সৌন্দর্য রক্ষায় আয়ুর্বেদের জনপ্রিয়তা সবার ওপরে। সে হোক চুল বা ত্বক। বিশেষ করে সুন্দর চুলের ক্ষেত্রে আয়ুর্বেদের থেকে ভালো বোধহয় আর কিছু হয় না। নিমেষেই চুলের যে কোনো সমস্যা সারিয়ে, চুলকে সুন্দর করে তোলে। যারা চুলের সমস্যায় ভুগছেন বা সুন্দর চুলের সন্ধানে আছেন, তাদের জন্য রইল খুব সহজ কিছু আয়ুর্বেদিক ট্রিটমেন্ট। জাস্ট চোখ বুজে করে ফেলুন এগুলো, ব্যাস কিছুদিন পর আপনার চুল থাকবে সবার নজরে।
ভৃঙ্গরাজ

ভৃঙ্গরাজকে বলা যায় চুলের রাজা। এই একটা জিনিস চুলের সবরকম ট্রিটমেন্ট করে। শুধু চুলের গ্রোথ ঘটায় না, সাথে চুল পড়া তো কমায়ই এবং চুলের অকালপক্কতাও সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা সঠিক ভাবে ঘুমোতেও সাহায্য করে।
উপকরণ
বেশ কয়েকটি ভৃঙ্গরাজ পাতা বা ৫ থেকে ৬ চামচ ভৃঙ্গরাজ পাউডার।
পদ্ধতি
যদি ভৃঙ্গরাজ পাতা জোগাড় করতে পারেন, তাহলে ভৃঙ্গরাজ পাতা জলে বেটে নিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। না হলে ভৃঙ্গরাজ পাউডার জলে গুলে নিন। এবার এই ঘন পেস্ট স্ক্যাল্প সহ চুলে লাগান। ২০ মিনিট মত রাখুন। তারপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। এটা সপ্তাহে তিনদিন যদি করতে পারেন তাহলে, শুধু চুল পড়া কমবে না, চুলের গ্রোথও বাড়বে।
আমলকী
আমলকী শুধু চুল পড়া কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয় না। খুশকির মত বিরক্তিকর সমস্যাকে সহজেই বাই বাই বলতে পারবেন আমলকীর হাত ধরে। এতে আছে বিভিন্ন রকমের ভিটামিন, মিনারেল বিশেষত ভিটামিন সি, যেটা একটা প্রাকৃতিক হেয়ার টনিক। স্ক্যাল্পের রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখে। চুলকে হেলদি ও মজবুত করে এবং কন্ডিশনিং করে। যদি রোজ একটা আমলকী খাওয়া যায়, তাহলে চুলের সাথে সাথে শরীরও থাকবে হেলদি।
উপকরণ
৫ থেকে ৬ চামচ আমলকী পাউডার ও একটু জল।
পদ্ধতি
একটু জলে আমলকী পাউডার গুলে নিন। চুল ভাগ করে নিন কয়েকটি অংশে। প্রতি অংশে ঘন পেস্ট লাগান। ২৫ থেকে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিনদিন করুন দ্রুত ভালো ফল পেতে। এছাড়াও আমলকীর পাউডারের সাথে দই, হেনা পাউডার ও ব্রাক্ষ্মি পাউডার মিশিয়েও লাগাতে পারেন।
নিম
চুল থেকে ত্বক সবকিছুকেই হেলদি রাখতে, নিমের ব্যবহার বহু বছর ধরে হয়ে আসছে। এটা চুলকে হেলদি তো রাখেই, তার সাথে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল রূপে কাজ করে, যেটা খুশকি, স্ক্যাল্পের অন্যান্য সমস্যা যেমন চুলকানি, ফুসকুড়ি এসব কমায়, এমনকি উকুনও।
উপকরণ
অনেকগুলি নিম পাতা ও ২কাপ জল।
পদ্ধতি
একটা পাত্রে জল ফোটান। এবার এতে নিম পাতা দিন। নিম পাতাসহ জল ফোটান ১৫ থেকে ২০ মিনিট। তারপর জলকে ঠাণ্ডা হতে দিন। মাথা ধুয়ে নিয়ে, সব শেষে এটা দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। এই নিমের জল দিয়ে সপ্তাহে তিনদিন চুল ধুয়ে ফেলুন। ব্যাস চুলের সমস্ত সমস্যা গায়েব।
অ্যালোভেরা
আয়ুর্বেদে নিমের মত অ্যালোভেরার ব্যবহারও বহুদিনের।
উপকরণ
হাফ কাপ অ্যালোভেরা জেল, ২চামচ মধু ও ২চামচ নারকেল তেল।
পদ্ধতি
সমস্ত উপকরণগুলো ভালো করে মিশিয়ে নিন। এটা স্ক্যাল্পসহ গোটা চুলে ভালো করে লাগান। আধঘণ্টা রেখে দিন। তারপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। সপ্তাহে এক বা দুদিন করুন।
ব্রাক্ষ্মি
ব্রাক্ষ্মি কিন্তু শুধু স্মৃতিশক্তি বাড়ায় না। চুলের জন্য এটা কিন্তু জাস্ট অনবদ্য। কারণ এটা চুলের গোড়া মজবুত করে ও নারিশ করে। তার ফলে চুলের বৃদ্ধি তো ঘটেই। যদি ব্রাক্ষ্মি রোজ ব্যবহার করা যায়, তাহলে চুল শুধু ঘনই হবে না, স্ক্যাল্পে হবে খুশকি ও জট মুক্ত এবং সাইনি।
উপকরণ
২চামচ ব্রাক্ষ্মি পাউডার, ২চামচ আমলকী পাউডার, ২চামচ অশ্বগন্ধা পাউডার ও হাফ কাপ টকদই।
পদ্ধতি
সব উপকরণগুলো মিশিয়ে নিন। এবার এই পেস্ট পুরো চুলে ভালো করে লাগান। আধঘণ্টা অপেক্ষা করুন। তারপর চুল একদম হালকা গরমজলে ধুয়ে শ্যাম্পু করে ফেলুন। জল যেন বেশী গরম না হয়। তাহলে চুলের ক্ষতি হবে। এটা সপ্তাহে দু থেকে তিনদিন করুন পাউডার না পেলে। সেক্ষেত্রে একটু পাত্রে অনেকটা জল নিয়ে, ব্রাক্ষ্মি শাক, তুলসি ও নিম পাতা ভালো করে ফোটান। জল সবুজ হয়ে গেলে নামিয়ে নিন। এটা সারারাত রেখে দিন। পরদিন সকালে এই জল দিয়ে চুল ধুয়ে নিন।
রিঠা
রিঠা আগে ব্যবহার হতো প্রাকৃতিক শ্যাম্পু হিসাবে। এটা চুলের গ্রোথ তো বাড়ায়ই, সাথে চুলের টেক্সচার উন্নত করে। চুলে ভলিউম আনে। চুলকে শুকিয়ে যেতে দেয় না।
উপকরণ
হাফ কাপ রিঠা ও দু কাপ জল।
পদ্ধতি
দুকাপ গরমজলে হাফ কাপ রিঠা ভিজিয়ে রাখুন সারারাত। পরদিন সকালে ওই জলেই রিঠা ফোটান। ১৫ মিনিট মত ফুটিয়ে নিয়ে মানিয়ে রাখুন। এবার চুল আগে ধুয়ে নিন। তারপর এই রিঠা জল স্ক্যাল্প সহ চুলে লাগান। ম্যাসাজ করুন ৫ মিনিট। মানে শ্যাম্পু করুন। তারপর মাথা ধুয়ে নিন। সপ্তাহে এক বা দুদিন রিঠা দিয়ে শ্যাম্পু করুন। একমাস পর চুলের তফাৎটা বুঝতে পারবেন।
শিকাকাই
রিঠার মত আরেকটি প্রাকৃতিক শ্যাম্পু হল শিকাকাই, যেটা প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যেটা স্ক্যাল্পকে ভালো রাখে। চুল পড়া কমায়, সাথে ফ্রিজি চুলকে ঠিক করে। খুশকি কমাতেও সাহায্য করে।
উপকরণ
৬চামচ শিকাকাই পাউডার ও ২কাপ জল।
পদ্ধতি
এটাও সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। পরেরদিন সকালে চুল ধুয়ে নিন। তারপর শিকাকাই জল দিয়ে চুল শ্যাম্পু করুন। শিকাকাই জল দিয়ে ১০ মিনিট মত স্ক্যাল্পসহ চুলে ম্যাসাজ করুন। তারপর মাথা ধুয়ে নিন। এটাও সপ্তাহে এক বা দুদিন ব্যবহার করুন।
অশ্বগন্ধা
অশ্বগন্ধা এমনই একটা উপাদান, যেটা মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি সব ভালো রাখে। অর্থাৎ চুল তো আছেই, সাথে শরীর ও মনও ভালো রাখতে সাহায্য করে। চুলের স্বাস্থ্য উন্নত করতে তো এর জুড়ি নেই। বিশেষ করে খুশকির সমস্যায় জাস্ট অনবদ্য।
উপকরণ
৩চামচ অশ্বগন্ধা পাউডার, ২চামচ আমলকী পাউডার ও একটু জল।
পদ্ধতি
অশ্বগন্ধা ও আমলকী পাউডার জল দিয়ে গুলে নিন। এবার এই মিশ্রণ স্ক্যাল্পসহ পুরো চুলে ভালো করে লাগান। আধঘণ্টা রাখুন। তারপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। সপ্তাহে দু থেকে তিনদিন এটা করুন।
জটামাসি
আয়ুর্বেদে অনেক পুরনো নাম হল জটামাসি। এটা রক্ত পরিশুদ্ধ করে ও স্ক্যাল্পের রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে। তার ফলে চুলের বৃদ্ধি ঘটে।
উপকরণ
৫ থেকে ৬ ফোঁটা জটামাসি এসেন্সিয়াল ওয়েল ও ২চামচ নারকেল তেল।
পদ্ধতি
দুটো তেল ভালো করে মিশিয়ে নিন। এটা স্ক্যাল্পে ভালো করে ম্যাসাজ করে লাগান। স্নানের একঘণ্টা আগে লাগান। তারপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। সপ্তাহে দু থেকে তিনদিন শ্যাম্পুর আগে এটা করতে পারেন।
মেথি
চুলের ক্ষেত্রে মেথির উপকারিতা আর নতুন করে কিছু বলার নেই। বাজারের বিভিন্ন হেয়ার অয়েলেই মেথি ব্যবহার করা হয়। চুল পড়া সমস্যায় জাস্ট অনবদ্য কাজ করে মেথি। সাথে খুশকিও নিয়ন্ত্রণ করে।
উপকরণ
২ থেকে ৩ চামচ মেথি।
পদ্ধতি
মেথি আগেরদিন রাতে পরিষ্কার জলে ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন এটার পেস্ট করে নিন। এই পেস্ট স্ক্যাল্পসহ গোটা চুলে ভালো করে লাগান। ২০ মিনিট মত রাখুন। তারপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। এটা সপ্তাহে দুদিন নিয়ম করে করুন। একমাস পর দেখবেন চুল পড়া গায়েব।
হট অয়েল ম্যাসাজ
হট অয়েল ম্যাসাজ এটা একটা বহু পুরনো ট্রিটমেন্ট চুল ভালো রাখতে। তেল একটু গরম করে ম্যাসাজ করলে, স্ক্যাল্পের রক্তসঞ্চালন উন্নত হয়। সাথে হেয়ার ফলিকলকে রিজুভিনেট করে ও চুলের গোড়া মজবুত করে।
পদ্ধতি
যে কোনো তেল যেমন নারকেল, মেথি, আমলা বা ভৃঙ্গরাজ জাস্ট একটু গরম করে নিন। এই গরম তেলটা স্ক্যাল্পে ভালো করে ম্যাসাজ করে লাগান।
খাদি আমলা রিঠা শিকাকাই ভৃঙ্গরাজ পাউডার, (১০০ গ্রাম, চারটে)
অন্য টিপস
শুধু ভালো তেল ও শ্যাম্পু ব্যাবহারেই ভালো চুল পাওয়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় মনে রাখা দরকার।
১ চুল ভিজে অবস্থায় আঁচড়াবেন না এবং চুলে খুব বেশী রোদ লাগাবেন না।
২ উপযুক্ত রেস্ট দরকার। রাতে রোজ আটঘণ্টা ঘুম অবশ্যই দরকার।
৩ পেট পরিষ্কার রাখুন। তাই প্রচুর জল খান। সকালে খালি পেটে দু গ্লাস অবশ্যই। এতে শরীর পরিষ্কার থাকে। সাথে শাকসবজি।
৪ খুব বেশী স্ট্রেস থেকেও চুল পড়ে।
৫ চুলে বাজারের ক্ষতিকর প্রোডাক্ট বেশী ব্যবহার করবেন না। যতটা পারেন প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করুন।
চুল পড়া বন্ধ করা কিন্তু এবার বাঁ হাতের খেল। শুধু এই টিপসগুলো ফলো করার পালা।
মন্তব্য করুন