গরমের চটচটে চুল থেকে বর্ষার ভিজে স্ক্যাল্প, এই সবের প্রভাব অয়েলি বা তেলতেলে চুলের ওপর কিন্তু সবথেকে বেশি। তেলতেলে চুলের যত্ন তাই একটু আলাদাভাবে নিতে হয়। একটু বিশেষ যত্নই তেলতেলে চুলকে আমূল বদলে দিতে পারে। এই আর্টিকেলে রইল সেই যত্নের এ টু জেড সলিউশন।
কেন স্ক্যাল্প তেলতেলে হয়?
আমাদের স্ক্যাল্পের নিচে অয়েল গ্ল্যান্ড থাকে। এই গ্ল্যান্ডের পোশাকি নাম হল সিবাসিয়াস গ্ল্যান্ড। সেই গ্ল্যান্ড থেকে নিয়মিত তেল বা সিবাম নিঃসরণ হয়। এই তেল স্বাভাবিক প্রাকৃতিক তেল। এর কাজ হল চুলের পুষ্টি জোগান আর চুলের বা স্ক্যাল্পের হাইড্রেশন বজায় রাখা। কিন্তু অনেক সময়ে এমন হয় যে আমাদের অয়েল গ্ল্যান্ড থেকে তেলের নিঃসরণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেল। তখন মাথা অতিরিক্ত তেলতেলে হয়ে যায়। সেই তেলতেলে স্ক্যাল্পে ধুলো, ময়লা বেশি জমে। তার ফলে দেখা দেয় নানা সমস্যা। মূলত হরমোনের সমস্যা থাকলে অয়েল গ্ল্যান্ড থেকে বেশি তেল নিঃসরণ হয়ে থাকে।
সমাধান কী?
১. চুল রোজ পরিষ্কার করুন

যেহেতু আপনার চুলে আর স্ক্যাল্পে তেল বেশি, তাই ময়লা বেশি জমছে। এই ময়লা দূর করার জন্য রোজ একবার করে শ্যাম্পু করতেই হবে। শ্যাম্পু করার ক্ষেত্রে বাড়ি ফিরে শ্যাম্পু করাটাই ভালো। এতে বাইরের ময়লা সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে যাবে। কিন্তু শ্যাম্পু করার সময়ে দুটি বিষয় মনে রাখবেন। এক হল, কোনও আয়ুর্বেদিক শ্যাম্পু দিয়ে শ্যাম্পু করবেন। বেশি কেমিক্যাল দেওয়া শ্যাম্পু চুল খারাপ করে দেবে। আর দেখবেন রোজ শ্যাম্পু করলে কিছুদিন পর চুল বা স্ক্যাল্প ড্রাই লাগছে কিনা। অনেক ক্ষেত্রে বেশি শ্যাম্পু করে ফেললে ন্যাচারাল অয়েল তৈরি হওয়া কমে যায়। এটি কিন্তু আবার চুলের ক্ষতি করে। তাই স্ক্যাল্প ড্রাই হয়ে আসলে এক দিন ছেড়ে ছেড়ে শ্যাম্পু করুন।
২. ঠিক উপায়ে শ্যাম্পু করুন
কখন শ্যাম্পু করবেন এটা জানার সঙ্গে কীভাবে শ্যাম্পু করবেন এটা জানাও খুব দরকার। শ্যাম্পু স্ক্যাল্পে ব্যবহার করুন, সাড়া চুলে নয়। স্ক্যাল্প থেকে তেল নিঃসরণ হয়। তাই স্ক্যাল্প পরিষ্কার করা দরকার। স্ক্যাল্পে জোরে জোরে প্রেসার দেবেন না বা নখ দিয়ে চাপ দেবেন না। এতে তেল নিঃসরণ বেড়ে যেতে পারে। হাল্কা হাতে মাথা পরিষ্কার করুন। গোটা চুলে শ্যাম্পু না লাগিয়ে বরং নিজে থেকে গোটা চুলে শ্যাম্পু ছড়িয়ে যেতে দিন। আর দু বার করে শ্যাম্পু করতে হবে না, কারণ আপনি রোজ শ্যাম্পু করছেন।
৩. কন্ডিশনার দিন ঠিক ভাবে
যেহেতু আপনার চুল তেলতেলে তাই কন্ডিশনারের ব্যবহার ভুল হলে আপনার চুল চটচটে লাগতে পারে। তেলতেলে স্ক্যাল্প হলে স্ক্যাল্পে বা গোটা চুলে কন্ডিশনার ব্যবহার করার দরকার নেই। বরং শুধু চুলের নিচের দিকে লাগান আর ভাল করে ধুয়ে নিন। উপযুক্ত আয়ুর্বেদিক কন্ডিশনার বেছে নেওয়াও কিন্তু খুব দরকার।
৪. উপযুক্ত প্রোডাক্ট নির্বাচন করুন
সব ধরণের প্রোডাক্ট আপনার চুলের সঙ্গে যাবে না। কোন প্রোডাক্ট আপনার চুলের তেলতেলে ভাবের সঙ্গে যাবে, পি.এইচ ব্যাল্যান্স বজায় রাখবে এই সব জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। তাই তেলতেলে স্ক্যাল্পের জন্য তৈরি একমাত্র সেই প্রোডাক্টই ব্যবহার করুন। আপনি বেবি শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন। এতে কিন্তু ভালো উপকার পাবেন।
৫. চিরুনি পরিষ্কার করুন নিয়মিত
আপনি শ্যাম্পু করে পরিষ্কার চুলে আগের দিনের ব্যবহার করা চিরুনি ব্যবহার করলেন। দেখলেনই না তাতে তেল, ময়লা লেগে আছে। তাহলে চুল পরিষ্কার করার কী মানে রইল? তাই চুল পরিষ্কারের পাশাপাশি রোজ শ্যাম্পু দিয়ে চিরুনি পরিষ্কার করুন। চুলের মেকআপের জন্য যদি অন্য কোনও ব্রাশ ব্যবহার করেন সেটাও সমান ভাবে পরিষ্কার করুন। চুলের ক্লিপ, হেয়ার ব্যান্ড এরকম জিনিসও পরিষ্কার করুন নিয়ম করে।
৬. সিলিকন দেওয়া প্রোডাক্ট একদম নয়
শ্যাম্পু, কন্ডিশনার কেনার সময়ে পিছনের উপকরণ দেখে নিন অবশ্যই। আজকাল অনেক শ্যাম্পু, কন্ডিশনারে সিলিকন দেওয়া থাকে। সিলিকন দেওয়া থাকে কারণ এটি অতিরিক্ত জেল্লা আনে চুলে। কিন্তু এর পাশাপাশি এই সিলিকন আপনার চুল বেশি চটচটে আর নোংরা করে তুলতে পারে যদি আপনার চুল তেলতেলে হয়। সিলিকন চুলের স্বাভাবিক ময়েশ্চার নষ্ট করে দেয়। তাই সিলিকন দেওয়া প্রোডাক্ট একদম নয়।
৭. চুল নিয়ে খেলা নয়
এমনিতেই বিশেষজ্ঞরা বলেন চুলে বেশি হাত দেওয়া উচিত নয়। অনেকের অভ্যেস থাকে চুলে বারবার হাত দেওয়া, চুল পাকানো, চুলকানো। অনেকে ঘনঘন চিরুনি লাগান চুলে। এই সবই কিন্তু অয়েল গ্ল্যান্ডকে অনেক বেশি সক্রিয় করে। তাই বেশি তেল নিঃসরণ হয়। অযথা তাই চুলে বা মাথায় হাত দেবেন না।
৮. ড্রাই শ্যাম্পু ব্যবহার করুন
ড্রাই শ্যাম্পু মানে পাউডার জাতীয় শ্যাম্পু। মূলত আয়ুর্বেদিক অনেক শ্যাম্পু এরকম হয়। ড্রাই শ্যাম্পুর মধ্যে লিকুইড অনেক কেমিক্যাল দেওয়ার সুযোগ থাকে না। আপনাকে শুধু জল দিয়ে গুলে মাথায় দিতে হবে। তাছাড়া অনেক ড্রাই শ্যাম্পু আগে চুলে ছড়িয়ে নিয়ে খানিক রেখেও ব্যবহার করা যায়। ড্রাই শ্যাম্পু চুলের অতিরিক্ত তেল আর ময়লা বের করে দেয়।
৯. তেল দিতে ভুলবেন না
অনেকে ভাবেন তেলতেলে মাথায় তেল দেওয়ার দরকার নেই। এটা খুব ভুল ধারণা। নারকেল তেল বা আমলা তেল ব্যবহার না করলে এগুলির গুণ আপনার চুল পাবে কীকরে? তাই সপ্তাহে দু দিন তেল ব্যবহার করুন। তেল হাল্কা গরম করে আস্তে আস্তে মাথায় লাগিয়ে রেখে দিন সাড়া রাত। একটা পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে চুল ঢেকে রাখুন, যাতে নোংরা না হয়। তেলের পুষ্টির কিন্তু বিকল্প নেই।
১০. চুল ধুতে অ্যাপেল সিডার
অ্যাপেল সিডার ভিনিগার খুব ভালো তেলতেলে চুল পরিষ্কার করে। অন্য শ্যাম্পুর বদলে এটিই ব্যবহার করুন। যেহেতু অ্যাপেল সিডার ভিনিগার অম্ল জাতীয় তাই এটি চুলের তেলতেলে ভাব কমায়। তেলতেলে পুনরায় হওয়া বন্ধ করে, পি.এইচ লেভেল বজায় রাখে।
উপকরণঃ
পরিমাণ মতো অ্যাপেল সিডার ভিনিগার, ৩ চামচ লেবুর রস।
পদ্ধতিঃ
দুটি উপকরণ ভালো করে মিশিয়ে ভিজে চুলে লাগান। হাল্কা হাতে ম্যাসাজ করুন। ১০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। একদিন অন্তর অন্তর করুন এটি। লেবু অ্যাপেল সিডারের গুণ আরও বাড়িয়ে দেয়।
১১. ঘাম জমতে দেবেন না
সকালে জিম থেকে আসার পর বা বাইকের হেলমেট ব্যবহার করার পর চুল সবচেয়ে বেশি ঘেমে থাকে। এই ঘাম জমে জমেই চুল খারাপ হয়ে যায়। বর্ষাকালে আবার সারাদিন ভিজে মাথায় থাকি আমরা। এতে ফাঙ্গাসের কবলে পড়ে আমাদের স্ক্যাল্প। সেই বিক্রিয়া থেকেও চুল চিটচিটে হয়ে যায়, তেলতেলে লাগে। তাই জিম থেকে এসে বা বাইকে করে এসে বাড়ি ঢুকে স্নান করুন। মাথা পরিষ্কার করুন। তেলতেলে ভাব অনেক কমবে।
১২. গ্রিন টি’র ব্যবহার
পরীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রিন টি খুব ভালো সিবাম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। সিবাম মানে যে তেল অয়েল গ্ল্যান্ড থেকে বের হয়। এই তেল যাতে বেশি তৈরি না হয় আর বেশি নিঃসরণ না হয় তা নিয়ন্ত্রণ করে গ্রিন টি। তাই শ্যাম্পু কেনার সময়ে দেখতে পারেন তাতে গ্রিন টি আছে কিনা। বা রোজ আপনি গ্রিন টি দিনে একবার খেতেও পারেন।
১৩. কর্নস্টার্চের ব্যবহার
গুঁড়ো শ্যাম্পু ব্যবহার করতে বলেছিলাম। অনেকে হয়তো ভেবেছিলেন যদি গুঁড়ো শ্যাম্পু না পান, তখন কী করবেন। হাতের কাছে তো আছেই কর্নস্টার্চ।
উপকরণঃ
পরিমাণ মতো কর্নস্টার্চ।
পদ্ধতিঃ
নুন রাখে যেরকম ছিদ্রযুক্ত পাত্রে সেরকম পাত্র নিন। তাতে কর্নস্টার্চ রেখে দিন। ব্যবহার করার আগে ভাল করে ঝাঁকিয়ে চুলে দিন আর ১৫ মিনিট রেখে দিন। তারপর চিরুনি দিয়ে চুল ঝেড়ে নিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে চুল। তবে শ্যাম্পু করার একান্ত সময় না থাকলেই এটি করুন।
১৪. কাঠের চিরুনির ব্যবহার

সব ক্ষেত্রের চুলে তো বটেই, তেলতেলে চুল হলে আপনাকে এই নিয়ম আরও বেশি করে মানতে হবে। প্লাস্টিকের চিরুনির দাঁত ভালো হয় না। এটি সমান ভাবে স্ক্যাল্পে চাপ দিতে পারে না। ফলে স্ক্যাল্প থেকে বেশি তেল নিঃসরণ হতে পারে। বদলে কাঠের চিরুনি কাঠ মানে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি। এর দাঁত খুব মজবুত আর এমন ভাবে তৈরি হয় যাতে গোটা চুলে, স্ক্যাল্পে সমান ভাবে চাপ দিতে পারে। এই জন্যই বিশেষজ্ঞরা এই চিরুনি ব্যবহার করতে বলেন। প্লাস্টিকের মধ্যেও তো সিলিকন থাকে। তাই প্লাস্টিকের কম দামের চিরুনি ব্যবহার না করাই ভালো।
১৫. খাবারে নজর দিন
তেলতেলে স্ক্যাল্প বা চুল হলে আপনার রোজের খাবারের দিকে নজর দেওয়া কিন্তু খুব দরকার। তেলতেলে খাওয়া, ভাজাভুজি কিন্তু সিবাসিয়াস গ্ল্যান্ড বেশি সক্রিয় করে তোলে। তখন অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ হয়। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট আর প্রসেসড ফুডও কিন্তু তেল বাড়িয়ে দেয়। তাই ভাত, রুটি বেশি খাবেন না। অনেক দিনের প্রক্রিয়াজাত খাবার পারলে একটু বেশি এড়িয়েই চলুন। ঘি, মাখন, চিজ এই সবেতেও তেল বেড়ে যেতে পারে খুবই।
আর আশা করি তেলতেলে চুল হলে সমস্যার কোনও কারণ নেই। এইভাবে যত্ন নিলে তেলতেলে চুলেও স্টাইল করে আপনি সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারেন।
চুল পড়া কি ভাবে বন্ধ করবো?
Thanks