নিতাশা বিশ্বাস! নাম শোনেন নি তো? বা হয়তো শুনে থাকলেও সেইভাবে গুরুত্ব দেননি। কেনই বা দেবেন। ছেলে আর মেয়ে-এই দুই চেনা মাপের বাইরে অন্য কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করার মতো সাহস আজও আমাদের হয়নি। যদি থাকতো, তাহলে আজ আমরা বুঝতে পারতাম কত বড় কান্ড ঘটে গেছে আমাদেরই সামনে দিয়ে।
একটু মেয়েলী ধরনের ছেলে দেখলে আমরা টোন-টিটকারি কাটতে যতটা মজা পাই, তার এক শতাংশ আগ্রহও পাই না তাদের সমস্যা কি বুঝতে। কিন্তু এখন সময় বদলাচ্ছে, চিন্তাও বদলাচ্ছে খানিক। বদলে যাওয়া চিন্তার নামই নিতাশা। আসুন আজ আমরা তাকে নিয়ে জেনে নেই কিছু কথা, সঙ্গে থাকলো কিছু প্রশ্নও।
কে নিতাশা
আমরা এতদিন শুনেছি মিস ইন্ডিয়া, মিস ইউনিভার্স বা মিস্টার ইন্ডিয়া এই ধরনের নাম। আগ্রহ নিয়ে বসে থেকেছি কার মাথায় এবার মুকুটটি উঠলো সেটা দেখার জন্য। নিতাশার মাথাতেও মুকুট উঠেছে একটা। তিনি হয়েছেন ভারতের প্রথম মিস ট্রান্সকুইন-২০১৭, কলকাতা থেকেই। কি! একটু নাক কুঁচকালেন বুঝি। তাহলে কুঁচকানোর বাকি আছে এখনও। শুধু এখানেই শেষ হয়নি নিতাশার সফর। ২০১৮ সালে থাইল্যান্ডে মিস ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সকুইন-এ অংশগ্রহন করবেন তিনি ভারতের হয়ে। St. Xavier’s থেকে স্কুলিং, National Institute of Media and Communication থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর দিল্লী চলে যান তার ট্রান্সফর্মেশনের জন্য। আর বর্তমানে তাঁর এই সাফল্য অনেকটাই সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।
সমস্যাটা আসলে কোথায়
আইনের চোখে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে পরিচিত হবার পরেও সমাজ আজও এই মানুষদের খুব একটা মানুষ বলে মনে করে না। একটা বাঁকা চোখে দেখা, ঢাকঢাক গুরগুর করে তাদের সম্বন্ধে কথা বলা আর খানিকটা তাচ্ছিল্য করা, এই তো সমাজের বেশিরভাগ মানুষের আচরণ। সমস্যাটা আসলে আমাদের ভাবনায়, তার থেকেও বড় শিক্ষায়। বাইরে থেকে একজনকে দেখে জৈবিকভাবে ছেলে মনে হলেও ভিতরে ভিতরে সে যে মেয়ে হতে পারে- এই ধারনাটাই ছিল না সমাজের। একজন ছেলে একটা মেয়েকেই চাইবে আর একটা মেয়ে চাইবে ছেলেকে- বিপরীত লিঙ্গের এই সমীকরণে পড়ে অনেককেই নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
নিতাশার বাবাও নিতাশার লিঙ্গ পরিবর্তনের আগে তার জন্য ভালো বাঙ্গালী মেয়েই খুঁজছিলেন। কিন্তু, নিতাশার চাই ভালো বাঙ্গালী ছেলে। সেক্সের মতো একান্ত ব্যাক্তিগত বিষটাকে সমাজ ব্যাক্তিগতভাবে চালাতে দিতে চায় না। বাইরে থেকে দেখে যাকে ছেলে বলে মনে হচ্ছে, হতেই পারে হরমোনের কোনো বিশেষ পরিবর্তনের ফলে তাদের ছেলেকেই পছন্দ হল, কারণ মনে মনে সে তো মেয়ে। আমাদের শুরুতেই তাই শরীর আর মনের এই জোড় করে মিলমিশ খাওয়ানোটা বন্ধ করতে হবে। তাহলেই হয়তো আমরা এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে পারবো।
প্রতিবাদের নাম নিতাশা
যেহেতু সমাজের চোখে এটা এখনও স্বীকৃত নয়, তাই এই ট্রান্সজেন্ডারদের খানিক আলাদা ভাবে দেখে সমাজের মূল স্রোত থেকে আলাদা রাখা হয়। তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি কোনকিছুরই ব্যবস্থা হয় না। ভাবা হয় এই সব হয়তো তাদের জন্য নয়। এই ভাবনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নাম নিতাশা ও তাঁর মতো আরও অনেকে। ২৬ বছর বয়সী নিতাশা দেখিয়ে দিয়েছে যে তাঁরাও চাইলে র্যাম্প কাঁপাতে পারেন। র্যাম্পে হাঁটা বা এই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ আসলে চিরাচরিত সৌন্দর্য ধারনাকেও একভাবে আঘাত করাই বটে। শুধু নিতাশা নিজে কেন, যে ১৫০০ জন এখানে নাম লিখিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকেই হয়তো এই শ্রেনীর প্রতি সুবিচারের আশাতেই এসেছিলেন।
নিজেকে চিনুন, নিজেকে বুঝুন। স্টিরিওটাইপ ভাবনা নয়, আপনার মন কি চায় সেটা আগে দেখুন। আপনার ইচ্ছেগুলোকে ডানা মেলতে দিন। দেখবেন একদিন কুঁচকানো চোখগুলোও আপনার দিকে অবাক হয়ে দেখছে।
মন্তব্য করুন