আপনার এখন যা বয়স, সেই বয়সে আপনার ঠাকুমা বা দিদিমা কেমন দেখতে ছিলেন সেটা আপনি ফ্যামিলি অ্যালবামে নিশ্চয়ই দেখেছেন। আচ্ছা, ঠাকুমা বা দিদিমা ছাড়ুন, আপনার মা কেমন দেখতে ছিলেন একটু দেখুন তো ছবিগুলো উল্টেপাল্টে। দেখবেন আপনি এই বয়সে যতটা সুন্দর আর ফ্রেশ দেখতে লাগেন, ওনারা তার থেকে অনেক বেশি হেলদি ছিলেন স্কিনের দিক থেকে।
আপনারা বলবেন, এ তো জানা কথাই। তখন এতো দূষণ ছিল না, আর ওনাদের আমাদের মতো এতো বাইরে গিয়ে কাজও করতে হত না। সবই মানছি। কিন্তু, একবার ভেবে দেখুন এসবের পরেও একটা এক্স ফ্যাক্টর ছিল তাঁদের রূপচর্চার মধ্যে যা আজও তাঁদের গ্ল্যামারাস করে রেখেছে। কি জানেন সেই এক্স ফ্যাক্টার? একান্তই প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করা সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে। আর এইসবের মধ্যে প্রধান উপাদান ছিল নিমপাতা আর কাঁচা হলুদ।
কেন ব্যবহার করব নিমপাতা আর কাঁচা হলুদ
দেখুন, সুন্দর ত্বক মানে কিন্তু শুধুমাত্র উজ্জ্বল ত্বক নয়। এর সাথে দরকার হেলদি স্কিন।হলুদ যেখানে আপনার ত্বককে উজ্জ্বল করবে, নিমপাতা সেখানে ত্বকের ওপর একটা শিল্ড তৈরি করবে। নিমের মধ্যে থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণাগুণ আমাদের স্কিনের যে কোনো ইনফেকশন দূর করতে সাহায্য করে।
তাই জন্যই তো পক্স বা ওইরকম কিছু হলে নিমপাতা জলে দিয়ে স্নান করতে বলা হয়।আর আমাদের তো কবে থেকেই ফর্সা হওয়ার গোপন রহস্য হিসাবে কাঁচা হলুদ সকালে খেতে বলা হয় খালি পেটে। তাই নিমপাতা আর কাঁচা হলুদের ওপর চোখ বুজে ভরসা রাখুন আর কীভাবে ব্যবহার করবেন জানুন।
ব্রণ কমাতে
আপনার মুখের ওই ব্রণগুলোর জন্য নিশ্চয়ই আপনাকে মাঝে মাঝে অনেক কথা শুনতে হয়। ব্রণ কমলেও আবার তার দাগটা থেকেই যায়। ওটা অতো সহজে যেতেই চায় না। তাই ব্রণ ও ব্রণর দাগ সরাতে ব্যবহার করুন নিমপাতা আর কাঁচা হলুদের ফেসপ্যাক। এটা অতিরিক্ত ব্রণ হওয়া থেকেও ত্বককে রক্ষা করবে।
উপকরণ
১০-১২টি নিমপাতা, ৩-৪ টুকরো কাঁচা হলুদ।
পদ্ধতি
নিমপাতা পরিমাণমতো নিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিন আগে।এরপর ওর মধ্যে কাঁচা হলুদের টুকরো নিয়ে একসঙ্গে ভালো করে ব্লেন্ড করুন।এবার এই পেস্টটা মুখে ভালো করে লাগিয়ে ২০-২৫ মিনিট অপেক্ষা করুন।শীতকাল বলে এখন ঠান্ডা লাগতে পারে,তাই একটু কম সময়ের জন্য রাখতে পারেন।একটু শুকিয়ে আসলে ভালো করে তুলে ফেলুন নর্মাল জল দিয়ে।এটা দু’সপ্তাহ করুন,দেখবেন ফল পাচ্ছেন।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে
উজ্জ্বল ত্বক কে না চায় বলুন তো! দেখুন সবাই তো ফর্সা হয় না, শ্যামলা অনেকেই হয়।কিন্তু শ্যামলা হোক কি ফর্সা, উজ্জ্বল একটা অন্য ব্যাপার। আমাদের সবারই ওই উজ্জ্বল হতে বড় সাধ। আর এইক্ষেত্রে কাঁচা হলুদের বিকল্প আর কিই বা হতে পারে বলুন।
উপকরণ
নিমপাতা পরিমাণমতো, কাঁচা হলুদ পরিমাণমতো, কয়েক ফোঁটা মধু।
পদ্ধতি
নিমপাতা একটু সেদ্ধ করে নিন। নরম হলে ব্লেন্ড করতে সুবিধা হয়। এর সঙ্গে আলাদা করে বেটে রাখা কাঁচা হলুদ মিশিয়ে নিন। এর মধ্যে এবার মধু দিন। ভালো করে মেশান।এই মিশ্রণটা মুখে আর হাত-পায়ে মেখে রেখে দিন যতক্ষণ না শুকিয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে গেলে আগে ওই নিমপাতা সেদ্ধ করা জলটা দিয়ে ঘষে তুলুন। তারপর নর্মাল জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিনদিন করুন, তাড়াতাড়ি ফল পাবেন।
রোদে পোড়া দাগ দূর করতে
আমরা থাকি গরমের দেশে। সবসময় বাইরে তো বেরোতেই হয়। আর বাইরে যাওয়া মানেই রোদের সরাসরি সংস্পর্শে আসা। সানস্ক্রিন মাখলেও সবসময় উদ্ধার পাওয়া যায় না। ট্যান পড়ে পড়ে স্কিনের তাই বারোটা বেজে যায়। এই পোড়া দাগ দূর করতেও কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা ব্যবহার করুন।
উপকরণ
নিমপাতা কয়েকটা, কাঁচা হলুদের টুকরো, মুলতানি মাটি পরিমাণমতো, লেবুর রস।
পদ্ধতি
সবকটি উপকরণ ভালো করে মেশান। চাইলে লেবুর রস দিতেও পারেন, নাও দিতে পারেন। আসলে লেবুর রস ন্যাচরাল ব্লিচ, তাই দাগ তুলতে সাহায্য করে। এই পেস্টটা মুখে আর যে যে জায়গায় ট্যান হয়েছে, সেখানে লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে তুলে ফেলুন ঠান্ডা জল দিয়ে। তিন সপ্তাহের মধ্যেই ফল পাবেন।
তেলতেলে ত্বক থেকে মুক্তি পেতে
আপনার কি ভালো লাগবে যদি আপনার ত্বক তেলতেলে হয়? জানি লাগবে না।কতকিছুই না করেছেন এই তেলতেলে ভাব দূর করতে। লাভই হয় নি। তাই এবার নিমপাতা আর কাঁচা হলুদের হাত ধরুন।
উপকরণ
১০-১২টা নিমপাতা, কাঁচা হলুদের টুকরো পরিমাণমতো, চন্দনের গুঁড়ো।
পদ্ধতি
সবকটি উপাদান ভালো করে মিশিয়ে নিন। চন্দন তেলতেলে ভাব কমাতে সাহায্য করে।তাই চন্দন ব্যবহার করুন। পেস্টটা ভালো করে মুখে মাখুন। আধ ঘন্টা রেখে পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে নিন। এক সপ্তাহ পর থেকেই পার্থক্য বুঝতে পারবেন।
চোখের নিচের কালো দাগ সরাতে
আপনার ওই সুন্দর চোখের নিচে কালো দাগ মানে চাঁদের কলঙ্ক। এই দাগ তাই সরাতে হবে। তার মধ্যে সামনে আবার পার্টি। আপনি নিশ্চয়ই দোকান থেকে চটজলদি দাগ সরাবার ক্রিম আনবেন। না, ওটি আর করবেন না। নিম আর হলুদ সহজেই দাগ তুলে দেবে, তাড়াতাড়িও।
উপকরণ
নিমপাতা ৪-৫টা, কাঁচা হলুদের টুকরো কয়েকটা।
পদ্ধতি
নিমপাতা সেদ্ধ করে নিন। সেদ্ধ করলে সেই জলে উপকারী উপাদানগুলো মিশে যায় আর এক্ষেত্রে আমাদের জলটাই দরকার। এই জলে এবার কাঁচা হলুদ বাটা মিশিয়ে নিন।এবার জলটা ছেঁকে নিন। এই ছেঁকে নেওয়া জলটা ঠান্ডা করে দিনে দু’বার চোখের নিচে লাগান। লাগিয়ে বাইরে যাবেন না। কয়েকদিন করুন, উপকার পাবেনই।
শীতে রূপচর্চায়
শীতকাল মানেই ত্বকের কিছু অতিরিক্ত যত্ন নিতেই হয়। চামড়া খসখস করা, শুষ্কতা এই সব তো লেগেই আছে। তা আপনারা কি জানেন, নিমপাতা আর কাঁচা হলুদ আসলে ত্বকের শুষ্কতা থেকে বাঁচিয়ে শীতে আপনাকে এক স্মুদ স্কিন দেবে? জানতেন না তো?তাহলে দেখে নিন আজ।
উপকরণ
নিমপাতা ১০-১২টা, কাঁচা হলুদ বাটা, অ্যালোভেরা জেল।
পদ্ধতি
সবকটা উপকরণ ভালোভাবে মেশান।অ্যালোভেরা জেল খুব ভালো করে শুষ্কতা থেকে রক্ষা করে।ভালো হয় যদি বাড়িতে গাছ থাকে,ফ্রেস অ্যালোভেরা পাতা পেয়ে যাবেন।নইলে জেল কিনে আনুন ভালো ব্র্যান্ড দেখে।এবার তৈরি হওয়া পেস্ট মুখে আর হাতে,পায়ে লাগান।শুকিয়ে গেলে তুলে ফেলুন।তারপর কোনো ভালো ময়েশ্চারাইজার ক্রিম মাখুন।দেখবেন মাখনের মতো স্কিন পেয়েছেন এই শীতেও।
নিম আর কাঁচা হলুদের বড়ি
রূপচর্চায় শুধু বাহ্যিক অ্যাপ্লিকেশন যথেষ্ট নয়, ভেতর থেকে সুন্দর হওয়া দরকার। আর তাই দরকার কিছু কিছু জিনিস খাওয়া। আজ তাই নিম আর কাঁচা হলুদের এক বড়ি তৈরি করতে শেখাবো আপনাদের।
উপকরণ
নিমপাতা ২০-২৫টা, ২০০ গ্রাম কাঁচা হলুদের পেস্ট।
পদ্ধতি
নিমপাতা বেটে নিন। এমনভাবে বাটুন যেন আটা মাখার যে লেই তার মতো হয়। এবার ওর সাথে হলুদ বাটা মেশান। ভালো করে দুটো মিলিয়ে ছোট ছোট গোল বড়ির মতো বানান। অন্তত ৪-৫দিন রোদে শুকোতে দিন। যাতে সবদিক রোদ পায় সেটা দেখবেন।এবার এটা মজুত রাখুন হাতের কাছে।নিমের খারাপ স্বাদ দূর করতে মধুও দিতে পারেন।রোজ খালি পেটে খান এই বড়ি। আপনার স্কিন ভেতর থেকে সুন্দর হবে।
তাহলে দেখুন তো, আপনার ত্বকের সার্বিক পরিচর্যায় নিমপাতা আর কাঁচা হলুদ কত্ত উপকারী। এবার থেকে তাহলে বুঝেই দেখুন কেন আমাদের মা-ঠাকুমারা বলতেন সরস্বতী পুজোর দিন সকালে নিমপাতা আর কাঁচা হলুদ বাটা মাখতে। সবই আসলে আমাদের সৌন্দর্য আর প্রকৃতির মেলবন্ধনকেই প্রকাশ করে।
মন্তব্য করুন