“মানুষ মানুষেরই জন্যে,জীবন জীবনের জন্যে” বিখ্যাত সেই গানের এই জনপ্রিয় প্রথম লাইনটিতে হয়তো অনেকেই আস্থা রাখেন, চানও হয়তো অনেকেই স্বক্রিয়ভাবে মানুষের সেবা করতে? কেমন হয় যদি আপনার এই ইচ্ছেকেই আপনি নিজের পেশা করে নিতে পারেন? হ্যাঁ,ঠিকই ধরেছেন নার্সিং এ চাকরির কথাই বলছি।
আর তা ছাড়া কোনও সরকারী হাসপাতালে যদি ভবিষ্যতে এই চাকরি জুটিয়ে নিতে পারেন, তাহলে যাবতীয় সরকারী সুযোগ সুবিধাও আপনার মুঠোয়। তা আপনি আপনার স্কুলের পড়াশুনো শেষ করার পর যখন কোনো বিষয় নিয়ে পড়বেন বলে ভাবছেন, ঠিক তখনই আপনার জন্য রয়েছে নার্সিংকে ভবিষ্যত পেশা হিসেবে বেছে সেটা নিয়ে পড়াশুনো শুরু করার সুবর্ণ সুযোগ। কীভাবে? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
বৈধতা বিষয়ে সচেতন থাকুন
আপনাকে নার্সিং’এর চাকরিকে বেছে নিতে হলে কিছু কোর্সের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।ভারতে যে প্রতিষ্ঠানগুলি নার্সিং কোর্সগুলিকে পরিচালনা করে, সেগুলির প্রত্যেকটিরই আই.এন.সি বা ইন্ডিয়ান নার্সিং কাউন্সিলের বৈধতা থাকতে হবে।
ভারত সরকারের মিনিস্ট্রি অফ হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ারের অন্তর্ভুক্ত একটি স্বশাসিত স্বংস্থা, যারা ভারতব্যাপী নার্সিং কোর্সগুলি পরিচালনা করে। সরকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারী কিছু প্রতিষ্ঠানেও এখন নার্সিং এর বিভিন্ন কোর্স করানো হয়। তাই ভর্তি হওয়ার আগে আই.এন.সি-র এই বৈধতা বিষয়ে সচেতন থাকুন।
এবারে আসুন দেখে নিই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের গন্ডি পেরনোর পর কোন নার্সিং কোর্সগুলির জন্য আপনি আবেদন করতে পারেন।
অকজিলারি নার্স অ্যান্ড মিডওয়াইফ বা এ.এন.এম (Auxiliary Nurse Midwifery; ANM)
দেড় থেকে দুই বছরের এই ডিপ্লোমা কোর্সের জন্য আবেদন করতে হলে আপনার কমপক্ষে বয়স হওয়া প্রয়োজন ১৭ বছর। ৩৫ বছর বয়স অবধি এই পদের জন্য আবেদন করা যেতে পারে। শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে উচ্চমাধ্যমিকে কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করলেই আপনি এই কাজের জন্য আবেদন করতে পারবেন।তবে এই কোর্সে সুযোগ পেতে হলে আপনাকে শারীরিক দিক দিয়ে যথেষ্ট সুস্থ থাকতে হবে। কেননা, আপনাকে আবেদনের পর একটি মেডিকেল টেস্টও পার করতে হবে।
আর এমনিতে কিছু প্রতিষ্ঠান আলাদা করে প্রবেশিকা পরীক্ষার নিয়ম করলেও অনেক প্রতিষ্ঠানেই উচ্চমাধ্যমিকের নম্বর ও ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমেই মেধাতালিকা প্রস্তুত করা হয়। এক্ষেত্রে থিয়োরি ক্লাসের তুলনায় প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে হাতেকলমে কাজ শেখার ব্যবস্থাই বেশি থাকে। কোর্সটি করার জন্য খরচ হতে পারে পঁচিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা।
জেনারেল নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফেরি বা জি.এন.এম (General Nursing and Midwifery)
বয়সসীমা সতেরো থেকে পঁয়ত্রিশ বছর। তবে আপনার যদি এ.এন.এম ডিগ্রি ইতিমধ্যেই করা থাকে, তাহলে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই কোনও বয়সসীমা মানা হয় না। শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে উচ্চমাধ্যমিকে ৪০ শতাংশ নম্বর থাকতে হবে। তবে এক্ষেত্রে উচ্চমাধ্যমিকে আপনার সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনো করা বাধ্যতামূলক।
এই কোর্সটির মোট সময়সীমা সাড়ে তিন বছর। এর মধ্যে শেষের ছয় মাস কোনও হাসপাতালে থেকে ইন্টার্নশিপ করা আবশ্যিক। এই কোর্স করা জেনারেল নার্সদের রাজ্য নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশনও থাকে। এই কোর্স করলে আপনি সরকারী হাসপাতাল বা বেসরকারী নার্সিংহোমে দশ থেকে চব্বিশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেতে পারেন।
বি.এস.সি নার্সিং (Bachelor of Science in Nursing)
বি.এস.সি অর্থাৎ ব্যাচেলার অফ সায়েন্স। মানে বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই ৪৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ কমপক্ষে যোগ্যতা হলেও বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া আবশ্যিক এক্ষেত্রে। কোর্সটির সময়সীমা চার বছরের। তবে আপনি যদি জি.এন.এম হন, তাহলে আপনার পোস্ট বেসিক বি.এস.সি নার্সিং’এর কোর্সের সময়সীমা কমে দাঁড়াবে দুই থেকে তিন বছর। কিন্তু এই ডিগ্রি কোর্সটি করার জন্য আপনাকে বসতে হবে প্রবেশিকা পরীক্ষায়।
প্রতি বছর এপ্রিল-জুন মাস নাগাদ এই পরীক্ষা হয়ে থাকে। দুই ঘন্টায় ৪০০ নম্বরের এই পরীক্ষায় প্রশ্ন হয়ে থাকে অবজেকটিভ ধরণের। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে মেডিকাল টেস্টের মাধ্যমে আপনি কোর্সটি করার সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখাও জরুরী।
ক্লাসরুমে থিয়োরি ক্লাসের পাশাপাশি হাসপাতালে গিয়ে হাতেকলমে কাজ শেখার সুযোগ তো থাকবেই, পাশাপাশি শেষ বছরে হাসপাতালে ইন্টার্নশিপও বাধ্যতামূলক এই কোর্সে। ডিগ্রি কোর্সগুলি করে কেস ম্যানেজার, সার্টিফায়েড নার্স মিডওয়াইফ, ক্লিনিকাল নার্স স্পেশালিস্ট, নার্স অ্যানাস্থেটিস্ট, নার্স এডুকেটর, স্টাফ নার্স ইত্যাদি পদে চাকরি পাওয়া যেতে পারে। বারো হাজার টাকা থেকে ছাব্বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতনের চাকরি পাওয়া সম্ভব একজন বি.এস.সি নার্সের।
অন্যান্য কোর্স
এই কোর্সগুলি করার পর আপনি পেতে পারেন মোটা বেতনের চাকরি। অথবা আপনি যদি আরও চান আপনার পড়াশুনোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাহলে এই বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগও রয়েছে।
এম.এস.সি নার্সিং (Master of Science in Nursing)
দুই বছরের এই কোর্সে কমপক্ষে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে বি.এস.সি নার্সিং’এ ৫৫ শতাংশ নম্বর লাগে। একটি কমন এন্ট্রান্স টেস্টে বসতে হয়। সেটিতে পাশ করলে তবেই এই উচ্চশিক্ষার দরজা আপনার কাছে খুলে যাবে। এই কোর্স একবার করে নিতে পারলে উচ্চপদের নার্সের চাকরি পাওয়ার সুযোগো থাকছে আপনার কাছে, যেমন- নার্সিং ইন চার্জ, ক্লিনিকাল ইন্সট্রাকটর, নার্সিং এক্সিকিউটিভ,অ্যাসিস্ট্যন্ট নার্সিং সুপারিটেন্ডেন্ট, নার্সিং সুপারভাইসার, মেডিক্যাল অ্যাডভাইসার ইত্যাদি। এক্ষেত্রে আপনার মাসিক বেতন হতে পারে আশি হাজার টাকা অবধি। তা ছাড়াও আপনি নার্সিং’এর ক্ষেত্রে নার্সিং টিউটরের মতো শিক্ষকতার চাকরিকেও বেছে নিতে পারেন। আর হ্যাঁ,এম.এস.সি করে নিলে আপনার সামনে থাকবে পি.এইচ.ডি করার সুযোগ। অর্থাৎ আপনি চাইলে উচ্চশিক্ষাও জারি রাখতে পারেন।
এম.ফিল.ইন নার্সিং এলিজিবিলিটি (Master of phiosophy in Nursing)
রিসার্চ, কেস অ্যানালিসিস, কেস রিপোর্ট প্রস্তুত করা, সার্ভে কন্ডাক্ট করা, ডেটা অ্যানালিসিস,ডেটা ইন্টারপ্রিটেশন ইত্যদির মধ্যে দিয়ে আরও গভীর পড়াশুনো করতে চাইলে এম.ফিল নার্সিং আপনি চাইলে করতেই পারেন। তবে তার আগে আপনাকে বাধ্যতামূলকভাবে ৫৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে এম.এস.সি নার্সিং পাশ করতে হবে। এই কোর্সের সময়সীমা দুই বছর। নার্সিং নিয়ে গবেষণামূলক উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ থাকলে এই লক্ষ্যে এগোতেই পারেন।
পি.এইচ.ডি ইন নার্সিং (Phd in Nursing)
পি.এইচ.ডি’তে আবেদন করার জন্য এম.এস.সি নার্সিং অথবা এম.ফিল নার্সিং ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। এম.এস.সি নার্সিং ডিগ্রি থাকলে সেখানে আপনাকে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ নম্বর রাখতে হবে। এরপর একটি এন্ট্রান্স টেস্টে বসে সেখানে কমপক্ষে ৫৪ শতাংশ নম্বর পেলে তবেই আপনি পি.এইচ.ডি করার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
এবারে আসুন দেখে নিই কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের নাম, যেখানে আপনি নার্সিং বিষয়ে পড়াশুনোর জন্য আবেদন করতে পারেন।
১.অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ
ঠিকানা- ১১০ চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ,কলকাতা।
যোগাযোগ- ০৩৩ ২২৪১ ২৮৮৮,০৩৩ ২২৪১ ২৫৩৯
২.ইন্সটিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যেজুয়েট মেডিকাল এডুকেশন এন্ড রিসার্চ
ঠিকানা- ২৪৪ এ জে সি বোস রোড,কলকাতা।
ঠিকানা- ০৩৩ ২২৩৫১৮১
৩.স্কুল অফ নার্সিং কলকাতা, নার্সিং ট্রেনিং স্কুল
ঠিকানা- এস.এস.কে.এম হসপিটাল ক্যাম্পাস,কলকাতা।
যোগাযোগ- ০৩৩ ২২২ ৩৯৮৯৬
৪.ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কলেজ অফ নার্সিং
ঠিকানা- ২৪৪ এ.জে.সি.বোস রোড ,কলকাতা।
যোগাযোগ- ০৩৩ ২২২ ৩৯৮৯৬
৫.অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকাল সায়েন্স (এইমস),দিল্লি
আনসারি নগর,অরবিন্দ মার্গ,দিল্লি।
যোগাযোগ- ০১১ ২৬৫৮৮৫০০,০১১ ৮৬৫৮৮৯০০
৬.অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকাল সায়েন্স (এইমস),রায়পুর
এন.এইচ – ৬,তাঁতিবাঁধ,রায়পুর,ছত্তিশগড়।
যোগাযোগ- ০৭৭১ ২৫৭৩৭৭৭
৭.আর্মড ফর্সেস মেডিক্যাল কলেজ,এ.এফ.এম.সি
পুনে,মহারাষ্ট্র।
যোগাযোগ- ০২০ ২৬৩৬৩৩০১
৮.আর্য্যভট্ট নলেজ ইউনিভার্সিটি – এ.কে.ইউ
চাণক্য ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস,মিঠাপুর বাস স্ট্যান্ডের কাছে,মিঠাপুর,পাটনা,বিহার।
যোগাযোগ- ০৬১২ ২৩৫১৯১৯,০৬১২ ২৩৬২২৭০
৯.খ্রীষ্টান মেডিক্যাল কলেজ,ভেলোর
ইডা স্কুড্ডের রোড,তামিলনাডু,-৬৩২০০৪
যোগাযোগ- ০৪১৬ ২২৮ ১০০০
সারা ভারতব্যাপী এমনই আরও বহু প্রতিষ্ঠানে নার্সিং এর কোর্স করানো হয়। ফলে চেষ্টা করলে চাকরি, উচ্চশিক্ষা এই সমস্ত কিছুকেই আপনি মানুষের সেবা করার মধ্যে দিয়ে মেলাতে পারেন। উচ্চমাধ্যমিকের পরে তাই এবারে ইচ্ছে থাকলে নার্সিং নিয়ে পড়াশুনোর সুযোগ হাত ছাড়া করবেন না। “জীবে প্রেম” অটুট রাখুন, স্থির রাখুন লক্ষ্য, সাফল্য আসবেই।
মন্তব্য করুন