শান্তিনিকেতন একটি ছোট শহর। এটি বীরভূম জেলায় অবস্থিত। ভৌগোলিক বিবরণ শুধু এটি। তাই এই পরিচয় দিলেও শান্তিনিকেতন কিন্তু আসলে অন্য পরিচয় বহন করে। শান্তিনিকেতন জুড়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার অসামান্য কিছু কর্ম কান্ড। এই ছোট শহরটি সাহিত্য এবং সংস্কৃতির এক অসাধারণ মেলবন্ধন। প্রতি বছর দেশ এবং বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে এখানে। জ্ঞান পিপাসু এবং ভ্রমণ পিপাসু এই দু ধরণের মানুষকেই এই শহর বরাবর আকর্ষণ করে এসেছে। বর্তমান সময়ে শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ,শিক্ষা ,সংস্কৃতি সব মিলিয়ে এই শহর ইন্টেলেক্চুয়াল এবং রোমান্টিক বাঙালীকে বার বার আকর্ষণ করে এসেছে। আসুন জেনে নিএই শহরের আরো কিছু কথা।
এই শহরটি শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠার আগে কিন্তু অন্য নামে পরিচিত ছিল। কুখ্যাত ডাকাত ভুবন ডাকাতের নামে এই শহরটির নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। সময় টা তখন ১৮৬২ , মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের আশ্রম স্থাপন করার জন্য একটি উপযুক্ত জায়গা খুঁজছেন। এমত অবস্থায় রায়পুরে বন্ধু স্থানীয় জমিদারের বাড়িতে থাকাকালীন একদিন ভ্রমণকালে এই স্থানটি তার উপযুক্ত বলে মনে হয়। ১৮৬৩ সালে তিনি আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্থানটির নাম করন করেন শান্তিনিকেতন।
ঠিক ৪০ বছর পরে ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠভবন প্রতিষ্ঠা করেন। এই পাঠভবন তৎকালীন শিক্ষাচর্চার ধারাকে ভেঙে দেয়। শিক্ষাকে তিনি চার দেওয়াল থেকে বের করে প্রকৃতির সন্নিবেশে নিয়ে আসেন। শুধু মাত্র পাঁচজন ছাত্র এবং পাঁচজন শিক্ষককে নিয়ে এই স্কুল শুরু হয়। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার পর তিনি এটিকে মহা বিদ্যালয়ে পরিণত করেন। যা এখন বিশ্বভারতী নামে সবার কাছে পরিচিত। বর্তমানে এই মহাবিদ্যালয় শিক্ষার পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, এখানে ছাত্র ছাত্রীরা প্রকৃতির সংস্পর্শে নিজেদের আবিষ্কর করে।
পাঠ ভবনের পর মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা,সন্তোষ পাঠশালা ,শিক্ষা শাস্ত্র ,উত্তর শিক্ষা সদন এগুলিকে বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া দর্শন ভবন ,সঙ্গীত ভবন,চীনা ভবন,কলা ভবন শিল্প সদন ,রবীন্দ্র ভবন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দীর্ঘ দিন ধরে দেশ ও বিদেশের জ্ঞান পিপাসু মানুষ এখানে আসেন এবং নিজেদের জ্ঞানের ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করেন। ইন্দিরা গান্ধী , অমর্ত্য সেন, নন্দলাল বসু সত্যজিৎ রায় এছাড়া আরো অনেক নামি মানুষ এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাথে জড়িত।
আগেও বলেছি যে পর্যটন স্থান হিসেবেও এর জনপ্রিয়তা কম নয়। খোয়াইয়ের এর ঘাট বহুকাল ধরেই রোমান্টিক বাঙালীকে আকর্ষণ করে আসছে। এছাড়া বল্লভপুর ওয়াইল্ডলাইফ পার্ক ,ছাতিমতলা ,রবীন্দ্র মিউসিয়াম ,সোনাঝুরি, নন্দন আর্ট গ্যালারি ,আমারকুটির -এগুলি প্রত্যেকটি শান্তিনিকেতনের আকর্ষণকে বাড়িয়ে তোলে।
শান্তিনিকেতনের আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে তোলে পৌষ মেলা, বসন্ত উৎসব ,জয়দেব কেঁদুলির মেলা। বহু পর্যটকের সমাগম ঘটে এই উৎসবে। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির অভূত পূর্ব সমন্নয় ঘটে এই মেলাগুলিতে। পৌষ মেলা শীতকালে হয়। এই মেলায় বিভিন্ন প্রাদেশিক নৃত্য, লোক সঙ্গীত, কুটির শিল্প, হস্থ শিল্প ,পিঠে পায়েস সব মিলিয়ে তিনদিন সময় যেন নিমেষে ফুরিয়ে যায়। বসন্ত উৎসব হলো রঙের উৎসব। এইসময় পলাশ ফুলের মতো প্রকৃতি ও রাঙিয়ে ওঠে। জয়দেব কেঁদুলির মেলায় বরাবর সঙ্গীত পিপাসু ,মানুষকে আকর্ষণ করে আসছে। বাউল ফকির লোকসংগীত সব মিলিয়ে আমাদের উদাস করে তোলে।
সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে রোজকার দৌড়ঝাঁপ ,উদ্বিগ্নতা,মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে শান্তিনিকেতন আদর্শ। তাই প্রকৃতির ছায়ায় এবং শান্তির নীড়ে কিছুদিন কাটিয়েই আসুন।
মন্তব্য করুন