কর্মব্যস্ত ঢাকা শহরে একটুখানি অবসর বা বিনোদন পেতে মানুষ ছুটে কফিশপের পানে। উদ্দেশ্য, কফি খাওয়ার ফাঁকে কিছুটা নিরিবিলি সময় কাটানো, যাতে শরীর ও মন দুই-ই চাঙ্গা করা যায়। ১০ বছর আগেও যেখানে কফি খাওয়ার এত চল ছিল না, সেখানে বর্তমানে ঢাকার সমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে অনেক নামীদামী কফি শপ।
তবে কফিশপগুলো শুধু কফিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বৈচিত্র্য হিসেবে যোগ হয় নানা মুখরোচক খাবারও। এসব জায়গায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দেয়া ছাড়াও পরিবার নিয়েও যেন সময় কাটানো যায় সেভাবেই ডেকোরেশন করা থাকে। আর তার সাথে যদি যোগ হয় লাইভ মিউজিক বা ভিন্ন কিছু, তাহলে তো কথাই নেই। কিছু শপ আবার মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
কথা বলব ঢাকা শহরের সেরা ১০টি কফিশপ নিয়ে, যেখানে ঘুরতে যাওয়া যেমন আবশ্যক তেমনই এককাপ কফির স্বাদ নেয়াটাও জরুরি। তো চলুন পড়ে ফেলি সেই ১০টি কফিশপের আদ্যোপান্ত।
ক্রেম ডে লা ক্রেম
গুলশানে অবস্থিত ক্রেম ডে লা ক্রেম কফিপ্রেমীদের পছন্দের শীর্ষে থাকবে সবসময়। কি নেই এখানে? ঘ্রাণে মাতোয়ারা করা কফি থেকে শুরু চা, সুস্বাদু স্ন্যাকস, ফাস্টফুড, কন্টিনেন্টাল খাবার তো আছেই। তার সাথে আলো-আঁধারির মোহনীয় ইন্টেরিয়র আর লাইভ মিউজিকের সাথে আপনার অলস সন্ধ্যাটা কাটবে জমজমাট। শপের ভিতরে থাকা কফি বুটিকে পেয়ে যাবেন নানা ডিজাইনের ডিজাইনার আউটফিটস।
এখানকার মূল আকর্ষণ হচ্ছে সরাসরি জাপান থেকে আমদানি করা কফির বীজ থেকে তৈরি কফি। আরো আছে সর্বাধুনিক এসপ্রেসো কফি মেশিন। ক্রেম ডে লা ক্রেমে হাতে বানানো চার ধরণের কফি পাবেন আবার মেশিনে তৈরি কফিও খেতে পারবেন।
ক্যাপুচিনো, এসপ্রেসো, লাতে, মোকা, আমেরিকানো, ভি-সিক্সটি, সাইফন, পোরওভারসহ কম করে হলেও ১৫টি ভিন্ন স্বাদের কফি পাবেন এই কফিশপে। কফির পাশাপাশি পাবেন বিভিন্ন স্বাদের চা-ও। অন্যান্য খাবারের মধ্যে আছে ২৬টি জাপানিজ মেনু এবং পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, স্টেক ইত্যাদি ধরণের কন্টিনেন্টাল খাবার। এই কফিশপটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে জাপানিজ স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে বিশ্বমানের এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন করা।
সময়সীমাঃ
প্রতিদিন শপটা খোলা থাকে সকাল ৭:৩০ মিনিট থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।
ঠিকানাঃ
প্লট নং ৩৩, রোড নং ৪৬, গুলশান ২ (ওয়েস্টিন হোটেলের পাশে), ঢাকা – ১২১২
সুগার অ্যান্ড কো
সুগার অ্যান্ড কো কফিপ্রেমীদের জন্য নিয়ে এসেছে অথেনটিক কোয়ালিটির কফি এবং আমেরিকান খাবারের স্বাদ। এটা মূলত একটি আমেরিকান বেকারি এবং কফিশপ চেইন, যেটা বাংলাদেশে তাদের শাখা খুলেছে। শপের অন্দরে পাবেন হরেক রকমের কফি ও সুস্বাদু খাবার, তাও আবার বাজেটের মধ্যেই।
এই কফিশপ কাম রেস্টুরেন্টে হালকা ধরণের খাবারের পাশাপাশি সকালের নাস্তা, দুপুরের লাঞ্চ, এবং রাতের খাবারেরও আয়োজন আছে। ইন্টেরিয়রটা যথেষ্ট নিরিবিলি, ছিমছাম, এবং সাজানো। চাইলেই বন্ধুবান্ধব বা পরিবার নিয়ে আড্ডা দিতে পারবেন অনায়াসেই।
৪০টির বেশি আইটেমের মধ্যে কফি আছে ৭ রকমের – ক্যাপুচিনো, লাতে, ফ্লেভারড লাতে, আমেরিকানো, হোয়াইট মোকা, ক্যাফে মোকা, এবং হট চকলেট। পেস্ট্রি মেনুতে পাবেন নিউটেলা কাপকেক, কিটক্যাট কাপকেক, রেড ভেলভেট কাপকেক, পিনাট বাটার কাপকেক, রেড ভেলভেট চিজকেক, চিজকেক স্লাইস, অরিও চিজকেক, বানোফি পাই, এবং চকলেট প্যারাডাইজ।
এখানে খেতে আসলে তাদের সিগনেচার ডিশ মাশরুম স্টেকটা টেস্ট করতে যেন ভুলবেন না। মেইন কোর্সে আরো থাকছে বারবিকিউ চিকেন, চিকেন পারমিজানো, গ্রিলড স্পাইসি চিকেন, মাশরুম পিকাতা, চিকেন কর্ডন ব্লিউ, গ্রিলড ফিশ ফিলে, ফিশ অ্যান্ড চিপস ইত্যাদি।
ফাস্টফুডে আছে বার্গার, পিৎজা, পাস্তা, সালাদা, স্যান্ডউইচ, ওয়েফার আইটেম। এছাড়া প্রতিদিন তারা আয়োজন করে দুইটা ভিন্ন স্বাদের ডেজার্ট। এক কথায়, ছোটখাট গেট-টুগেদার বা মিটিং করার জন্য দারুণ একটি কফিশপ সুগার অ্যান্ড কো।
সময়সীমাঃ
সকাল ১১টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত
ঠিকানাঃ
বনানী ১১নং রোড, জেনেটিক পয়েন্ট ভবনের দ্বিতীয় তলা।
বারিস্তা লাভাজ্জা
সুন্দর ও মনোরম পরিবেশের বারিস্তা লাভাজ্জা যেমন মনে আনবে প্রশান্তি তেমনি আপনার অবসর সময়টা করবে মুখরোচক, তাজা কফি ও সুস্বাদু স্ন্যাকসের সাথে। আন্তর্জাতিক মানের সব ধরণের কফি পাবেন এই ইতালিয়ান কফিশপে।
আপনার রেগুলার পছন্দের কফিকেই একটু ভিন্ন ধাঁচে ও স্বাদে খেতে পাবেন এখানে। আমেরিকানো, লাতে, এসপ্রেসো, মোকা কফির বৈচিত্র্যময় স্বাদ বারিস্তা লাভাজ্জা ছাড়া আর কোথাও পাবেন না। স্বাদের পরিপূর্ণতা দিতে বারিস্তারা তাজা কফি বিন থেকেই তৎক্ষণাৎ কফি বানিয়ে দিবে। এখানকার মূল আকর্ষণ হচ্ছে মাফিন, হরেক স্বাদের মাফিন জিভে জল আনতে বাধ্য।
কফি ও মাফিনের পাশাপাশি বাজেটের মধ্যে আরো পাবেন পেস্ট্রি ও স্যান্ডউইচের নানা আইটেম। গুলশান অ্যাভিনিউ, উত্তরা, কাওরান বাজার, ও বিমানবন্দর এলাকায় বারিস্তা লাভাজ্জার শাখা রয়েছে।
সময়সীমাঃ
সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।
ঠিকানাঃ
বাড়ি নং এসই (এফ), ১ গুলশান অ্যাভিনিউ।
বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা
নাম থেকেই আঁচ করা যায় এখানে কফি বিন নিয়ে বাড়তি কারিশমা দেখানো হয়৷ ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা বিনস অ্যান্ড অ্যারোমার বিশেষত্ব হচ্ছে কফি তৈরির প্রক্রিয়া। এখানে ব্রাজিলে উৎপাদিত কফি বিশেষভাবে প্রস্তুতকরণের মাধ্যমে কফি পরিবেশন করা হয়। অন্যান্য কফিশপের চাইতে এই শপটি সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে কফি বিন রোস্টিংয়ের কাজটা করে।
কফির সবুজ ফলকে রোস্টিংয়ের মাধ্যমে কফি বিন বের করে তিন সপ্তাহের মধ্যে তাজা কফি তৈরি করেন পরিবেশকরা। কারণ এই তিন সপ্তাহের মধ্যেই বিনের স্বাদ ও মান অটুট থাকে, যার ফলে আসল কফির স্বাদ পাওয়া সম্ভব৷ অন্য কফিশপে বছরের পর বছর রোস্টেড বিন ব্যবহার করে। ততদিনে আসলে কফির পরিপূর্ণ স্বাদটা পাওয়া সম্ভব হয় না।
এমন জাদুকরী স্বাদের কফি খেতে চাইলে আপনাকে আসতে হবে বিনস অ্যান্ড অ্যারোমায়। অবশ্য এখানে কফির রকমভেদ কম পাবেন। এসপ্রেসো, ক্যাপুচিনো, মোকা কফির সাথে খাবারের মধ্যে পাবেন স্মোকড চিকেন স্যান্ডউইচ, চিকেন ও ভেজিটেবল রোল ইত্যাদি। আবার লাঞ্চ ও ডিনারের সুব্যবস্থাও আছে।
সময়সীমাঃ
সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।
ঠিকানাঃ
বাড়ি নং ৯, রোড নং ১৮, সেক্টর ৩, উত্তরা, ঢাকা ১২৩০
গ্লোরিয়া জিন’স কফি
সবুজ পরিবেশ আর মিউজিকের মধ্যে বসে কফি খেতে চাইলে চলে আসুন গ্লোরিয়া জিন’স কফিতে৷ শপের অ্যারেঞ্জমেন্ট আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দিবে নিশ্চিত। নানা রকমের সবুজ গাছের সমাহারে মনেই হবে না যে কফিশপে বসে কফি খাচ্ছেন। বাইরে পিছনের দিকটায় এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকলেও ভিতরটাও কিন্তু কম সুন্দর না।
কফিশপের দোরগোড়ায় পা রাখতেই কফির মাতাল করা ঘ্রাণ আপনাকে ভিতরে না নিয়ে ছাড়বে না। ভিতরে সুবিধাজনক বসার ব্যবস্থায় আরামসে কফি খেতে পারবেন। বড় টেবিলের পাশাপাশি ছোট টেবিলও রাখা আছে, চাইলেই বন্ধুবান্ধব বা পরিবার নিয়ে কফির স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।
কফি খেতে খেতে বোস সাউন্ড মিউজিকে বাজতে থাকা সুরের মূর্ছনায় কখন যে সময় কেটে যাবে টের পাবেন না। এখানকার স্ন্যাকসও অনেক মজাদার। কফি ও স্ন্যাকসের দাম থাকবে হাতের নাগালের মধ্যেই।
সময়সীমাঃ
সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা।
ঠিকানাঃ
বাড়ি নং ৩৫, গুলশান অ্যাভিনিউ, ঢাকা ১২১২।
ব্রোনিয়া ক্যাফে অ্যান্ড গ্যালারী
ব্রোনিয়া ক্যাফে অ্যান্ড গ্যালারী সব কফিশপ থেকে একেবারে আলাদা, কারণ এখানে কফির সাথে সাথে অপূর্ব চিত্রকর্মও উপভোগ করতে পারবেন। একজন চিত্রশিল্পী এখানে অতিথিদের জন্য ছবি আঁকেন প্রায়ই। তারই শিল্পকর্ম পুরো দেয়ালজুড়ে রাখা আছে শপের ভিতরে। কফি খেতে খেতে ঘুরে দেখতে পারবেন সব চিত্র।
কফির ক্ষেত্রে খুব একটা বৈচিত্র্য নেই। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কফি বিন থেকে তৈরিকৃত কফি পরিবেশন করা হয়। তার সাথে স্টারবাকসের কয়েকটা রোস্টিংয়ের ব্যবহার চলে। তবে ক্যাপুচিনোটা ট্রাই না করলেই নয়। এই ক্যাফের আরেকটি বড় আকর্ষণ হল এর বিনোদনমূলক ব্যবস্থা।
ক্যাফের পাশে আলাদা একটি মুভি দেখার রুম আছে। প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে একদম বিনা পয়সায় মুভি দেখতে পারবেন। আবার বড়দের পাশাপাশি ছোটদের নিয়েও মুভি দেখা যাবে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট একদিন শিশু বান্ধব মুভি প্রদর্শনী হয়।
সময়সীমাঃ
সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত।
ঠিকানাঃ
খ-৪৭-১ (দ্বিতীয় তলা), প্রগতি সরণী, নতুন বাজার, গুলশান, ঢাকা-১২১২
জর্জ’স ক্যাফে
অদ্ভুত বিষাদময় সৌন্দর্যের জন্য জনপ্রিয় জর্জ’স ক্যাফে। প্রবেশমুখে দেখা মিলবে কলাগাছের, অন্দরসজ্জায় কালো রঙের ব্যবহার বেশি। কফি ও স্ন্যাকসের সাথে নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য জর্জ’স ক্যাফে বেশ চমৎকার একটা কফিশপ।
দিনের বেলায় বাইরে থেকে আসা আলো আর ভিতরের আলোর সাথে গাছের সবুজের কানামাছি খেলা চলে, যা দেখতে বেশ লাগে। নিউইয়র্কের বাসিন্দা জর্জ স্মিথ বাংলাদেশের কয়েকজন তরুণ অংশীদারকে নিয়ে খুলে ফেলেন এই জর্জ’স ক্যাফে। স্মিথ কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। কাজ করেছিলেন কিছু রেঁস্তোরায়। তাই কফি থেকে শুরু করে স্ন্যাকসে পাওয়া যায় তার বাহারি প্রতিফলন।
হরেক পদের কফির মধ্যে পাবেন এসপ্রেসো, মাকিয়াতো, আমেরিকানো, হট অ্যান্ড কোল্ড কফি। স্ন্যাকসের মেনুতে আছে হট ডগ, বারবিকিউ চিকেন, চিকেনরোল, বার্গার, চিকেন স্যান্ডউইচ ইত্যাদি। যদি এখানে কোনদিন খেতে আসেন, তবে তাদের হট ডগ, সসি ডিলাইট বার্গার, বারবিকিউ চিকেন স্যান্ডউইচ অবশ্যই ট্রাই করে দেখবেন। ব্রাউনি আর বিভিন্ন স্বাদের কাপকেকও থাকছে ডেজার্ট আইটেম হিসেবে।
সময়সীমাঃ
সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত (বর্তমানে বন্ধ আছে)।
ঠিকানাঃ
বাড়ি ২, রোড ১০, সেক্টর ১, উত্তরা।
শেষ কথা
এই ১০টি কফিশপের বাইরেও অলিগলিতে পাবেন প্রচুর কফিশপ। সব তো তালিকায় রাখা সম্ভব না, তবে মানের দিক থেকে সেগুলো কম হলেও মধ্যবিত্তদের নাগালের মধ্যেই থাকে। রাত বাড়লে ঢাকার আসল সৌন্দর্য লক্ষ্য করা যায় অভিজাতপাড়ার এইসব শপগুলোতে। কাজেই সময় পেলে কোনদিন ঘুরে আসবেন পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে। সময় ভাল কাটবে, খাবার উপভোগ করতে পারবেন।
মন্তব্য করুন