- ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর। আমাদের তিনটে লোক- স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতাল।
বলা হয়, বেলপাতা এই তিনকেই বোঝায় একই অঙ্গে। তাই মহাদেবকে বেলপাতা অর্পণ করা মানে নিজের তিন গুণ, তিন লোক, সব দেবতা, সব কিছু ওনাকে নিবেদন করা। একটি বেলপাতা তাই নিজেকে সার্বিকভাবে সমর্পণকে নির্দেশ করে। আর সার্বিক সমর্পণ না হলে কী দেবাদিদেব তুষ্ট হন!
৬. বেলপাতা স্বয়ং মহাদেব
বেলপাতার তিনটে পত্র মহাদেবের চোখের মতো। আবার এটি ত্রিশূলের তিনটি ফলার সঙ্গেও মেলে। একদম শুরুতে পার্বতীর যে গল্প বলেছিলাম সেখানে পার্বতী মহাদেবের সঙ্গে এই পাতার এতো মিল দেখেই নিজেকে বেলগাছে স্থাপন করেন। বেলগাছেই তিনি শিবের সঙ্গে একত্রে থাকেন। এই জন্যই তিনি বেলপাতা নিবেদন করতে বলেন মহাদেবকে। বেলপাতা তাই স্বয়ং মহাদেবই। তাই শিবের পুজোয় এই পাতার এতো গুরুত্ব।
অন্য সব কিছু দিন বা না দিন, মহাদেবের পুজোয় তাই বেলপাতা অবশ্যই নিবেদন করবেন। তাহলেই মহাদেবের আশীর্বাদ আপনাদের ওপর বর্ষিত হবে।
মন্তব্য করুন