ঘরে এক কৌটা পেট্রোলিয়াম জেলি সারাবছর অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকলেও শীতকালে এর কদর বেড়ে যায়। মজার ব্যাপার হল, হাত, পা, এবং ঠোঁটের চামড়াকে ফাটার হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি এটা শারীরিক সৌন্দর্য বাড়াতেও সাহায্য করে। কিন্তু আমরা অনেকেই এটা জানি না।
আগে মানুষ শরীরের ত্বক ঠিক রাখার জন্য শীতে নারিকেল তেল ব্যবহার করতো, এখনও কেউ কেউ এটা ব্যবহার করেন। পেট্রোলিয়াম জেলি আসার পরে এটাই শীতের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। কনুই থেকে শুরু করে শরীরের যেকোন জায়গায় ফাটা রোধ করতে এটা জাদুর মত কাজ করে। এখন হরেক রকমের লোশনের ভীড়েও পেট্রোলিয়াম জেলির আবেদন এতটুকু কমেনি। চিরপরিচিত এই জিনিসটা একদিকে যেমন ত্বককে সুরক্ষা দেয়, অপরদিকে রূপচর্চায়ও আনে নামীদামী প্রসাধনীর মতই জেল্লা।
আজকের লেখায় জানতে পারবেন পেট্রোলিয়াম জেলির পরিচিতি ও উপকারিতা। আরও জানবেন পেট্রোলিয়াম জেলি কি কি ভাবে আপনার রূপচর্চায় ব্যবহার করবেন। আশা করি লেখাটি আপনাদের কাজে লাগবে।
পেট্রোলিয়াম জেলি কি
পেট্রোলিয়াম জেলি মূলত বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি থকথকে তৈলাক্ত একটি জিনিস। হাইড্রোকার্বন হল এই জেলির প্রধান উপাদান। নানা ধরণের হাইড্রোকার্বন অণুর উপস্থিতি থাকে পেট্রোলিয়াম জেলিতে। সাধারণত তেল থেকে পেট্রোলিয়াম জেলি তৈরি করা হয়। পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম জেলি ত্বকের পরিচর্যার পাশাপাশি চিকিৎসা কার্যেও ব্যবহৃত হয়।
ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষা করতে পেট্রোলিয়াম জেলির জুড়ি নেই। এটির কাজ হচ্ছে ত্বকের উপর একটি আবরণ তৈরি করা যাতে কোষের পানি সহজেই উবে না যায়। বিভিন্ন উদ্ভিদ যেমন কচুপাতাতেও হাইড্রোকার্বন থাকে। যার ফলে কচুপাতা সহজে পানিতে ভিজে না।
পেট্রোলিয়াম জেলিতে থাকা বিভিন্ন নির্যাস একেকরকমের কাজ করে। বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত ভ্যাসলিন সাধারণ ত্বক ফাটাতে কাজে আসবে। আবার কোকো বাটার, অ্যালোভেরা, লেবু ইত্যাদির নির্যাস সমৃদ্ধ পেট্রোলিয়াম জেলি রূপচর্চায় অন্য মাত্রা যোগ করবে।
ত্বকের সুরক্ষায় পেট্রোলিয়াম জেলি
পেট্রোলিয়াম জেলি প্রধানত শীতবান্ধব ক্রিম হলেও এটা ত্বকের যত্ন ও সুরক্ষায় নানাভাবে কাজে লাগানো যায়।
- ত্বককে অতিরিক্ত শুষ্কতার হাত থেকে বাঁচাতে গোসলের পর মুখে ও শরীরে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগান। এতে ত্বক আর্দ্র থাকবে বহুক্ষণ। এছাড়াও ত্বককে রাখবে নরম, কমণীয়, এবং হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনবে।
- পেট্রোলিয়াম জেলি ফুসকুড়ি দূর করতে সাহায্য করে। গরমের সময় শরীর ও মুখে ফুসকুড়ি উঠলে এটি ব্যবহার করুন। এমনকি বাচ্চাদের ডায়াপারজনিত কারণেও ওঠা ফুসকুড়ি নির্মূল করতেও এই জেলি নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়াও চামড়ার জ্বালাপোড়া কমাতেও এটি সহায়ক।
- ছোট এবং বড় উভয় বয়সের লোকজন শুষ্ক ও ফাটা চামড়ায় পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করতে পারবেন। যেকোন ঋতুতে ব্যবহারের উপযোগী এই জেলি ত্বককে রাখবে মসৃণ, সতেজ, এবং আর্দ্র। এমনকি সার্জারি পরবর্তী চুলকানি বা রুক্ষতা কমাতে এটি ব্যবহার করতে পারেন।
- অনেকসময় নতুন জুতা থেকে চামড়া লাল হয়ে যায় ও ফোস্কা পড়ে। যেসব জায়গায় ফোস্কা পড়ে, জুতা পরার আগে সেসব জায়গায় জেলি লাগিয়ে নিলে চামড়ার সাথে জুতার ঘষা কমে যাবে। ফোস্কাও পড়বেনা নতুন করে।
- বড় ও ভারি কানের দুল পরলে কানে ব্যথা করে, রক্তপাত হয়। এরকম পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য দুল পরার আগে লতিতে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগয়ে নিন। তাহলে ভারি দুল পরলে আর ব্যথা করবেনা।
- ছোট ধরণের কাঁটাছেড়া সারাতে পেট্রোলিয়াম জেলি চমৎকার কাজ করে। আবার শেইভিংয়ের পরে কেটে গেলে, রক্তপাত হলে সেটাও এই জেলি দিয়ে বন্ধ করা যায়। তাছাড়া ত্বকের ফোলা ভাব, র্যাশও কমাবে এটি। আফটারশেভ লোশনের মতই ত্বকে এনে দিবে আরামদায়ক অনুভূতি।
পেট্রোলিয়াম জেলি দিয়ে রূপচর্চা
নানা ধরণের ফেস ক্রিম, হাইলাইটার, সিরাম, সুগন্ধির মত পেট্রোলিয়াম জেলিও এনে দিতে পারে তাক লাগানো সৌন্দর্য। আপনার হাতের কাছে প্রসাধনী সামগ্রী খুব বেশি না থাকলেও শুধু হালকা একটু পেট্রোলিয়াম জেলি দিয়েও হতে পারবেন অনন্য সুন্দরী।
- পারফিউম লাগানোর আগে ঘাড়ে ও হাতে একটু জেলি মেখে নিয়ে তারপর পারফিউম স্প্রে করলে গন্ধ থাকবে অনেকক্ষণ।
- হাইলাইটারের বদলে একটুখানি পেট্রোলিয়াম জেলি লাগালেই মুখের উজ্জ্বলতা চলে আসবে বহুগুণ। তাতে বাড়তি করে হাইলাইটার ব্যবহারের কোন দরকারই হবে না।
- ওয়াটারপ্রুফ মেকআপ হোক বা ম্যাট মেকআপ, অনেকটা পেট্রোলিয়াম জেলি মুখে ভালমত মেখে এরপর তুলা দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলুন। ব্যস, নিমেষেই ত্বক পরিষ্কার। মেকআপ রিমুভারের চমৎকার বিকল্প এই জেলি।
- নেইল পলিশ দেয়ার আগে নখের চারপাশে একটু পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে নিলে নেইল পলিশ আর থেবড়ে যাবে না।
- কৃত্রিম চোখের পাপড়ি খোলার আগে সামান্য জেলি ঘষে নিলে পাপড়ি তোলা হবে সহজ ও ব্যথামুক্ত।
- হেয়ার ডাই লাগানোর আগে কপাল ও কানে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে নিলে ডাইয়ের রঙ সহজে ত্বকে লেগে যাবে না।
- ক্রিমি আইশ্যাডো বানাতে আইশ্যাডো পাউডারের সাথে পেট্রোলিয়াম জেলি মিশিয়ে এরপর ব্যবহার করুন।
- মরা চামড়া দূর করতে চাইলে সি সল্ট আর পেট্রোলিয়াম জেলি একসাথে মিশিয়ে মুখ ও পুরো শরীরে ঘষুন। আবার মসৃণ হাত-পায়ের জন্য পেট্রোলিয়াম জেলি, গোলাপজল, এবং লেবুর মিশ্রণ খুবই কার্যকরী। শুধু জেলি ব্যবহার করলেও হাত-পা মসৃণ থাকবে।
- ছোট ছোট চুল বা বেবি হেয়ারের উপর হালকা জেলি লাগিয়ে নিলে সহজে উড়ে মুখের উপর আসবে না, পরিপাটি থাকবে।
- পুরনো লিপস্টিকের সাথে পেট্রোলিয়াম জেলি মেশালে রঙিন লিপবাম তৈরি করা সম্ভব। ঠোট ফাঁটাও রোধ হবে, আবার লিপস্টিকের কাজও করবে।
- এলোমেলো ও পাতলা আইব্রো সমান ও মোটা দেখানোর জন্য আইব্রোতে হালকা পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে নিন।
মনে রাখবেনঃ
পেট্রোলিয়াম জেলি হাজার কাজে আসলেও এটা দানবের রূপ ধরতে পারে যেকোন সময়। সতর্কতা অবলম্বন না করলে মারাত্মক এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি পারে।
- এমনিতে পেট্রোলিয়াম জেলি ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখলেও নিত্য ব্যবহারে এটা ত্বকের উপর মোটা আস্তর ফেলে দিতে পারে। আস্তর পড়ে গেলে ত্বকের স্বাভাবিক অক্সিজেন গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হবে৷
- এই জেলি ফুসফুসে গেলে লিপিড নিউমোনিয়া হতে পারে৷ তাই প্রতিদিন ব্যবহারের চাইতে নিয়ম মেনে সীমিত ব্যবহার অনেক নিরাপদ। তবে বাজারের পেট্রোলিয়াম জেলির চাইতে যদি ঘরে প্রাকৃতিকভাবে বানানো যায় তাহলে সেটা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর হবে।
- মুখে ব্রণ ও র্যাশ থাকলে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার না করাই ভাল। কারণ জেলির তৈলাক্তভাব ব্রণ ও র্যাশের সাথে মিলে আরো জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
- অপরিষ্কার ত্বকে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগানো থেকে বিরত থাকুন। নাহলে ময়লা আর তেল একসাথে মিশে লোমকূপের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।
- এই জেলি শুধুমাত্র শুষ্ক ও স্বাভাবিক ত্বকের জন্য উপযোগী। তৈলাক্ত ত্বকে ভুলেও এটা ব্যবহার করবেন না। সংবেদনশীল ত্বক হলে শুধু ত্বকের শুষ্ক জায়গায় এটা ব্যবহার করবেন।
শেষ কথা
এবার থেকে শুধু শীতকাল এলেই পেট্রোলিয়াম জেলির কথা মনে পড়বে না, সারাবছর ত্বককে চাঙ্গা রাখতে এটাকে মনে করবেন বারবার। পয়সা খরচ করে হরেক রকমের প্রসাধনীর বদলে কিভাবে এক কৌটা জেলি দিয়ে রূপচর্চা করা সম্ভব সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন। এটা যেমন সাশ্রয়ী তেমন ঝামেলামুক্ত ব্যবহারবিধি। তো দেরি না করে শুরু করে ফেলুন পেট্রোলিয়াম জেলি দিয়ে রূপচর্চা। লেখাটি কেমন হয়েছে তা কিন্তু আমাদের জানাতে ভুলবেন না। ভাল লাগলে লেখাটি শেয়ার করুন।
মন্তব্য করুন