পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অন্তর্গত রামপুরহাট পার্শ্ববর্তী এলাকার তারাপীঠ শাক্ত ধর্মাবলম্বীসহ সমস্ত হিন্দুদের কাছেই একটি পুন্য তীর্থস্থান। একান্ন সতীপীঠের অন্যতম তারাপীঠ তান্ত্রিক সাধনা ও মন্দির সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত।
সমগ্র বাংলা জুড়েই কালীর বহুরূপের মধ্যে অন্যতম তারা জটিল বিমূর্ত আঙ্গিকে পূজা পান। গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী এই মন্দিরের লোককথা বহুল প্রচারিত এবং কিছু ক্ষেত্রে আজও রহস্যাবৃত। ফলে এই তারাপীঠকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ,কৌতূহলের সীমা নেই।
নানা কীর্তির সাক্ষী তারাপীঠ
সাধক বামাখ্যাপার গল্প
- তারপিঠের অপর এক আকর্ষণ হলো পূজারী সাধক বামাখ্যাপা। যিনি একাধারে পাগল সন্ন্যাসী ও শ্মশানে তন্ত্রসাধনায় ব্রতী হয়ে ছিলেন।
- মন্দিরের কাছেই তার আশ্রম রয়েছে যেখানে ভক্তদের নিয়মিত ঢল নামে। কথিত আছে, এই বামচরণ এই মন্দিরে সাধনা করেই সিদ্ধি লাভ করেন ও বহু অসাধ্যসাধন করেন।
- মা তারার উদ্যেশ্যে নিবেদিত ভোগ নিজেই গ্রহণ করে উনি অন্যান্য সাধকদের বিরাগভাজন ও হন। এই সমস্ত নানা কীর্তির সাক্ষী তারাপীঠ।
দেবীর কলকুন্ডলিনী শক্তির রূপ
- জনচিত্তে একথা অনেকদিন থেকেই প্রচলিত যে সতীর তৃতীয় নয়ন এখানে পড়েছিল যদিও এ ঘটনার কোনো পৌরাণিক ভিত্তি নেই। তারাপীঠকে সতী পিঠের একটি বলে মানা হয়।
- তবে কাহিনীটিকে প্রতীকী ধরলে সহজেই বোঝা যায় তারাপীঠ এক মহাশক্তির আরাধনা ক্ষেত্র। দ্বারকা নদের তীরে অবস্থিত তারাপীঠ স্বমহিমায় স্থিত।
- উত্তরবাহিনী জলস্রোত দেবীর কলকুন্ডলিনী শক্তির রূপ। তাই এইদিক থেকে বিচার করলে এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিপুল।
- মন্দিরের স্থাপত্যের মধ্যেও ধরা হয়েছে বাংলার নিজস্ব ঘরানার ছাপ যা চালা রীতির নির্মান শিল্পকেই ব্যক্ত করে।
দ্বিতীয় মহাবিদ্য
- এবার আসা যাক তারাপীঠ এর কিছু গা ছমছমে ও মাহাত্ম যুক্ত কিংবদন্তিতে।
- তন্ত্রে তারাকে বলা হয়েছে দ্বিতীয় মহাবিদ্য। শিবের ওপরে বামপদ তুলে তিনি দাঁড়িয়ে, তাঁর গায়ের রং নীল, লালজ্বিহা এবং মুন্ডমালিনি শোভিত।
- দেবীর কটিদেশ ব্যাঘ্রচর্মে আবৃতা, মাথায় রয়েছে পঞ্চমুদ্রা সমন্বিত একজটা যা রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি বিজয়জ্ঞান এর প্রতীক। জটাশীর্ষে রয়েছে অক্ষভ্য বা মহাদেব।
- দেবীর পাদপদ্ম আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। দেবীর বাস যেহেতু শ্মশানে তাই সেখানে চিতাগ্নিরূপে অবস্থান করেন তারা মা, সাথে থাকেন যোগিনী ডাকিনিরা।
- বহুমানুষ অমাবস্যার রাতে দূর থেকে এই জ্যোতি দেখতে পান।
- কথিত আছে এর কাছাকাছি গেলে দেবী রুষ্ট হন।
সমুদ্রমন্থনের কাহিনী
- তারাপীঠ এর আরেক কাহিনী হলো সমুদ্রমন্থনের সময় যখন সমুদ্রের বুক থেকে হলাহল বা বিষ ওঠে তখন তা কণ্ঠে ধারণ করে শিবের তীব্র বিষজ্বালায় ছটফট করতে শুরু করেন।
- সেই সময় দেবী তারা প্রকট হয়ে শিবকে নিজের বুকের স্তন্য পান করান ও তাকে উপশম দেন।
- স্থানীয়মত অনুসারে ঋষি বশিষ্ঠ মায়ের সেইরূপের দর্শন লাভ করেন যা তার অভীষ্ট ছিল। দেবীর দর্শনলাভে ধন্য হয়ে উনি সিদ্ধি লাভ করেন ও তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
- এই বিশ্বাস থেকে আজও বহুমানুষ এখানে নিজেদের মনোবাসনা পূরণ করতে মা এর বেদীতে প্রার্থনা জানান।
পঞ্চমুন্ডের সমাহার
- আরেকটি উল্লেখযোগ্য রহস্য মহাশ্মশান এর বামাখ্যাপার পঞ্চমুণ্ডের আসন।
- এই প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো দেবীর মাথাতেও রয়েছে পঞ্চমুন্ডের সমাহার।
- এখানে পাঁচটি মুণ্ড সাপের, ব্যাঙের, খরগোশের, শিয়ালের এবং মানুষের। বহুযুগ আগে এই আসনে বসেই দেবীকে সন্তুষ্ট করেছিলেন বামচরণ।
- তন্ত্রসাধন বিদ্যায় এই আসনের গুরুত্ব অপরিসীম। বলা হয় এই আসন খুবই জাগ্রত, শুদ্ধচিত্তে এই আসনে একাগ্র ভাবে ভক্তি নিয়ে না বসলে মানুষ উন্মাদ পর্যন্ত হতে পারে। নানা ক্ষতি সহ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
মন্তব্য করুন