সোনাগাছি এলাকায় আপনি যদি কখনও যান, রাস্তাঘাটে খানিক ঘুরে বেড়ান, তাহলে আপনার চোখে পড়তে পারে বেশ কিছু বাড়ির গায়ে লেখা আছে, ‘ইহা ভদ্রলোকের বাড়ি’।
কেন হঠাৎ ওই বিশেষ এলাকাতে কিছু বাড়ির গায়ে আলাদা করে দেগে দেওয়ার প্রয়োজন হল ‘ভদ্রলোকের বাড়ি’ বলে? আসলে ‘ভদ্রলোকের বাড়ি’ বলে দেগে দেওয়ার প্রয়োজন তখনই হয়, যখন আপনার বাড়ির আশেপাশে ‘অ-ভদ্রলোকে’র বাড়ি থাকে।
এই ‘অ-ভদ্রলোক’ আমরা কাকে বলছি? আমরা সকলেই জানি, সোনাগাছি জায়গাটা কিন্তু আসলে যে কারণে বিখ্যাত বা কুখ্যাত, তা হল এই এলাকায় রমরমিয়ে চলে যাকে বলে যৌন ব্যবসা, সেটা।
পৃথিবীর আদিমতম পেশাগুলোর মধ্যে একটি!

তাহলে সোনাগাছির ওই ‘ভদ্রলোকে’রা যা থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখেন তা হল এই ‘যৌন ব্যবসা’, যাকে তাঁরা ‘অ-ভদ্রলোকে’র কাজ বলে মনে করেন। গোটা ভারতে প্রচুর যৌনকর্মী আছেন। যৌনতাকে নিয়ে ব্যবসা, বাজারে পয়সা দিয়ে তাকে স্বেচ্ছায় (অনেকক্ষেত্রেই, তবে কিছু ব্যতিক্রম তো নিঃসন্দেহে আছে) বিক্রি করার ইতিহাস কিন্তু বহু প্রাচীন।
দেহব্যবসা সম্ভবত পৃথিবীর আদিমতম পেশাগুলোর মধ্যে একটাও বটে! ভারত তো বটেই, সেইসাথে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে বড় এই রেড-লাইট এলাকা সোনাগাছিতে কবে যে প্রথম ইতিহাস কথা বলতে শুরু করেছিল সে নিয়ে আজ নানা কাহিনী পাওয়া যায়।
সোনাগাছির প্রথম পথ চলা শুরু
তবে সোনাগাছির পথ চলা প্রথম শুরু হয়েছিল বোধহয় উনিশ শতকেই। গোটা ভারতকেই তখন আস্তে আস্তে দখল করার পথে এগোচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কলকাতা তখন ব্রিটিশরাজের নয়া রাজধানী। নতুন রাজ্য শাসন করার জন্য ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন একদল তরুণ যুবা। তাদের বয়স কম, শরীরে তরুণ রক্ত।
নতুন দেশে এসে তার জৌলুস দেখে তাঁদের তো চক্ষু চড়কগাছ। দেদার ধনদৌলতে শিগগিরই তাদের পকেট ভরে উঠতে লাগল। ফুর্তিতে মন দিলেন তাঁরা। বিবি-বাচ্ছা সবই তো এদিকে ইংল্যান্ডে। কী করবেন? অগত্যা এদেশী কালা নেটিভদের বিধবা মেয়েগুলোকে ধরে ধরে আনতে লাগলেন সোনাগাছিতে (তখনও অবশ্য সোনাগাছি ‘সোনাগাছি’ হয়নি)।
কলকাতা শহরে বেশ্যাবৃত্তির বোধহয় সেই শুরু। কেউ কেউ বলেন অবশ্য ওই যে পূবে কর্ণওইয়ালিস স্ট্রিট ও পশ্চিমে চিতপুর—তার মধ্যিখানের গোটা জায়গাটা নিয়ে যে বেশ্যাদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল, সেই জায়গাটা কিন্তু আদতে নাকি ছিল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের।
জমিদার ‘বাবু’র উদ্যোগেই নাকি শুরু হয়েছিল সোনাগাছির ব্যবসা
কলকাতা শহরের বিখ্যাত বড়োলোক ‘বাবু’দের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর ও স্থানীয় কয়েকজন ধনী জমিদার ‘বাবু’র উদ্যোগেই নাকি শুরু হয়েছিল সোনাগাছির ব্যবসা। সানাউল্লাহ নামে এক মুসলমান সাধুবাবার নামে তারপর একসময় জায়গাটার নাম হয় ‘সোনাগাছি’ ও সেই নামেই আস্তে আস্তে সোনাগাছি ‘সোনাগাছি’ হয়ে ওঠে।
সেকালের বাবুদের বারবনিতা-বিলাস নাকি ছিল রীতিমতো একটা ব্যাপার। তারপরে সোনাগাছির এলাকা ক্রমাগত বেড়েছে। ভারতে যৌনব্যবসা আইনমতে নিষিদ্ধ হলেও কিছুদিন আগের এক হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১৪০০০ যৌনকর্মী সোনাগাছিতে কাজ করেন। প্রতিবছর প্রায় ১০০০ জন মেয়ে এই ব্যবসায় নতুন যোগ দেন। সম্প্রতি আপনারা দেখেছেন সোনাগাছির যৌনকর্মীরা নিজেদের উদ্যোগে তাঁদের এলাকায় দুর্গাপুজোও করছেন।
কিভাবে কাটে তাঁদের জীবন?
কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলোয় কিভাবে কাটে তাঁদের জীবন? যৌনকর্মীর এই ভয়ঙ্কর জীবন কি তাঁরা নিজেরা স্বেচ্ছায় বেছে নেন, নাকি বাধ্য হন? টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে কাউকে কাউকে বাধ্য করা হলেও বেশীরভাগই কিন্তু এখানে স্বেচ্ছায় আসেন। নিজের ইচ্ছেতেই সাহস করে তাই যারা বেছে নেন যৌনকর্মীর মতো কষ্টের, লাঞ্ছনার জীবনকে, তাঁদের তাই আমাদের কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় থাকে না!
হোক না কষ্টের জীবন, কিন্তু এখানে এসেই সমাজের অর্থনৈতিক স্তরে নীচের দিকে থাকা অনেক মেয়েই ‘স্বাধীনতা’র স্বাদ পায়। স্বাদ পায় টাকার, এবং সেই টাকায় জীবনকে তারা একভাবে নিজের ইচ্ছেয় চালাতে পারে। কেউ বা হয়তো পারিবারিক পরম্পরাতেই ছোট থেকেই স্থির করে নেন এই পেশাতে আসার কথা।
যৌনকর্মীর শরীরেই বাসা বেঁধে আছে এইচ.আই.ভি
মায়ের হাত ধরে মেয়েও হাঁটতে শুরু করে বিপদজনক এই রাস্তায়, যে রাস্তায় হয়তো অর্থ আছে, কিন্তু সম্মান নেই। যে রাস্তায় হাঁটলে সমাজে ‘ভালো মেয়ে’ হবার রাস্তা তার কাছে বন্ধ হয়ে যায় চিরদিনের মতই। তাই এই রাস্তায় হাঁটা মানে যেমন একভাবে স্বাধীনতার শুরু, তেমনই একভাবে স্বাধীনতার শেষও বটে!
দিনের মধ্যে ৬-৭ জন বা তারও বেশী খদ্দেরের দৈহিক চাহিদা মেটাতে মেটাতে ক্লান্ত হয়ে যায় যখন সে, তখনই হয়তো আবিস্কার করে মারণ রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় তাই বলে সোনাগাছির প্রায় ৫ শতাংশ যৌনকর্মীর শরীরেই বাসা বেঁধে আছে এইচ.আই.ভি বা এইডসের মতো মারণ রোগ।
যৌনব্যবসা ভারতে নিষিদ্ধ
আর আগেই বলেছি যৌনব্যবসা ভারতে নিষিদ্ধ। তাই যৌনকর্মীদেরও কাজ করতে হয় লুকিয়ে। যদিও শহরের প্রায় মাঝখানে বেড়ে ওঠা সোনাগাছিকে দেখলে মনে হয়না সে কথা। তাই সহজেই বোঝা যায় আইন থাকলেই আইনের ফাঁকও থাকে। বোঝা যায় যে আসলে সর্ষের মধ্যেই থাকে ভূত। সবজায়গায়, সবকালেই। তাই গুগল ম্যাপে সোনাগাছির অস্তিত্ব না দেখালেও সোনাগাছির ব্যবসা চলতে থাকে রমরমিয়ে।
খদ্দের ‘লক্ষ্মী’ হয়, তাঁদের মনতো যোগাতে হবেই
যৌনব্যবসার আড়ালে চলতে থাকে আরও নানা বেআইনি ব্যবসা। আর গোটা কলকাতাকে নিজের মতো করে ‘বিনোদন’ জুগিয়েও তাই সোনাগাছিকে থেকে যেতে হয় ব্রাত্য, গোপন। গোটা কলকাতার মানুষদের থেকে প্রায় দ্বিগুণ দামে তাঁদের কিনতে হয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। গলি, তস্য গলির মধ্যে দিনের পর দিন কাটিয়ে যেতে হয় একচিলতে স্যাঁতস্যাঁতে একটা ঘরে, খদ্দেরের অপেক্ষায় ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষে চড়া মেকআপ করতে হয় দিনের বেলাতেও। প্রয়োজন—কারণ খদ্দের ‘লক্ষ্মী’। তাঁদের মনতো যোগাতে হবেই।

শোনা যায় সোনাগাছিতে গেলেই নাকি প্রশ্ন করা হয় ‘খাটে না চটে?’ খদ্দের ‘খাট’ চান নাকি ‘চট’ সেই বুঝে তারপর শুরু হয় দরদাম—২০০ থেকে ১০০০—ফুর্তি যত বাড়ে, রেটও বাড়তে থাকে ধাপে ধাপে।
তবে আজকাল যৌনকর্মীদের সন্তানদের অনেককেই সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা করে তাদের অনেককে লেখাপড়াও শেখানো হচ্ছে।
এখানে somossa hoy na..