মার্চ মাস থেকেই যা গরম পড়েছে তাতে সুস্থ থাকাই দায়। আর স্কিনের তো এইসময়ে শোচনীয় অবস্থা হয়ে যায়। ঘাম জমে জমে, তার মধ্যে ধুলো মিশে ত্বকের বারোটা বাজিয়ে দেয়। আর তারপর দেখা যায় অ্যাকনে, পিম্পলস এইসব। তার সঙ্গে থাকে চুলকুনি।
সাধারণ উপায়ে অনেক কিছুই তো আমরা করে থাকি এইসব থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু এবার যদি ডার্মাটোলজিস্টের থেকে পরামর্শ পাওয়া যায়, তাহলে কেমন হয়!
গরম কীভাবে ত্বকের ক্ষতি করে?
গরমের সময়ে আমাদের স্কিন কিছু বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হয়। যেমন ধরুন,
১. র্যাশঃ
গরমকালে আমাদের খুব ঘাম হয়। আর এই ঘামের মধ্যে জমতে থাকে বাইরের ধুলো-ময়লা। অনেক সময়ে ভাল করে পরিষ্কার না করার ফলে ত্বকের গভীরে এই ময়লা জমতে থাকে। তখন ওই জায়গা থেকে ঘাম নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে র্যাশ হয়।
২. সানবার্নঃ
সানবার্নের সাধারণ অর্থ হল ময়েশ্চার চলে যাওয়া। গরমের চড়া রোদ আমাদের ত্বক থেকে জল টেনে নেয়। ঘামের মাধ্যমে জল তো বেরিয়েই যায়। তাই ময়েশ্চার হারিয়ে ত্বক হয়ে যায় শুষ্ক, রুক্ষ। উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে স্কিন। ফলে বয়সের আগেই আমরা বুড়িয়ে যাই।
৩. ইনফেকশনঃ
গরমের সময়ে স্কিন ইনফেকশন অনেক বেড়ে যায়। ঘামের সঙ্গে ময়লা জমে স্কিনের নিচে জমা হতে থাকে। আর এই ময়লার মধ্যেই শুরু হয় ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের সংক্রমণ। তখন আমাদের স্কিন জ্বালা করে, চুলকায়, লাল হয়ে যায়।
৪. ব্রণঃ
আমাদের ত্বকের নিচে থাকা তৈল গ্রন্থি থেকে সিবাম নিঃসৃত হয়। এই সিবামের কাজ হল ত্বকের উজ্জ্বলতা বজায় রাখা, ত্বককে চকচকে রাখা হাইড্রেশনের মাধ্যমে। কিন্তু অতিরিক্ত ঘাম জমে আর তার সঙ্গে ময়লা মিশে যখন স্কিনের নিচে জমতে শুরু করে তখন তেল বাইরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন স্কিনের ওপরের অংশ ফুলে উঠতে শুরু করে আর তার মধ্যে থাকে দূষিত ময়লা। একেই আমরা ব্রণ বলি। নিয়ম করে মুখ ভালভাবে পরিষ্কার না করলে গরমে ব্রণ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।
৫. ট্যানঃ
গরমের দেশে থেকে ট্যান হবে না তা তো হয় না! কিন্তু এই গরমের সময়ে অতিরিক্ত তাপের ফলে ট্যান পড়ে যায়। একটা কালো ভাব স্কিনের ওপরে পড়ে। এতে দেখতে খুব বাজে লাগে। আর এই ট্যান সহজে তুলে ফেলাও বেশ কষ্টের।
২০টি গরমের স্কিন কেয়ার টিপসঃ
১. ময়েশ্চারাইজারঃ
সারাদিনের পর বাড়িতে এসে স্কিনে ময়েশ্চার অবশ্যই ব্যবহার করুন। আগে ভাল করে মুখ ধুয়ে নিন। তারপর ভাল কোনও ময়েশ্চার দিয়ে শুয়ে পড়ুন। গরমে এটি রোজ করুন। আর ময়েশ্চার মেখে কখনই বাইরে যাবেন না।
২. ময়েশ্চার বন্ধ করবেন নাঃ
আমাদের অনেকের ধারণা থাকে যে ময়েশ্চার শুধু শীতেই ব্যবহার করার জিনিস। কিন্তু গরমেও আমাদের ময়েশ্চার ব্যবহার করতে হয়। তবে শীতের ব্যবহার করা ময়েশ্চার এই সময়ে চলবে না। এই সময়ে গরমের উপযুক্ত হাল্কা ময়েশ্চার ব্যবহার করা উচিত।
৩. হাল্কা ক্রিম ব্যবহারঃ
গরমের সময়ে ভারী কোনও ক্রিম ব্যবহার করা ঠিক হবে না। যেহেতু এই সময়ে ঘাম হয়, তাই সেই ঘামের সঙ্গে ক্রিম মিশে স্কিনের নিচে জমা হতে থাকে। এতে স্কিন খারাপ হয়। তাই হাল্কা কোনও ক্রিম অল্প করে ব্যবহার করুন এই সময়ে।
৪. এক্সফোলিয়েটঃ
এক্সফোলিয়েট মানে হল স্কিন ভিতর থেকে পরিষ্কার করা। শুধু ফেস ওয়াশ এই কাজ করতে পারে না। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন ভাল এক্সফোলিয়েটর দিয়ে স্কিন ভিতর থেকে পরিষ্কার করুন। এতে ময়লা বা দূষিত পদার্থ বেরিয়ে যাবে।
৫. ভিটামিন সি খুব দরকারঃ
ভিটামিন সি’র মধ্যে থাকে কোলাজেন, যেটি হাইপারপিগমেনটেশন বন্ধ করে। আর এই ভিটামিন ত্বকের সার্বিক উন্নতির জন্য খুব দরকারী। তাই যে কোনও টক জাতীয় ফল এই সময়ে খেলে ভাল। সঙ্গে যে কোনও প্রোডাক্টের মধ্যে অল্প পাতিলেবুর রস মিশিয়ে মুখে ব্যবহার করলে সেখানেও ভাল ফল পাওয়া যাবে।
৬. গরমজলে স্নান নয়ঃ
গরমের সময়ে আমরা বারবার স্নান করি। আর বাড়িতে এসে ফ্রেস হওয়ার সময়ে অনেকেই গিজার অন করে হাল্কা গরম জলে স্নান করতে পছন্দ করেন। এই কাজ রোজ করলে কিন্তু খুবই ক্ষতি হয় স্কিনের। গরম জল আমাদের স্কিন ড্রাই করে দেয়। আর অনেক সময় ধরে স্নান করলে ড্রাই হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে গা ধুয়ে বেরিয়ে আসুন।
৭. ছায়ায় থাকুনঃ
সবসময়ে ছাতা ব্যবহার করুন এই গরমে। ছাতা সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে আপনার স্কিনকে সুরক্ষা দেবে। ছাতার সঙ্গে সানগ্লাস, মহিলারা ওড়না বা স্কার্ফ ব্যবহার করুন অবশ্যই। এতে চড়া রোদের থেকে স্কিনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে।
৮. মেকআপ হতে হবে নন-কোমেডোজেনিকঃ
নন-কোমেডোজেনিক বলা হয় সেই সব উপকরণকে যেগুলি ব্যবহার করলে আপনার স্কিনের পোর্স বন্ধ হয়ে যাবে না। অনেক ভারী মেকআপ উপাদান আছে যেগুলি সহজে ওঠে না, আর স্কিনে বসে যায়। গরমে সেই ধরণের মেকআপ ব্যবহার একদম উচিত নয়। আর ভাল হার্বাল মেকআপ ব্যবহার করাই উচিত।
৯. সানস্ক্রিন মাস্টঃ
গরমে রোদে যাবেন, আর সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন না, তা তো হয় না। সানস্ক্রিনের মধ্যে অবশ্যই অন্তত এসপিএফ ৩০ বা তার ওপরের সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। এতে ইউভি রে থেকে স্কিন রক্ষা পাবে। আর তেলতেলে সানস্ক্রিন ব্যবহার না কড়াই ভাল। অ্যাকোয়া বেস সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
১০. হাইড্রেশনের জন্য জলঃ
স্কিন তখনই ভাল থাকবে যখন স্কিনের পিএইচ লেভেল ভাল থাকে। আর স্কিনের পিএইচ লেভেল ভাল থাকবে যদি স্কিন হাইড্রেটেড থাকে। স্কিন হাইড্রেটেড রাখার জন্য তাই জল খান। সঙ্গে শরবৎ, ডাব এই সব অবশ্যই খান। এতে স্কিন ড্রাই হয়ে যাবে না।
১১. পায়ের যত্নঃ
শরীরের অন্য অংশের মতো পায়ের যত্ন নেওয়াও দরকার। পা এই সময়ে খুব বেশি ঘেমে যায়। কারণ মোজা, বুট পরা থাকে। তাই যখনই সুবিধে পাবেন একটু জুতো খুলে রাখুন। অন্য সময়ে বুটজাতীয় জুতো ব্যবহার না করাই ভাল। পায়ে যতটা সম্ভব হাওয়া খেলা দরকার।
১২. পায়ের পাতার যত্নঃ
পায়ের পাতা সবচেয়ে বেশি ময়লার সংস্পর্শে আসে। তাই পায়ের পাতার যত্ন খুব দরকার। স্নানের সময় অন্তত সতাহে তিন দিন পায়ের পাতা ঘষে নিন। তারপর ভাল ময়েশ্চারাইজার রাতে ব্যবহার করুন। এতে পায়ের পাতা ভাল আর নরম থাকবে।
১৩. কম মেকআপ ব্যবহারঃ
আগেই বলেছি ভারী মেকআপ ব্যবহার না করতে। কোনও পার্টি বা অনুষ্ঠানে গেলে মেকআপ যতটা পারুন কম করুন। বেসিক মেকআপের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিন। যত মেকআপ করবেন, তত ঘেমে যাবেন। এতে মেকআপও নষ্ট হবে, আর স্কিন খারাপ হয়ে যাবে।
১৪. বাড়িতে ফিরে মেকআপ তোলা মাস্টঃ
বাড়িতে ফেরার পর মেকআপ তোলা খুব দরকার। অনেকের বাজে অভ্যেস থাকে মেকআপ না তুলে ঘুমিয়ে পড়া। এতে মেকআপ স্কিনে থেকে গিয়ে স্কিনের পিএইচ ব্যাল্যান্স নষ্ট করে দেয়। তাই ভাল ক্লিনসার দিয়ে আগে মেকআপ তুলে নিন। তারপর একটা ময়েশ্চার লাগিয়ে শুতে যান।
১৫. ন্যাচারাল কেয়ারঃ
খুব দামী ব্র্যান্ডেড জিনিস নয়। ঘরে তৈরি সাধারণ জিনিস দিয়েও কিন্তু খুব সহজে স্কিন ভাল রাখা যায়। লেবু, টম্যাটো, পাতিলেবু খুব ভাল স্কিন ক্লিনসিং এর কাজ করে। দুধ খুব ভাল ময়েশ্চার করে। শশা স্কিন হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে। এগুলিই ব্যবহার করুন না!
১৬. চোখের যত্নঃ
চোখ ভাল না হলে স্কিন ভাল হয়ে কোনও লাভ নেই। চোখ বলতে চোখের চারপাশের স্কিনের কথা বলছি। চোখের নিচে কালি, ফোলাভাব আপনাকে বুড়িয়ে দেয়। তাই আন্ডার আই ক্রিম ব্যবহার করুন। এতে চোখের নিচের স্কিন টানটান থাকে। রিঙ্কল কম আসে।
১৭. হাইজিনঃ
গরমে হাইজিন মেনে চলা খুব দরকার। হাইজিন মানা বলতে বিশেষ কিছু বলা হচ্ছে না। শুধু বাড়িতে এসে একটু ফ্রেস হয়ে নেওয়া, নিয়ম করে মুখ ধোয়া, গায়ে ঘাম জমতে না দেওয়া এই সামান্য জিনিস মানলেই হবে। বাইরে গেলে রুমাল ব্যবহার করা, বারবার মুখে জল দেওয়া খুব দরকার।
১৮. শরীর ঠাণ্ডা রাখাঃ
গরমে শরীর ঠাণ্ডা রাখার মতো খাবারের দরকার। টক দই, শশা, শরবৎ, ফল বেশি করে খাওয়া উচিত। বেশি তেল-মশলার খাওয়া কম করা উচিত। যত সবজি বেশি খাওয়া যায় এই সময়ে তত এনার্জি পাওয়া যায়। ডাবের জল এই সময়ে অবশ্যই খাওয়া দরকার।
১৯. সাদামাটা পোশাকঃ
পোশাকের দিকেও এই সময়ে নজর দেওয়া দরকার। পোশাক হওয়া উচিত ভাল হাল্কা মেটারিয়ালের। সুতি, খাদি এই ধরণের জিনিসের তৈরি পোশাক পরুন। আর হাল্কা রঙের পোশাক, যেমন সাদা, হলুদ এই রঙের শেড পরুন। এতে গরম কম লাগে।
২০. স্কিন অনুযায়ী যত্ন নিনঃ
আপনার কোন ধরণের স্কিন সেই অনুযায়ী স্কিনের যত্ন নিন। নর্মাল স্কিন হলে আগে ক্লিনসিং করুন, তারপর একটা ভাল সিরাম আর ময়েশ্চার ব্যবহার করুন। এরপর সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন এক্সফোলিয়েট করুন। আর অয়েলি স্কিন হলে ক্লিনসিং করার পর হাল্কা ময়েশ্চার ব্যবহার করুন। ব্লটিং পেপার দিয়ে মাঝে মাঝে মুখ শুকিয়ে নিন। এতে অতিরিক্ত তেল সরে যাবে। বেশি ঘাম যাতে না হয় সেটি দেখুন।
এইভাবে চললে আশা করা যায় এই গরমেও আপনি যথেষ্ট কুল থাকতে পারবেন।
মন্তব্য করুন