সামনেই দুর্গা পুজো আসছে। দুর্গা পুজোয় প্রতিবারের মতো এবারও হয়ত আপনি বেলুড় মঠ যাবেন, বা আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত টিভিতে বসে দেখবেন বেলুড় মঠের দুর্গাপুজো। বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোর অন্যতম সেরা আকর্ষণ কিন্তু থাকে কুমারী পুজো। অষ্টমী তিথিতে সেখানে এই কুমারী পুজো হয়ে থাকে। কুমারী পুজো কী, কেন কুমারী পুজো করা হয়, কী এর ইতিহাস সে সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। পুরাণে, বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থেও কুমারী পুজো হাল হকিকত সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য জানা যায়। আসুন, আজ জেনে নেওয়া যাক কুমারী পুজোর সাতকাহন।
কুমারী পুজো কী
প্রত্যেক বছরই আশ্বিন মাসে বাঙালী দুর্গাপুজো পালন করে। ষষ্ঠী থেকে দশমী—দেবী যখন মর্ত্যে থাকেন, তখন দেবী দুর্গাকে নানা রূপে পুজো করা হয়। কুমারী হল দেবীরই আর এক রূপ, যে রূপ দেবীর সবথেকে বাস্তব রূপও বটে। দেবীকে কুমারী রূপে কল্পনা করে তাঁর পুজো করা অতি প্রাচীন ভাবনা। মহাভারতেও অর্জুনের কুমারী পুজোর কথা পাই। পুরাণেও দেবী চণ্ডিকার কুমারী রূপের কথা আমরা পেয়েছি। বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্রগ্রন্থ থেকে আরও জানা যায় সেখানে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন নারীতেই হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে তিন শক্তির বলে ক্রমাগত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় হচ্ছে, সেই তিন শক্তিই আদতে বীজ আকারে কুমারীর মধ্যে থাকে। এই কারণেই কুমারীতে দেবীভাব কল্পনা করে তাঁকে পুজো করা হয়। শুধু দুর্গাপুজোর সময়তেই নয়, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো ইত্যাদিতে আর কামাখ্যাতেও কুমারী পুজো হয়।
কুমারী কে হতে পারবেন
তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী কুমারী পুজো হল ষোলো বছরের কম মেয়ে যে অরজঃস্বলা ও অবিবাহিতা তাঁর পুজো। ‘কুমারী’ যিনি হন, তাঁকে দেবী দুর্গার প্রতিভূ বলা হয়। তাই বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে খুব যত্ন সহকারে কুমারী নির্বাচনের কথা বলা আছে। ‘কুমারী’কে হতে হবে দেবীর মতোই পবিত্র ও প্রশান্ত।
কুমারী পুজো
অষ্টমীর সকালে কুমারীকে গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করিয়ে শুদ্ধ করে তাকে লাল বেনারসী শাড়ি পরিয়ে ফুল, গয়না ও পায়ে আলতা দিয়ে সাজান হয়। পুজো হওয়া অবধি কুমারীকে উপবাস করতে হয়। এরপর যথাসময়ে দেবী দুর্গার মূর্তির সামনে তাকে বসিয়ে দেবীর হাতের একটি পদ্মফুল তার হাতে দিয়ে পুজো আরম্ভ করা হয়। ১৬ টি উপকরণ দিয়ে শুরু হয় কুমারী পুজোর আচার। পরে অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বাতাস—এই পাঁচ উপকরণ দিয়ে কুমারীকে পুজো করা হয়।
কুমারীর নাম
এক থেকে ষোলো বছর বয়স অবধি কুমারীদের বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। তাকে সেই রূপে পুজো করা হয়ে থাকে। যেমন, এক বছরের কুমারীর নাম সন্ধ্যা, দুই বছরের কুমারীর নাম সরস্বতী, তিন বছরের ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কালিকা, পাঁচ বছরের সুভগা, ছয় বছরের উমা, সাত বছরের মালিনী, আট বছরের কুষ্ঠিকা, নয় বছরের কাল সন্দর্ভা, দশ বছরের অপরাজিতা, এগার বছরের রুদ্রাণী, বারো বছরের ভৈরবী, তের বছরের মহালক্ষ্মী, চোদ্দ বছরের পীঠনায়িকা, পনের বছরের খেত্রজ্ঞা ও ষোলো বছরের কুমারীকে অন্নদা বা অম্বিকা বলা হয়।
বেলুড় মঠের কুমারী পুজো
বেলুড় মঠে কুমারী পুজো প্রথম চালু হয়েছিল ১৯০২ সালে। স্বামী বিবেকানন্দ এর প্রচলন করেন। ওই বছর স্বামীজি মা সারদার উপস্থিতিতে, তাঁর মত নিয়ে ন’জন বালিকাকে ‘কুমারী’ জ্ঞানে পুজো করেন। তিনি তাঁদের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করেন ও পুজো শেষে তাঁদের দক্ষিণাও দেন। সেই থেকেই ঐতিহ্যকে মেনে বেলুড় মঠে এখনও কুমারী পুজো করা হয়ে থাকে। হাজার হাজার লোক প্রতিবছরই সেখানে কুমারী পুজো দেখতে যান।
এই হল দুর্গাপুজোয় কুমারী পুজোর সাতকাহন।
মন্তব্য করুন