বেশ অনেকবছর পরে আবার একটা চন্দ্রগ্রহণের সাক্ষী থাকলাম আমরা। আপনারা নিশ্চয়ই সবাই দেখেছেন এই চন্দ্রগ্রহণ? আর এবারের চন্দ্রগ্রহণ যে একটা স্পেশাল ইভেন্ট ছিল তাও তো খবরের কাগজের দৌলতে আপনাদের অজানা নেই! ‘সুপারমুন’, ‘ব্লু মুন’ আর ‘ব্লাড মুন’—এই তিন তিনটে জিনিস নাকি ১৫২ বছর পর একসাথে ঘটেছিল। বুঝতেই পারছেন বেশ বিরল একটা ব্যাপার।
গ্রহণের নিয়ম-কানুন!
আর প্রত্যেকবার, সে সূর্যগ্রহণই বলুন, কি চন্দ্রগ্রহণ—ছোটবেলা থেকেই তো শুনে আসছেন, গ্রহণের সময় নাকি এই করতে নেই, তাই করতে নেই! খাবার খেতে নেই, বাড়ির বাইরে বেরোতে নেই—এমন আরও অনেক কিছু। তা আপনার মনেও নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে যে কেন গ্রহণের সময় খাবার খেতে নেই? আর আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পাননি। তাই সেই চক্করে কিছু না জেনেই কিছু নিয়ম নিশ্চয়ই আপনি এবারেও মেনে ফেলেছেন, তাই তো? আপনার কৌতূহলের অবসান ঘটাতে এবার আর্টিকল নিয়ে এলাম আমরা।
শাস্ত্রে কী বলে?
গ্রহণের সময় খাবার খাওয়া আদৌ উচিত কিনা এ নিয়ে নানা জন নানা মতামত তো দিয়েই থাকেন। কিন্তু প্রাচীন ভারতে মনে করা হতো যে চন্দ্রগ্রহণ নাকি শুধু রাতেই ঘটে, আর এই সময় নাকি কিছু বিশেষ ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, প্রাচীন ভারতে গ্রহণের সময় খাবার খাওয়া হতো না, কারণ খাবার নাকি এইসময় শরীরে নানা ক্ষতিকারক এফেক্ট করে।
চাঁদই বলুন বা সূর্য—মানুষের শরীরের বা জীবনের সাথে এই দুয়েরই যোগ আছে। আর গ্রহণের সময় নাকি কিছু ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয় যা আপনার পেটের খাবারকে বিষে পর্যন্ত পরিণত করে ফেলতে পারে। তাহলেই ভেবে দেখুন কি মারাত্মক ব্যাপার।
‘চৈতন্য ফাউন্ডেশনে’র যোগাচার্জ অনুপ মনে করেন, খাবার একদম খাওয়া বন্ধ করা নয়, তবে এই সময় নাকি কিছু হালকা খাবার খাওয়া উচিত, যা হজম তাড়াতাড়ি হয়। কারণ গ্রহণের সময় শরীরে নাকি ‘কুলিং এফেক্ট’ থাকে, ফলে খাবার হজম হতে দেরী হয়। চাঁদে তো জল থাকে, আর আমাদের শরীরেও প্রায় ৭০% জল। তাই চাঁদে গ্রহণের সময় কিছু পরিবর্তন হওয়া মানে আমাদের শরীরেও নাকি খানিক তার প্রভাব পড়ে।
অনেকে বলেন, গ্রহণের সময় খাবার না খাওয়ার কোনো আলাদা বাধা নেই। কিন্তু সূর্যগ্রহণ যখন হয়, তখন দিনের বেলাতেই আলো থাকে না। ফলে এইসময় কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া খাবারে অনায়াসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই গ্রহণের সময় খাবার খেতে বারণ করা হয়।
আবার অনেকে মনে করেন, চন্দ্রগ্রহণের সময় নাকি পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা—২৮ দিনের এই গোটা সাইকেলটা একসাথে ঘটে, মাত্র ২-৩ ঘণ্টায়। ‘স্বাভাবিকের থেকে আলাদা’, ‘অ-স্বাভাবিক’ এই ঘটনাই কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। যার প্রভাব পড়ে খাবারেও।
আর গ্রহণ মানেই তো চাঁদ, সূর্য আর পৃথিবীর একই সরলরেখায় আসা। এইসময় তাদের ম্যাগনেটিক শক্তি নাকি সবথেকে বেশী হয়। শরীরেও এই সময় বায়ো ম্যাগনেটিজমের শক্তি বেশী থাকে। এই দুটো শক্তিকে সামঞ্জস্যে আনতেই নাকি প্রাচীনকালে মুনিঋষিরা বসতেন ধ্যানে। তাও আবার খালি পেটে। আর এর সাথে মিশে থাকত একটা বিশ্বাস। মুনিঋষিরা বিশ্বাস করতেন, অসুর রাহুর গ্রাস থেকে দেবতা চন্দ্রকে বাঁচানোর জন্যই নাকি তাঁদের এই ধ্যান জরুরী। আর সেই থেকেই নাকি চলে আসছে গ্রহণের সময় খালি পেটে থাকার নিয়ম।
বিজ্ঞান কী বলে?
নাহ। এই প্রাচীন সংস্কার, তাকে ‘সু’-ই বলুন, কি ‘কু’-ই বলুন, বিজ্ঞান কিন্তু তাকে একদমই স্বীকার করে না। খাওয়া, না খাওয়া নিয়ে তার কোনো নিষেধ নেই। তবে এটা কিন্তু ফ্যাক্ট, আর বিজ্ঞানীরা মেনেও থাকেন সে কথা, যে গ্রহণের সময় কিন্তু কিছু কিছু ক্ষতিকারক রশ্মি, যেমন অতিবেগুনী রশ্মি একটু বেশী মাত্রাতেই বিকিরিত হয়, যা খাবারের মধ্যে যেতেই পারে। চন্দ্রগ্রহণের সময় এই বিকিরণের মাত্রা অনেক কম থাকে, কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় তা থাকে আরও ব্যাপক। ফলে খাবারই বলুন, বা কোনো জীবিত কোষই বলুন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর খাবার যদি হয় রান্না করা? তাহলে কিন্তু বিপদ। কারণ রান্না করা খাবারে থাকে জল। আর গ্রহণের সময় রশ্মি বিকিরণ বা রেডিয়েশনের সবথেকে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে ওই জলেই! আর রান্না করা খাবারেও যেহেতু থাকে জল, তাই ক্ষতি হয় সেটারও। এই ক্ষতিকর রেডিয়েশনকে এড়ানোর জন্য খাবারের ওপর অনেকসময় তুলসীপাতা রাখা হয়। তবে ওই বিপুল রেডিয়েশনকে ওই সামান্য তুলসীপাতা আদৌ কমাতে পারে কিনা, তা নিয়ে খানিক সন্দেহই আছে!
কি বুঝলেন তাহলে? গ্রহণের সময় খাবার খেতে নেই—এই ধারণাকে যদি আপনি অ্যাদ্দিন নিছকই কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে ধারণা বদলান। কারণ বিজ্ঞান আর শাস্ত্র—যুক্তি আছে কিন্তু দু পক্ষেরই! এবার মতামত আপনার!
মন্তব্য করুন