বাংলাদেশের লোকজনের খাবার রান্নায় যে মশলাটি সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়, সেটি হচ্ছে কাঁচা মরিচ বা কাঁচা লঙ্কা। এটি মশলার পাশাপাশি সালাদেরও অন্যতম প্রধান উপাদান। মাছ, মাংস, আমিষ, নিরামিষ – সব রান্নাতেই আছে কাঁচা মরিচের ব্যবহার। রান্নায় কাঁচা মরিচের ব্যবহার শুরু হয় প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে আমেরিকায়। পরবর্তীতে এর নিজস্ব ঘ্রাণ, স্বাদ ও ঝাল এর কারনে এটি বাঙালী রান্নার সাথেও মিশে যায় ওতপ্রোতভাবে।
আমাদের দেশে মরিচটা আসলে খাওয়া হয় ঝালের জন্য। কাঁচা মরিচে থাকা ক্যাপসিসিন নামের উপাদান এর ঝালের জন্য দায়ী। আমাদর নিত্যদিনের রান্নায় কাঁচা মরিচের প্রয়োজন হয়। সালাদ তৈরিতে মরিচ লাগে। আচার বানাতে মরিচ জরুরি। ঘরে কিছু না থাকলে মরিচ-পেঁয়াজ মেখে ভাত খেয়ে ফেলা যায়। আজকাল তো অনেকে মরিচের চা-ও পান করেন।
সাধারনত খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণের জন্য কাঁচা মরিচ ব্যবহার করা হলেও এর রয়েছে মারাত্নক পুষ্টিগুণ। কাঁচা মরিচ ভিটামিন সি এর ভান্ডার। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সাইনাসের সমস্যা দূর করে, স্ট্রেস কমায়, আমাদের হাইপোথ্যালামাসকে সচল রাখে, ব্যথার যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে, মন-মেজাজ ভালো রাখে, সর্দি সাড়ায়, হার্টকে সুস্থ রাখে, মস্তিস্কে যেন ব্লাড ক্লট না জমে সেটাও নিয়ন্ত্রন করে স্ট্রোকের আশঙ্কা কমায়।
আচ্ছা কেমন হয় যদি এত গুণে গুণান্বিত কাঁচা মরিচের ফলন হয় আপনার বাড়িতেই? কি অবাক হচ্ছেন? অবাক হবার কিছু নেই। একটু চেষ্টা করলে বাড়িতেই ফলাতে পারেন কাঁচা মরিচ।
কিভাবে? চলুন জেনে নেইঃ
প্রথম ধাপঃ
- বাড়িতে মরিচ চাষের জন্য প্রথমেই যে বিষয়টি লক্ষ্য করতে হবে সেটি হচ্ছে পরিবেশ। মরিচ গাছ লাগানোর জন্য বাড়ির এমন স্থান নির্বাচন করুন যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকবে না এবং বর্ষাকালেও পানি উঠবে না। টবে লাগাতে চাইলে টবে যথাযথ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে কিনা লক্ষ্য করুন। না থাকলে টবের নিচে পানি যাবার জন্য ছিদ্র করে দিন এবং ইটের টুকরা বা সুড়কি দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করুন। টবে মাটি দেবার আগে কিছু বালি দিয়ে নিন যেন অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়। প্রচুর রোদ পায় এমন স্থানে মরিচ গাছ রাখা সবচেয়ে ভালো।
দ্বিতীয় ধাপঃ
- দো আঁশ মাটিতে মরিচ গাছ ভালো ফলন দেয়। অম্লীয় ধরনের মাটিতে মরিচ গাছ হয় না। মাটির সাথে জৈব সার, পঁচা পাতা, গোবর, টিএসপি, ফল ও সবজির খোসা মিশিয়ে দিতে পারলে আরো ভালো হয়। মাটি থেকে আগাছা, কাঁকড়, সুড়কি বেছে পরিষ্কার করে ফেলুন। সাধারণত ৩৫° সেলসিয়াস থেকে ৪৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মরিচ গাছ ভালো ফলন দেয়।
- এরপর আপনি ঠিক কি জাতের মরিচ লাগাবেন তা ঠিক করুন। বাংলাদেশে সাধারণত ঝাল মরিচের ব্যবহার বেশি। মিষ্টি মরিচের ব্যবহার তুলনামূলক কম। এছাড়াও আছে কামরাঙ্গা মরিচ, বোম্বাই মরিচ, সাদা মরিচ, গোল মরিচ, আকালী মরিচ, দীঘলা মরিচ, ধানী মরিচ, বারি মরিচ ইত্যাদি।
- মরিচ গাছ বীজ থেকেও হয়। আবার বাজারে চারা গাছ কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলোও এনে লাগাতে পারেন। তবে যেহেতু বাড়িতে স্বল্প পরিসরে লাগাবেন, সেহেতু বাজার থেকে সুস্থ ও সবল চারা গাছ কিনে এনে লাগানোই উত্তম। চারা লাগানোর সময় মাটিতে যেন কোনো আগাছা না থাকে তা লক্ষ্য রাখতে হবে। মরিচের চারা অবশ্যই বিকেলে রোদ কমলে লাগানো উচিত এবং লাগানোর পর থেকে প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় পর্যাপ্ত পরিমানে পানি দিতে হবে। আর বীজ লাগালে মাটি ভিজিয়ে তাতে বীজগুলো ছিটিয়ে আবার ঝুরা মাটি দিয়ে ঢেকে দিন। চারা গজানোর পর থেকে হালকা পানি দিন।
তৃতীয় ধাপঃ
- মরিচের চারা আরেকটু বড় হলে মাটিতে ইউরিয়া ও পটাশ সার সামান্য পরিমানে দিয়ে মাটি খুচিয়ে দিবেন। এছাড়াও অল্প কিছুদিন পরপরই আগাছা পরিষ্কার করতে হবে ও নিড়ানী দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে দিতে হবে। আগাছা মরিচ গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
- মরিচের ফলন আসার আগে ও পরে দুই অবস্থাতেই গাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত গোড়া পঁচে যাওয়া, মূল পঁচে যাওয়া, ড্যাম্পিং অফ, এনথ্রাকনোজ – এসব রোগ মরিচ গাছে বেশি হয়। মাটিতে কিংবা বীজে থাকা জীবাণু ও ছত্রাকের আক্রমনে এসব রোগ হয়। তাই এসব রোগের লক্ষন দেখা দিলে সাথে সাথেই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে এবং অবশ্যই বীজ লাগানোর আগে বীজ শোধন করে নিতে হবে (যদি বীজ থেকে গাছ করতে চান)। এছাড়াও মরিচ গাছে পিঁপড়া, মাইটস, মিলিবাগ ও এক ধরনের সাদা রঙের মাছি আক্রমন করে। নিয়মিত সাবান বা ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানি স্প্রে করলে এসব পোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সহজেই।
- মরিচ গাছে ফুল আসার তিন সপ্তাহ পরে কাঁচা মরিচ পরিপক্কতা লাভ করে। তখন এই গাছ থেকে কাঁচা মরিচ তুলে খেতে পারবেন। যদি মরিচ পেঁকে লাল রঙের হয়ে যায় তাহলে সেই মরিচ রোদে শুকিয়ে শুকনো মরিচ হিসেবে খেতে পারেন কিংবা বেটে তরকারি রান্না করেও খেতে পারেন। এই পাকা মরিচের বীজ পরিপক্ক হলে এই বীজ মাটিতে পুঁতে রাখলেই আবার মরিচ গাছ জন্ম নেবে।
দেখুন তো, কি সহজেই একটু পরিশ্রমেই সারা বছর খেতে পারেন নিজের গাছের মরিচ। হ্যাঁ, সব মরিচই গাছের। তবে নিজের গাছের ফসল পাবার মধ্যে অন্য রকম আনন্দ আছে।
মন্তব্য করুন