বর্তমানে বাংলাদেশ ও বিদেশের গণমাধ্যমের হট টপিক এখন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরীমনি। তাকে ঘিরে ফাঁস হচ্ছে একের পর এক ভিডিও ফুটেজ, সরগরম হয়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি মিডিয়া। এতটাই সরগরম, সমসাময়িক অন্যান্য ছোট-বড় গুরুত্বপূর্ণ খবর চাপা পড়ে যাচ্ছে পরীমনি কেলেঙ্কারিতে।
সম্প্রতি বোট ক্লাব ও র্যাবের অভিযানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফাঁস হওয়া ফুটেজগুলো ঘিরে পরীমনির চরিত্র নিয়ে নানা ধরণের কথা উঠে আসছে। পরীমনির সাথে আসলে কি কি ঘটনা ঘটেছিল, কেন নানা রকমের কথা উঠে আসছে, তা নিয়ে থাকছে আজকের বিস্তারিত আলোচনা।
কি হয়েছিল বোট ক্লাবে পরীমনির সাথে?
৯ জুন ২০২১ তারিখে বোট ক্লাবের ঘটনায় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পরীমনির দাবী, তাকে বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি এর জন্য ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন মাহমুদকে অভিযুক্ত করেন। রাত বারোটার সময়ে ক্লাবে যাওয়ার কারণ হিসেবে পরীমনি বলেন যে তিনি সেখানে একটা কাজের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিলেন।
সেখানে আগে থেকেই চার-পাঁচজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। পরীমনিকে তারা প্রথমে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন। কফি আসতে দেরি হওয়ায় নায়িকাকে তখন কোক পরিবেশন করেন তারা। কিন্তু কোকে চুমুক দিয়ে পরী কিছুটা বিপদের আঁচ করতে পারেন, কারণ কোকের স্বাদটা তার কাছে খুব একটা ভালো ঠেকছিল না।
কোক খাওয়ার এক পর্যায়ে নাসির উদ্দিন মাহমুদ এসে পরীর সাথে কথা বলতে শুরু করেন। পরীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নাসির তাকে জোরপূর্বক মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকির পরীর সাথে থাকা বন্ধু জিমিকেও নাসির প্রচন্ড মারধোর করেছেন। পরী মদ খেতে না চাওয়ায় নাসির তাকেও মারধোর করেন এবং শারীরিক নির্যাতন ও হত্যার চেষ্টা করেন।
সাংবাদিকদের কাছে এক সাক্ষাৎকারে এই চিত্রনায়িকা পনেরো সেকেন্ডের একটা ভিডিও ফুটেজের কথা উল্লেখ করেন। তিনি দাবি করেন ঐ ফুটেজেই তার উপর হওয়া নির্যাতনের প্রমাণ আছে। যদিও ফুটেজটাতে স্পষ্ট কিছু দেখা না গেলেও কিছু পুরুষ কন্ঠে অকথ্য গালিগালাজের আওয়াজ শোনা যায়।
কিন্তু ঘটনা সম্পর্কে নাসিরের দেয়া তথ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, যার সত্যতা পাওয়া গেছে ফাঁস হওয়া দশ সেকেন্ডের আরেকটি ভিডিও ক্লিপে। সেখানে দেখা যায় যে নাসির পরীকে কিছু একটা করতে নিষেধ করছেন কিন্তু পরী শুনছেন না। নাসির বলেন যে পরী ক্লাবে ঢুকেই সামনের চেয়ারে তার দুই বন্ধু অমি ও জিমিকে নিয়ে মদ খাওয়া শুরু করেন।
এটা খেয়াল করার পরে তিনি কাছে গিয়ে পরীমনিকে মদ খাওয়া বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু পরীমনি তা না শুনেই একটা মদের বোতল নিতে যান। এবারও নাসির তাকে বলেন যে তিনি কোন বিদেশি মদের বোতল নিতে পারবেন না৷ নাসির তাকে অনেকভাবে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।
ভিডিওতে দেখা যায় যে নাসির পরীকে বলছেন, “হোয়াট ইজ দিস, প্লিজ স্টপ ইট, ডোন্ট ডু দিস, ইট’স টু মাচ”। কিন্তু জবাবে নায়িকা চিৎকার করে বলে উঠেন, “অ্যাই যা, যা, বেরিয়ে যা”।
নাসিরের বিরুদ্ধে পরীর মামলা
পরীমনি বলেন যে ৯ জুনের ঘটনার পরেরদিন তিনি বনানী থানায় নাসিরের নামে অভিযোগ করেন। কিন্তু বনানী পুলিশ তারা মামলা নেয়নি। পরে সাভার থানার পুলিশ তার মামলাটি গ্রহণ করে। এরপরে ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে নাসিরসহ পাঁচজনকে মাদক মামলায় গ্রেফতার করে।
কিন্তু গ্রেফতারের কিছুদিন পরেই নাসির ছাড়া পেয়ে যান। ১৩ জুন পরীমনি নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে তার উপর হওয়া নির্যাতনের কথা জানান এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চান। এরপরে ১৪ জুন নিজের বাসায় তিনি প্রেস ব্রিফিং করেন। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি সাংবাদিকদের সবটা খুলে বলেন।
তিনি আরো বলেন যে অনেক জায়গায় তিনি সাহায্যের জন্য গিয়েছিলেন কিন্তু কেউ তার কথা আমলে নেয়নি। সবার কাছে সাহায্য চান তিনি, তিনি আত্মহত্যা কখনোই করবেন না, সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করবেন না। ঘটনার পর থেকে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন। তাকে উপরমহল থেকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ওদিকে নাসির অভিযোগ করেন যে পরীমনিকে মদ খেতে নিষেধ করায় পরী তার বিরুদ্ধে এমন বানোয়াট কাহিনী বলছে। তিনি পুলিশকে অনুরোধ করেছিলেন যেন ক্লাবের ভিতরকার সিসিটিভি ফুটেজটা সম্পূর্ণ চেক করা হয়। কিন্তু পুলিশ এখানেও দায়সারাভাবে তদন্ত চালিয়ে গেছে।
তবে বোট ক্লাবের ঘটনা সামনে আসার পরে গুলশান অল কমিউনিটি ক্লাবের সভাপতি কে এম আলমগীর ইকবাল পরীমনির বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ আনেন। নাসির গ্রেফতার হওয়ার দুই দিন পরে পুলিশকে তিনি (ইকবাল) জানান যে ৭ জুন পরীমনি তার ক্লাবে গিয়ে ভাঙচুর করেছেন। গুলশান ক্লাবের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় পরীমনি অন্য একজন নারী ও দুইজন পুরুষকে নিয়ে লিফটে প্রবেশ করছেন এবং নির্ধারিত ফ্লোরে এসে লিফট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে পরীমনির কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যে সত্যিই তিনি যদি ভাঙচুর করে থাকেন তাহলে ক্লাব কর্তৃপক্ষ কেন এতদিন চুপ করে ছিল? কেন সেই ঘটনার আটদিন পরে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে? আরো আগে কেন ক্লাব কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে মামলা করে নি? এতদিন পরে ভাঙচুরের অভিযোগ আনাটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
পরীমনির বাসায় র্যাবের অভিযান
বোট ক্লাবের ঘটনার ধোঁয়াশা না কাটতেই গেল ৪ আগস্ট বিকাল তিনটার দিকে পরীমনির বনানীর বাসায় র্যাব অভিযান চালায়। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান যে নায়িকা পরীর বিরুদ্ধে তারা সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ পেয়েছেন বলেই অভিযান চালিয়েছেন।
বনানীর লেক ভিউ ১৯/এ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়িতে অভিযান চলাকালে র্যাবের একটি ও পুলিশের কয়েকটি গাড়ি বাড়ির নিচে দেখা গিয়েছে। এছাড়াও বাসার আশেপাশে, মূল গেটের ভিতরে ও বাইরে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা অবস্থান নিয়েছিল।
র্যাব বিকাল তিনটার দিকে আসলেও পরীমনির বাসায় তারা ঢুকতে পেরেছেন সাড়ে চারটার সময়ে। কারণ পরী তখন ফেসবুক লাইভে এসে জানান যে তিনি আশঙ্কা করছেন একদল লোক তাকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছে। তিনি প্রচন্ড ভয় পাচ্ছেন দরজা খুলতে, লাইভেই মানুষকে তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন। আরও বলেন যে লোকগুলোর সবার গায়ের জামাকাপড় ভিন্ন এবং তারা মূল গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকেছে। লাইভে থাকা অবস্থাতেই তিনি বনানী থানায় ফোন করে ফোর্স পাঠাতে বলেন।
সাড়ে চারটার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর পরিচয় নিশ্চিত করে পরীমনি দরজা খুলে দেন। তখনও তিনি লাইভে ছিলেন। ভিতরে ঢোকার পরে র্যাব সদস্যের অনুরোধে এক পর্যায়ে তিনি লাইভ বন্ধ করে দেন। এবং বারান্দায় এসে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকদের উপরে আসার জন্য অনুরোধ করেন।
এরপরে র্যাব সাড়ে তিন ঘন্টা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মদের বোতল উদ্ধার করে। সবশেষে পরীমনি, তার গাড়িচালক, এবং বাসার একজন কর্মীকেও র্যাব তাদের গাড়িতে করে নিয়ে যায়। যদিও ঠিক কোন অভিযোগের ভিত্তিতে নায়িকাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এ বিষয়ে র্যাব কোন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেয় নি। পরে নায়িকা পরীর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনে মামলা করা হয়।
পরীমনি-সাকলায়েন কান্ড
এতো ঘটনার মাঝে হঠাৎ করে নতুন করে বোমা ফাটালো পরীমনি-সাকলায়েনের একটি ভিডিও। প্রায় দুই মিনিটের ভিডিওতে দেখা যায় পরীমনি খুব আনন্দের সাথে ডিবি কর্মকর্তা মোহাম্মদ গোলাম সাকলায়েনের জন্মদিন পালন করছেন। নীল-কালো রঙের সেটিং আর হিন্দি গানের তালে তালে কেক কাটেন পরী ও সাকলায়েন।
এক পর্যায়ে সাকলায়েনের মুখে কেক রেখে সেটাতেই কামড় দিয়ে ‘কেক কিস’ করেন পরীমনি। আবার সাকলায়েনকে সরাসরি চুমুও খান পরী। এই ফুটেজ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় তাদের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক চলছে। উল্লেখ্য, গোলাম সাকলায়েন বিবাহিত এবং বোট ক্লাব ঘটনার তদন্ত থেকেই দু’জনের পরিচয় হয়।
তদন্তের নামে সাকলায়েন পরীমনির সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন বলে জানা গেছে। জন্মদিনের ফুটেজ বাদেও আরেকটি ভিডিও ফাঁস হয়েছে যেটা ছিল সাকলায়েন অ্যাপার্টমেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ। ১ আগস্ট সকাল সোয়া আটটায় একটি সাদা রঙের গাড়িতে করে ঐ ডিবি কর্মকর্তার বাড়িতে যান পরীমনি। সিসিটিভি ফুটেজে তাকে লিফটে ঢুকতে দেখা যায়। আঠারো ঘন্টা পরে নায়িকাকে সাকলায়েনের বাসা থেকে বের হতে দেখা যায়। পরীমনির ড্রাইভার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কাছে এই ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন।
আঠারো ঘন্টা নায়িকা পরী তার বাসায় কি করছিলেন, এ বিষয়ে কোন সদুত্তর দেননি সাকলায়েন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে পরীমনি শুধুই তার ভালো বন্ধু, পরী কখনোই তার বাসায় যায়নি। তাদের মধ্যে কোন প্রেম বা বৈবাহিক সম্পর্ক নেই। তিনি কার সাথে ঘুরবেন বা কি করবেন সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে ভিডিও ফুটেজটা ফাঁস হয়েছে সেটার কোন সত্যতা নেই।
এগুলো ছাড়াও আরেকটি ছোট ভিডিও ফাঁস হয়েছে যেখানে পরীমনিকে তার বন্ধুদের সাথে নিজ বাসায় মদ খেতে দেখা গেছে।
আসল সত্যটা কি?
সত্যিকার অর্থে পরীমনির ঘটনার এখন পর্যন্ত কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ফাঁস হওয়া ফুটেজগুলোর উপর ভিত্তি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় চিত্রনায়িকা পরীমনির চরিত্র নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কারো চোখে তিনি নির্যাতিতা, নিপীড়িতা, অসহায়। আবার কারো চোখে তিনি স্রেফ একজন দেহ পসারিণী।
রাত বারোটায় ক্লাবে যাওয়া, মদ খাওয়া, ডিবি পুলিশের বাড়িতে আঠারো ঘন্টা কাটানো মেয়ে কখনোই ভদ্র ঘরের সন্তান হতে পারে না – এরকমই কমেন্টে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব হয়ে গেছে। অনেকে আবার তার বৈবাহিক জীবন ও একাধিক পুরুষের সাথে মেলামেশা নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েন নি।
সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী পরীমনি এখন জেলের আসামি হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে জেলেই থাকতে হবে। চারবার জামিনের আবেদন করেও জামিন মেলেনি, যেটা খুবই অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। জেলে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, দ্রুত মুক্তি পেতে চান – এমন আর্জি পরীমনি জানিয়েছেন তার আইনজীবীদের কাছে।
শিল্পী সমিতি থেকে ইতোমধ্যে পরীমনির জন্য ন্যায় বিচার ও মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করা হয়েছে। চিত্রনায়িকা আজমেরি হক বাঁধন বলেছেন পরীমনি যেন সঠিক বিচার পায়৷ একজন মেয়েকে চলচ্চিত্র জগতে কি পরিমাণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেটা তিনিও জানেন, পরীমনির কষ্টটা তিনি অনুভব করতে পেরেছেন। চিত্রনায়ক শাকিব খান এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন তিনি পরীমনির পাশে আছেন।
মন্তব্য করুন