পিঠা-পুলির দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। বাঙালীর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হরেক রকমের পিঠা। নবান্ন, শীত, পৌষ পার্বণ কিংবা বিয়ের আয়োজন – সবকিছুই অপূর্ণ থেকে যায় পিঠা ছাড়া। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিতে পিঠা-পুলি খুবই আদরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
এখনও বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের মানুষের পিঠা-পুলি ছা ড়া ঈদ হয় না। ঈদে কিংবা পূজার আয়োজনেও পিঠা থাকেই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল অনুষ্ঠান আয়োজনে পিঠার কোনো না কোনো আইটেম থাকেই।
বিয়েতে ডালায় করেও বর-কনের বাড়িতে পিঠা আদান-প্রদানের প্রচলন রয়েছে। পিঠা কেবল রসনা নয়, সহিত্য ও চারুকলারও অন্যতম প্রধান উপাদান। বাংলা গান-কবিতায়ও পিঠাপুলির উল্লেখ রয়েছে। এদেশের পিঠার স্বাদে মুগ্ধ হয়েই কবি সুফিয়া কামাল লিখে গেছেন –
“পৌষ-পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে,
আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।”
স্বাদ ও ঐতিহ্যে ভরপুর বিভিন্ন পিঠা রয়েছে এদেশের নানান অঞ্চল জুড়ে। যেমন বরগুনার চুইয়া পিঠা, নোয়াখালীর খোলাজা পিঠা, গাজীপুরের সেহুই কিংবা ফুল পিঠা, পুরান ঢাকার খিরসা-মালাই পাটিসাপটা ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, ম্যারা পিঠা, পুলি পিঠা, ছাঁচের পিঠা, কলই পিঠা, মালপোয়া, লবঙ্গ-লতিকা, পানতোয়া, গোকুল পিঠা, ফুল ঝুরি, দুধ পুলি আরো কতশত পিঠা। এক জেলার পিঠার কদর রয়েছে অন্য জেলাগুলোতেও।
এরকমই একটি জনপ্রিয় ও মুখরোচক পিঠা হচ্ছে বিবিখানা পিঠা। ধারণা করা হয় রাজা বিক্রমাদিত্যের সময় থেকে এই পিঠার প্রচলন হয় এবং এখনও এটি অতি জনপ্রিয় একটি পিঠা। বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুর জেলার বিখ্যাত একটি পিঠা হচ্ছে এই বিবিখানা পিঠা। এই বিবিখানা পিঠার আঞ্চলিক নাম শুনলে অবাক হবেন। একে “জামাই ভুলানো পিঠা” বলা হয় শরীয়তপুরের গ্রামাঞ্চলে।
কেন জানেন? এই পিঠা তৈরি করা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। যে এই পিঠা তৈরি করে তাকে অনেক সক্ষমতা, পারদর্শীতা ও গুণের পরিচয় দিতে হয়। সাধারণত পিঠা বাড়ির কনে-বউরাই তৈরি করে। কনে বা বৌদেরকে গ্রামের ভাষায় বিবিও বলা হয়। সেখান থেকেই এই পিঠার নাম হয় বিবিখানা পিঠা।
আবার এই মজার পিঠা খাইয়েই নাকি বিবিরা তাদের স্বামীদের বশ করে ফেলেন। তাই বলা হয় জামাই ভুলানো পিঠা। আবার অনেকে বলেন, পুরনো আমলে কোনো এক ধনীর গিন্নি মানে বিবির জন্য প্রথম তৈরি করা হয়েছিলো এই পিঠা। সেই থেকেই আগেকার দিনের বিবিরা এই পিঠা খেতে পছন্দ করতেন বলে এর নাম হয় বিবিখানা পিঠা।
এই বিবিখানা পিঠা তৈরি করা খুব সহজ নয়। আবার একটু চেষ্টা করলে খুব কঠিন কিছুও নয়। তো চলুন আজ জেনে নেই কিভাবে তৈরি করবেন শরীয়তপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী এই বিবিখানা পিঠা।
বিবিখানা পিঠা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয়
উপকরনঃ
- খাটি দুধ
- খেজুরের গুড়
- তালের রস
- আতপ চালের গুড়া
- কিশমিশ
- এলাচের গুড়া
- পেস্তা বাদাম
- কাজু বাদাম
- কোড়ানো নারকেল
- ঘি
- কলা গাছের পাতা
বিবিখানা পিঠা বানানোর পদ্ধতিঃ
- বিবিখানা পিঠার জন্য প্রথমেই আপনার প্রয়োজন হবে অনেক পরিমানে দুধ। দুধে অবশ্যই পানি মেশানো যাবে না। দুধ জ্বাল দিয়ে অনেক ঘন করে নিতে হবে। এমনভাবে জ্বাল করে নেবেন যেন দুধে একটুও পানি থাকতে না পারে। এরপর এই ঘন দুধ জ্বালে থাকা অবস্থায়ই এর সঙ্গে মিশিয়ে নিন খেজুরের গুড়।
- খেজুড়ের গুড় ভালোভাবে দুধের সাথে মিশে গেলে চুলা থেকে নামিয়ে নিন। তালের রস আগেই জ্বাল দিয়ে ঘন করে নিন, রসে যেন পানি না থাকে। একে ঠান্ডা করে রাখুন। এবার দুধ ও গুড়ের মিশ্রণে পরিমান মতন আতপ চালের গুড়া ও তালের রস ভালোভাবে মিশিয়ে মথে নিন। মথা ভালো না হলে পিঠার স্বাদও ভালো হবে না।
- পিঠার স্বাদ বাড়াতে কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম, কিশমিস, ঘি, এলাচের গুড়া, কোড়ানো নারকেল মন্ডে মিশিয়ে ভালোভাবে মথে নিন। বাদাম বেটে কিংবা কুচি করে কেটেও ব্যবহার করতে পারেন। কোড়ানো নারকেল অনেকের পছন্দ নয়। তারা কোড়ানো নারকেল না দিতে চাইলে চিপে নারকেলের দুধ বের করে মন্ডে মিশিয়ে নিতে পারেন।
- এবারে একটি পরিষ্কার সসপ্যান নিন। আগেই গাছ থেকে কলা পাতা কেটে এনে ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে রাখুন। কারন এই কলাপাতাতেই আপনি মন্ডটা বসাবেন।
- সসপ্যানের ভেতরের অংশটা কলাপাতায় সুন্দর করে মুড়ে নিন। তো এই মন্ডটা ভালো করে মথা হয়ে গেলে কলাপাতার উপরে বসিয়ে দিন। এবারে চুলায় বড় একটা পাত্রে পানি নিয়ে ফুটতে দিন। চুলায় পানি ফুটতে শুরু করলে পানির পাত্রের উপরে কলা পাতায় মোড়ানো মন্ডসহ সসপ্যানটাকে ভাপে বসিয়ে দিয়ে ভারী ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন।
- এভাবে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা সময় মন্ডটাকে ভাপে বসিয়ে রাখুন। ভাপে মন্ড সিদ্ধ হয়ে এলে সসপ্যান নামিয়ে নিন। তৈরি হয়ে গেলো ঐতিহ্যবাহী বিবিখানা পিঠা। এবারে পিঠাকে আপনার পছন্দসই আকারে কেটে নিন।
- ফুটন্ত পানি ছাড়া বালুতে বা লবনেও আপনি এই পিঠা বানাতে পারেন। এভাবে বানাতে চাইলে মন্ড তৈরির প্রক্রিয়া একই থাকবে। পানির বদলে একটি বড় পাত্র কিংবা কড়াইতে বালু বা লবন দিয়ে গরম করে নিন।
- এরপর পিঠার সসপ্যান উতপ্ত কড়াইতে বসিয়ে ঢেকে দিন। ভাপেই পিঠা তৈরি হয়ে যাবে। এভাবে এক ঘন্টার একটু বেশি সময় লাগতে পারে।
- এছাড়াও আপনি কষ্ট আরো কমাতে চাইলে ওভেনে বেক করে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে কলাপাতার বদলে সসপ্যানে ভালো করে ঘি মেখে নিয়ে তারপর মন্ডটা বসিয়ে নিয়ে ওভেনে বেক করে নিন।
মন্তব্য করুন