ভাবুন তো একবার চোখ বন্ধ করে! একটা ছোট্ট বাচ্ছাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটা ছোট্ট ঘরে, তারপর সামনের পুকুর থেকে তাকে স্নান করিয়ে আনা হচ্ছে, স্নান হয়ে গেলে কালীমূর্তির সামনে বসে চোখ বন্ধ করে যখন সে নমস্কার করছে, তখনই পিছন থেকে খাঁড়াটার কোপ পড়ল তার ঘাড়ে, মাথাটা গড়াগড়ি যেতে লাগল মাটিতে, রক্ত আর রক্তে ভেসে গেল গোটা জায়গাটা। কি! শিউরে উঠছেন তো?
ভাবতে পারছেন যদি কখনো এমন ঘটনা আপনাদের ওই ছোট্ট সন্তানটির সঙ্গে হয়! না না, ভয় দেখাচ্ছি না। কিন্তু, আজকের এই ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট লুকের যুগেও আমাদেরই চারপাশে শিশুকে বলি দেওয়া হচ্ছে। কেন? কারণ এতে নাকি মা কালী খুশী হবেন। আসুন, আজ আপনাদের এমনিই কিছু নারকীয় ঘটনার সামনে দাঁড় করাই যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে প্রদীপের নীচে অন্ধকারটা ঠিক কতটা ঘন!
কপালকুন্ডলারা আজও বেঁচে আছে
হ্যাঁ, অবাক হবেন না। ভাবতে পারেন সামান্য একটা মোবাইল ফিরে পেতে আমার-আপনার মতোই একজন মানুষ এক বাচ্ছা মেয়েকে বলি দেওয়ার কথা ভাবে! ঘটনাটি ঘটেছে আসামের রতনপুরের এক গ্রামে। সেখানে এক বাচ্ছা মেয়ের হাত থেকে মোবাইল ফোন চুরি যাওয়ায় তার বাবা পুলিশের দ্বারস্থ না হয়ে চলে যান এক তান্ত্রিকের কাছে এই বিশ্বাস নিয়ে যে, পুজো করেই হয়তো ফোন পাওয়া যাবে! আর এই পুজোর মূল উপকরণ বড়ই মহার্ঘ্য। তার জন্য একটা চার বছরের মেয়েকে, নাম সুনু, তাকে এনে বলি দিয়ে তার হাত টুকরো টুকরো করে কেটে দেবী কালীর কাছে দেওয়া হয়, এতেই নাকি মা তুষ্ট হবেন। কয়েকদিন পর সুনুর ক্ষতবিক্ষত দেহ পায় গ্রামবাসী ও ওই তান্ত্রিক আর সেই লোকটাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঘটনাটা খুব পুরনো নয়, ২০১৬ সালের নভেম্বর নাগাদ। আমার তো এটা পড়তে পড়তে কপালকুন্ডলার কথাই মনে হচ্ছিল। আরও যে কত মেয়ে বা শিশু এই ভন্ড কাপালিক বা তান্ত্রিকদের মিথ্যা সাধনার জন্য শেষ হয়ে যাবে, উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হয়েই থেকে যাবে, কে জানে!
মা নাকি রক্তে খুশী!!
হ্যাঁ, এমনই বিশ্বাস এই ভন্ড কাপালিক বা তান্ত্রিকদের। এই ঘটনাটিও আসামেরই, শোণিতপুর জেলার রাঙ্গাপাড়া তারাজুলি চা বাগানের। সেখানে ছয় বছরের এক শিশু সনাতন বাগকে গলা কেটে মায়ের সামনে উৎসর্গ করে তান্ত্রিক নানু মির্ধা। খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা আসেন ও ওই তান্ত্রিককে পিটিয়ে মেরে ফেলেন। পরে পুলিশ এসে ওই তান্ত্রিকের মৃতদেহ নিয়ে যায়। ঘটনাটি ২০১৫ সালের। আমাদের একবার ভাবতে ইচ্ছে করে, যে দেবীকে এরা জগজ্জননী বলে, তার সামনেই কীভাবে এই বলি তারা দিতে পারে! তাই চিনে নিন এই ভন্ডদের আসল উদ্দেশ্য পূরণমূলক মুখটি আর সতর্ক হোন।
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
উড়িষ্যার ঘটনা বলি এবার। সেখানে দামোদরপুরের বাসিন্দা আট বছরের শ্রীকান্ত বাগকে হত্যা করে তান্ত্রিক পীতাম্বর গাইপেই। পুলিশের চার্জশিট থেকে জানা যায় যে, ওই ছেলেটিকে চকোলেটের লোভ দেখিয়ে নিজের আখড়ায় নিয়ে আসে ওই তান্ত্রিক। সেখানে বলি দিয়ে মৃতদেহটি মাটি চাপা দিয়ে দেয় সে। পরে জানাজানি হলে ধরা পড়লে স্থানীয় জেলা আদালত তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন। এই ঘটনাটিও মাত্র এই সেইদিনের, ২০১০ সালের।
স্বার্থপরতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত
কথায় বলে, “পরের ছেলে পরমানন্দ, যত উচ্ছন্নে যাবে তত আনন্দ”। কিন্তু, যদি পরের ছেলেকে নিজের স্বার্থেই কেউ শেষ করে দেয়! ঘটনাটি ঘটেছে নেপালের কুদিয়া গ্রামে। অনেকদিন ধরেই অসুস্থ কোদাই হরিজনের ছেলে। ডাক্তার কিন্তু দেখানো হয়নি, করা হয়েছে ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাক। এতে কোনো লাভ হয়নি অবিশ্যি। এরপর কোদাই চলে যায় এক ওঝার কাছে যে এক মহান পরামর্শ দেয়। সে বলে ছেলে বেঁচে যাবে, যদি দেবীর সামনে এক শিশু বলি দেওয়া হয়। কথা মতো দশ বছরর বয়সী জীবন কোহারকে খেলার মাঠ থেকে ভুলিয়ে নিয়ে এসে বলি দেয় কোদাই। ভাবুন খালি, একজন মানুষ কতটা স্বার্থপর ও অন্ধ হলে তবে তারই ছেলের মতো একজনকে খুন করতে পারে। তিনদিন পর বাড়ীর লোক এক ঝোপ থেকে জীবনের মৃতদেহ পায়।
এইসব পড়তে পড়তে খুব শরৎচন্দ্রের ‘লালু’ গল্পের কথা মনে আসছিল। লালু যেমন পাঁঠা বলি দিতে দিতে উন্মত্ত হয়ে শেষে মানুষকেই ধরে বলি দিতে যাচ্ছিল প্রায়, আর এভাবেই বলি বন্ধ করে, আমাদেরও এবার এই অন্ধবিশ্বাস ও বলি নামের ভয়ানক প্রথার বিরুদ্ধে উন্মত্তের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। শেষ পর্যন্ত বিষ ছাড়া কিন্তু বিষক্ষয় হয় না। আর যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন না হয় নিজেদের সভ্য বলে কলার উঁচু নাই বা করলাম!
মন্তব্য করুন