ওজন কমানোর জন্য আমরা সবাই সর্বপ্রথমে আমাদের রেগুলার ডায়েট বদলে ফেলি। শরীরচর্চার সাথে সাথে চলতে থাকে কঠোর ডায়েট চার্ট মেনে চলা। নিয়ম মাফিক খাওয়াদাওয়া একটু উনিশ-বিশ হলে ভয় ধরে যায়, ওজনটা আবার বেড়ে গেলো কিনা। কিন্তু কাঁহাতক এই দুশ্চিন্তা নিয়ে চলা যায়?
কেমন হবে যদি মেপে মেপে সব ধরণের খাবার খাওয়ার চাইতে নির্দিষ্ট একটি খাবার দিয়ে শরীর ঠিক রাখা যায়? হ্যাঁ, এটা সম্ভব। এমন আশ্চর্যজনক খাবারটি হচ্ছে মিলেট।আজকের জানতে পারবেন কেন ওজন কমাতে মিলেট খাওয়ার উপরই জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। আরো জানতে পারবেন এর উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম।
মিলেট কি?
মিলেট হচ্ছে এক ধরণের ক্ষুদ্রাকার শস্যদানা যা এশিয়া ও আফ্রিকার সেমি-ড্রাই অঞ্চলগুলোতে জন্মায়। প্রাচীনকালে ভারত উপমহাদেশে যখন ভাত ও গমের আধিক্য ছিল না, তখন নিম্নআয়ের মানুষ মিলেট খেয়ে বেঁচে থাকতো। গ্লুটেনবিহীন এই শস্যদানা প্রোটিন, ফাইবার, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের আখড়া। তাই সহজে ওজন কমানোর জন্য মিলেটের বিকল্প খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
মিলেট কিভাবে ওজন কমায়?
মিলেটে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি সহজে হজম হয়। অন্যান্য খাবার হজম না হলে শরীরে মেদ বাড়ে, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি নানা সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু সহজপাচ্য মিলেট গ্রহণে এসবের কানাকড়িও হয় না। যেহেতু হজমশক্তির উপর চাপ পড়ে না, সেহেতু গ্যাস্ট্রিক, কোলন ক্যান্সার, কিডনি, এবং লিভারের সমস্যা থাকে শত হস্ত দূরে।
মিলেট বদহজম সৃষ্টি করে না কিন্তু এটি হজম হতে একটু সময় নেয়। ফলে সারাদিন পেট ভরা থাকে, বারবার খাওয়ার তাগিদ থাকে না, এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর মিলেটে গ্লুটেন নেই তাই অ্যালার্জি হওয়ার চান্স থাকে না।
অন্যান্য কার্বোহাইড্রেটের তুলনায় মিলেটের কার্বোহাইড্রেট একদমই আলাদা। সাদা চালের ভাতে ফাইবার বলতে গেলে থাকেই না, আর এতে কার্বোহাইড্রেট থাকে উচ্চ মাত্রায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাদা ভাত ডায়াবেটিস এবং ওজন বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই ডাক্তাররা সাদা চালের বদলে লাল চালের ভাত খেতে পরামর্শ দেন। সাদা আটা ও লাল আটার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই৷ কিন্তু মিলেটের কার্বোহাইড্রেট ও উচ্চ মাত্রার ফাইবার রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ওজন বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে।
যারা ডায়েট কন্ট্রোল করে ফিট বডি পেতে চান, তাদের জন্য মিলেট একটি আদর্শ খাবার। ডায়েট কন্ট্রোলের নিয়ম হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্য অল্প অল্প করে প্রতিবেলায় খাওয়া। প্রতিদিনকার খাবারে মিলেট রাখলে শরীর অনেকটা পুষ্টি পেয়ে যায়। ফলে ডায়েটিং অনেক সহজ হয়ে যায়। এর ফাইবার অনেকক্ষণ পেটে থাকে তাই সারাদিনের এনার্জি নিয়ে কোন চিন্তা করতে হয় না।
৫ রকমের মিলেট যা ওজন কমানোর জন্য আদর্শঃ
১. ফিঙ্গার মিলেট (রাগি)
ফিঙ্গার মিলেটে অ্যামিনো অ্যাসিড, আয়রন, প্রোটিন, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, এবং পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি থাকে৷ এই মিলেট দিয়ে বানানো খাবার খেলে শরীর ভালো থাকে এবং বাড়তি ক্যালরি গ্রহণের চাহিদা কমে যায়৷ পাশাপাশি এটি ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
২. সোর্গাম (জোয়ার)
এই জাতের মিলেটে ভিটামিন বি-এর পরিমাণ বেশি থাকে। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে আছে – ম্যাগনেসিয়াম, ফ্ল্যাভোনয়েডস, ফেনোলিক অ্যাসিডস, এবং ট্যানিনস। বি ভিটামিন মেটাবলিজম বাড়ায়, চুল ও ত্বকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। ম্যাগনেসিয়াম হাড় ও হৃদপিণ্ডের দিকে খেয়াল রাখে। দৈনিক যতোটুকু ফাইবার গ্রহণ করা উচিত তার ২০ শতাংশ আসে ৯৬ গ্রাম জোয়ার থেকে। এতে ওজন ও ব্লাড সুগার থাকে নিয়ন্ত্রণে। আর মেটাবলিজম বাড়ার কারণে পরিপাকতন্ত্র সুস্থ থাকে।
৩. পার্ল মিলেট (বাজরা)
মিলেটের যতো প্রকারভেদ আছে, তার মধ্যে পার্ল মিলেট বা বাজরা সর্বোৎকৃষ্ট। যারা ওজন কমানোর চিন্তাভাবনা করছেন তারা তাদের ডায়েটে বাজরা অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এতে ক্যালরির পরিমাণ থাকে আশ্চর্যজনকভাবে কম। নিয়মিত বাজরা খেলে বাড়তি ক্যালরি গ্রহণের প্রয়োজন নেই৷ ফলে ধীরে ধীরে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমে যাবে। বাজরা টাইপ ২ ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কোলেস্টেরল, এবং অ্যাজমা প্রতিরোধ করে।
৪. অ্যামারান্থ (রাজগিরা)
অ্যামারান্থে মূলত ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ বেশি। এছাড়াও আছে ফাইবার, প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, এবং আয়রন। এতে থাকা প্রোটিন ও ফাইবার মাংসপেশির গঠন করে এবং পরিপাকতন্ত্র সচল রাখে।
৫. ফক্সটেইল মিলেট (কাকুম/কাঙ্গনি)
চালের গুঁড়া ও সুজিতে ফক্সটেইল মিলেট পাওয়া যায়। এই জাতের মিলেটে আয়রন, ক্যালসিয়াম, এবং কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকে। নরমাল কার্বোহাইড্রেট শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু কমপ্লেক্স কার্ব সেটা করে না। তাই বাড়তি ওজন ঝরানোর জন্য ফক্সটেইল কার্যকরী।
মিলেট খাওয়ার সঠিক নিয়মঃ
আপনি প্রতিদিন মিলেট খেতে পারবেন, এতে শরীরের কোন ক্ষতি হবে না। তবে প্রতিবেলায় খাওয়ার চাইতে এক বেলা বা সর্বোচ্চ দুই বেলা মিলেট খাবেন। কারণ এটি হজম হতে সময় নেয়, তাই অতিরিক্ত খেলে হজমে গোলযোগ ও পেট ফাঁপা হতে পারে। জেনে নিন কোন বেলায় মিলেটের কি কি আইটেম করে খেতে পারবেন।
- সকালের নাশতায় – মিলেট দিয়ে বানানো ডোসা, প্যানকেক, সেমাই, পিঠা ইত্যাদি।
- দুপুরের খাবারে – মিলেটের রুটি, খিচুরি, অথবা সালাদ৷
- সন্ধ্যার নাশতায় – লাড্ডু, কাপকেক (রাজগিরা দিয়ে বানানো হলে বেশি ভালো হয়)
- রাতের খাবারে – মিলেটের খিচুড়ি, স্যুপ, নুডলস, পরিজ অথবা পাস্তা।
মেনোপজে থাকা মহিলাদের জন্য মিলেট খাওয়া সবচাইতে বেশি জরুরি। এছাড়াও বাড়ন্ত শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্টের জন্য ফিঙ্গার মিলেট বেশি জরুরি। যদিও সাধারণ চাল, আটা, বা ময়দার তৈরি খাবারের চাইতে মিলেট দিয়ে বানানো খাবার বেশি উপকারী, কিন্তু তার মানে এই না যে ভাত ও রুটি একদম বাদ দিয়ে দিবেন। সব ধরণের শস্যই অদলবদল করে খাবেন, তাতে পুষ্টির কোন ঘাটতি থাকবে না।
মন্তব্য করুন