বাল্যবিবাহ যে অনুচিত এ নিয়ে প্রথম বিতর্ক দেখা দিয়েছিল উনিশ শতকে। ভারত তখন ইংরেজের অধীন। বাল্যবিবাহের বিপক্ষে বিদ্যাসাগর তখন শুরু করেছিলেন আন্দোলন। পরে বাল্যবিবাহ কমলেও আজও বাংলাদেশে কিন্তু বাল্যবিবাহের হার যথেষ্টই বেশী। ভারত যখন স্বাধীন হয়নি, তখন, সেই ১৯২৯ সালে বাংলাদেশে চালু হয়েছিল বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ব্যাপক। সেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের কম বয়সে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে যে সমস্ত দেশে বাল্যবিবাহের হার সবথেকে বেশী, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সেখানে প্রতি ৩ টি বিয়ের ২ টির ক্ষেত্রেই মেয়েটির বয়স থাকে ১৮-র নিচে। এবং কম বয়সে বিয়ে হবার কারণে এক্ষেত্রে সন্তানের জন্মও তাড়াতাড়ি হয়, ফলে মায়ের স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে যায় ও মায়ের ও শিশুর মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ও পিতা-মাতা সহ সকলেই এই বিয়ের জন্য শাস্তি পায়।
বাল্যবিবাহের কারণ
বাংলাদেশের মেয়েদের অধিকাংশ সময়েই ধর্ম ও সামাজিক নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। তবে সাধারণত এই প্রবণতা গ্রামেই বেশী দেখা যায়। কারণ গ্রামে অশিক্ষা বেশী। স্কুলছুট মেয়েদের সংখ্যাও গ্রামে বেশী। আর শহরে শিক্ষার ফলে সচেতনতা বাড়ছে। ফলে শহরে বাল্যবিবাহের হারও বেশ কম। তাছাড়া কম বয়েসি মেয়েকে অনেকে যৌতুক ছাড়া বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ফলে দরিদ্র বাবা-মাও মেয়েকে কম বয়সে আগুপিছু না ভেবেই বিয়ে দিয়ে দেন। মেয়ে হওয়া মানেই যে সর্বনাশ হওয়া, মেয়ে মানেই যে দায়িত্ব—এই ভয় থেকেও বাবা-মারা কম বয়েসে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন।
উনিশ শতকে যখন বাল্যবিবাহ আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল, তখন বাল্যবিবাহের পেছনে একটা বড় কারণ ছিল কম বয়সেই মেয়েদের দেহ ও মনের দখল নেওয়া, তাকে নিজের মতো করে উপযুক্ত করে গড়ে নেওয়া। বাংলাদেশের বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রেও আমরা এটা একটা কারণ বলে ধরে নিতে পারি। কারণ একটা মেয়েকে অন্য বাড়ি থেকে এনে ‘নিজের’ মতো করে গড়ে নেওয়ার, নিজের মতো করে চালানোর একটা প্রবণতা তো আমরা সবসময়েই দেখতে পাই। তাছাড়া বাল্যবিবাহ মানেই তো একভাবে মেয়েদের স্বাধীনতার চেষ্টাকে দমিয়ে রাখা।
বাল্যবিবাহের কুফল
বাল্যবিবাহের সময় মেয়েদের বয়স ১৮-র কম থাকে বলে তার দেহ সন্তানধারণের উপযুক্ত হয় না। কম বয়সেই সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ও অনেকসময়েই সন্তানধারণে বাধ্য হয়।
অপুষ্টির ফলে শিশু ও মায়ের মৃত্যু তাই বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনা। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রায় ৩২.৭৪ শতাংশ মা শারীরিক সমস্যা ও ৫১.৫১ শতাংশ মা অপুষ্টিতে ভোগে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে
বর্তমানে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন এন.জি.ও. ও সরকার কাজ করছেন। তবে এক্ষেত্রে একসাথে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, তাহলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করে, বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বুঝিয়েও তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে দেশের মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
মন্তব্য করুন