ধরুন আপনি একটি বিয়ে বাড়ি গিয়েছেন। সাজানো-গোছানো, বর-বউ, বিবাহ মণ্ডপ সবই চেনা ধাঁচে সাজানো। কিন্তু বিয়ের মণ্ডপে বর-করেন সঙ্গে নেই কোনও পুরোহিত মশায় বরং তাঁর জায়গায় সাবেকি সাজপোশাকে বসে রয়েছেন একজন মহিলা। এখানেই লাগতে পারে জোর ধাক্কা। চোখে সইতে সমস্যা হতে পারে কারণ আমি, আপনি আমরা কেউই এই দৃশ্যে অভ্যস্ত নই।
সমাজের বহু নিয়ম-নীতি এমন রয়েছে বিশেষত শ্রমের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই কিছু কাজ মহিলাদের জন্য আর কিছু কাজ পুরুষদের জন্য বরাদ্দ। তবে আজ সেই দৃশ্য অনেকটাই বদলেছে, মেয়েরা আজ অ্যাপ বাইক চালানো, বাস চালানো, ট্রেন চালানোর মতো এমন অনেক কাজই করছেন যেগুলি একসময় ভাবাই যেত না। ঠিক তেমনই হল পৌরহিত্য সমাজের চিরাচরিত নিয়মের পরিপন্থী হয়েই কখনও প্রশ্ন করা হয়ে ওঠে না যে মেয়েরা কেন পৌরহিত্য করতে পারেন না।
তবে সনাতন হিন্দু ধর্মে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যকে একপ্রকার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন পৌরহিত্যের কাজকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন একদল মহিলা। যে দলের কাণ্ডারী হলেন ডঃ নন্দিনী ভৌমিক।
আমরা নুতন যৌবনেরই দূত
- ডঃ ভৌমিক ছিলেন লেডি ব্রেবোর্ন কলজের সংস্কৃতের ছাত্রী। সেখানে তাঁর অধ্যাপিকা ছিলেন গৌরি ধর্মপাল। তিনি বেদে উল্লিখিত নিয়মগুলি এক সূত্রে বঁধে এক নতুন বিবাহ পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন, যার নাম হল ‘পুরো নতুন বৈদিক বিবাহ’।
- তিনিই প্রথমে এই নিয়মে যজ্ঞ ও পৌরহিত্য করতেন। এরপর পড়াশোনা শেষ করে ডঃ ভৌমিকও অধ্যাপনা শুরু করেন। পাশাপাশি অভিনয় চলতে থাকে নাটকের দলের সঙ্গেও।
- বিয়ে হয়, পুরোদস্তুর চলতে থাকে সংসারধর্মও, জন্ম দেন দুটি কন্যাসন্তানেরও। কিন্তু এরই মাঝে তাঁর সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয় গৌরি ধর্মপালের। তিনি তখন ডঃ ভৌমিক এবং তাঁর সহপাঠী রুমা রায়কে বলেন বিবাহের পৌরহিত্য করতে। এরপর তাঁরা দীক্ষা নেন। এরপর তাঁদের সঙ্গে একে একে যোগ দেন সেমন্তী বন্দোপাধ্যায় এবং পৌলমী চক্রবর্তীরাও।
- তাঁরা সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলেন ‘শুভমস্তু’, যে দলটি গত এক দশক ধরে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, গৃপ্রবেশ এবং মুখেভাতের মতো অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন।
পুরো হিট ‘পুরোহিত’
শাস্ত্র বচন
- আগেই বলেছি কিছু কিছু পেশায় পুরুষদের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখে সেইসব পেশায় মেয়েদের প্রবেশ খানিকটা ধাক্কা দেয়। বিশেষত পৌরহিত্যের ক্ষেত্রে, কিন্তু জানেন তো শাস্ত্রের কোথাও বলা নেই যে, একজন পুরুষকেই পুরোহিত হতে হবে।
- আবার একথাও বলা নেই যে, একজন পুরোহিতকে ব্রাহ্মণ হতে হবে বা ভারতীয় হতে হবে। পৌরহিত্য করার জন্য সবার প্রথমে যেটা প্রয়োজন তা হল মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ করা এবং মন্ত্রের অর্থ বুঝে তা উচ্চারণ করা। তাঁদের গুরু গৌরি ধর্মপাল তাঁদের শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, সঠিক উচ্চারণ করে উচ্চস্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করলেই তা ফলপ্রসূ হয়।
- আরও জানলে অবাক হবেন, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের বিবাহসূক্তেই ভারতীয় পরম্পরার বিয়ের মন্ত্র লেখা রয়েছে। কিন্তু সেই মন্ত্র কিন্তু কোনও পুরুষের লেখা নয়। সূর্যা নামে এক নারী এই মন্ত্রের রচয়িতা। সেই মন্ত্র বাংলা এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন গৌরিদেবী।
- তারপর নন্দিনীদেবী এবং রুমাদেবীই পুরোহিত হিসাবে একসঙ্গে গোটা কর্মকাণ্ড সামলাতে থাকেন।
- এরপর সমাজকর্মী তথা অল ইন্ডিয়া ওমেন কনফারেন্স-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট সেমন্তী বন্দোপাধ্যায়কে যখন তাঁদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়, তিনি কোনওকিছু না ভেবেই তাঁদের দলে যোগ দেন।
- প্রায় আট বছর ধরে ‘শুভমস্তু’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর কথা নন্দিনীদেবী এবং রুমাদেবী যখন সংস্কৃত মন্ত্রের ওপর জোরদার গবেষণার কাজ করছিলেন তখন তিনি এবং পৌলমীদেবী গান-বাজনার দিকটিতে দেখভাল করতে শুরু করেন।
- তাঁরা দুজনে বাংলা এবং ইংরেজি মন্ত্রগুলির সঙ্গে জুড়ে দিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেমন্তীদেবী শান্তিনিকেতনের মেয়ে, তারওপর সংস্কৃত সম্পর্ক তাঁর কোনো সম্যক জ্ঞান নেই তাই তাঁর পক্ষে গানবাজনার দিকটা তদারকি করাই সবথেকে সহজ কাজ ছিল।
- তাঁর কথায় মন্ত্রের সঙ্গে গান-বাজনার বিষয়টি একত্র করার ফলে তা নবপ্রজন্মের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল বলেই দাবি সেমন্তীদেবীর।
- তিনি আরও বলেন, যখন নবদম্পতি বিয়ের পিঁড়িতে বলেন, তখন পুরোহিতের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরও মন্ত্রোচ্চারণ করতে বলা হয়। কিন্তু কেউ যদি মন্ত্রের সঠিক অর্থই না জানেন, তাহলে সেই মন্ত্র উচ্চারণই করে কী লাভ!
- বিবাহের অর্থ হল বিশেষভাবে বহন করা, দুজন দু’জনের মধ্যে প্রতিশ্রুতি আদান-প্রদান করা। আর সেই কারণেই যাঁরা মন্ত্র উচ্চারণ করে একে অপরের ভার গ্রহণ করছেন, তাঁদের কাছে মন্ত্রের অর্থ পরিষ্কার হওয়াটা খুবই জরুরী। সেই কারণে বৈদিক মন্ত্র বাংলা, ইংরেজি এমনকি হিন্দি ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়েছে।
- সেক্ষেত্রে অবাঙালি বিয়েতে মন্ত্রের হিন্দি অনুবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের গানের হিন্দি সংস্করণ সঞ্চালনা করা হয়।
- রবীন্দ্রনাথের গান কেন?- নারীবাহিনি মনে করেন রবি ঠাকুরের লেখা গান-কবিতা কিন্তু বেদ কিংবা উপনিষদের তুলনায় কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ধর্মগ্রন্থে বা বর্ণিত রয়েছে, কবিগুরুও সেই একই কথা বলে গিয়েছেন।
বৈদিক বিবাহ কেন আলাদা
- গৌরি ধর্মপাল যে ‘পুরো নতুন বৈদিক বিবাহ’-এর দীক্ষা দিয়েছিলেন তা সনাতনী বিবাহ থেকে বেশ খানিকটা আলাদা।
- এই বিবাহ রীতিতে লাজ অঞ্জবী, সপ্তপদী, বিবাহের মূলযজ্ঞ এবং সিঁদুরদান- ছাড়া তেমন কোনও রীতি নেই।
- আর সেইসঙ্গে প্রতিটি রীতির সঙ্গে গাওয়া হয় মানানসই রবীন্দ্রনাথের গান।
অন্ধকার ঘুচে গিয়ে নতুন আলোর ভোর
- হিন্দু বিবাহরীতিতে এমন অনেক নিয়ম-কানুনই রয়েছে, যেগুলি মানেন না এই মহিলা পুরোহিতের দল। যেমন কন্যাদান। গো আর কন্যা দানযোগ্য এমনটাই প্রচলিত।
- কিন্তু কন্যা দান করা যায় এমনটা মানতে নারাজ তাঁরা, তাই তাঁদের বিবাহরীতি অনুসারে কন্যাদানের কোনও আচার নেই।
- শুধু তাই নয়, বিয়ের সময় মাকে সন্তানের বিয়ে দেখতে নেই- এমন নিয়মও প্রচলিত, কিন্তু তাঁদের দাবি প্রাচীনকাল থেকে বাড়িতে অতিথি আসলে অতিথি সৎকারের দায়িত্ব মায়ের ওপরেই এসে পড়ত।
- তাহলে সন্তানের এমন শুভ দিনে কেন মা থাকতে পারবেন না, কীসের জন্য এত বড় ত্যাগ স্বীকার, তাও আবার আজকের দিনে!? এ প্রশ্নও তিনি ছুঁড়ে দিয়েছেন সমাজের সামনে।
মন্তব্য করুন