ছোট থেকেই বড় হয়ে কি হবে এই নিয়ে অনেকের দুচোখে রঙিন স্বপ্ন থাকে। যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষক বা অফিসার ইত্যাদি। তবে যারা মাটির মায়া কাটিয়ে আকাশ ছোঁওয়ার প্রত্যাশায় থাকেন তাদের কাছে এয়ার হোস্টেস বা বিমানসেবিকার জব যে মেঘ না চাইতেই জল সেকথা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
যাত্রীদের আবশ্যকীয় নিয়মকানুন সম্পর্কে অবগত করানো, আপত্কালীন ব্যবস্থা নিয়ে জানানো, দেখভাল করা সবই তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শত ঝঞ্ঝাট এর মধ্যেও সর্বদা হাসিমুখে তাদের কাজ করে যেতে হয়। চলুন, জেনেনি আজ এই বিশেষ পেশায় আসতে গেলে কি কি করতে হবে আপনাকে।
জব প্রোফাইল:
- এই পেশায় যারা আসতে চান তাদের একটা ভালো পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন। যোগদানের আগে জব প্রোফাইল সম্বন্ধে একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকলে ভবিষ্যতে কাজকর্মে অনেকটাই সুবিধে হয়।
- বিমানসেবিকাদের ওয়েট্রেস অফ দ্য এয়ার বলা হয়ে থাকে। চলাফেরা, কথাবার্তা, সেবাদান সবকিছুই কঠোর নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এই স্মার্ট কেরিয়ারে।
- উপস্থিতি যথেষ্ট গোছালো ও ব্যবস্থাপনার নিঁখুত বৈশিষ্ট আরোহীদের কমফর্টেবল অনুভুতি ও স্বাচ্ছন্দ বিধান করা আনুসঙ্গিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। চুলের ফ্যাশন ও মেকাপ বিশেষ যত্নে গড়ে তুলতে হয়।
- বিজ্ঞাপনে বিমানসেবিকাদের দেখতে ঝকঝকে লাগলেও আদপে এটি একটি নিষ্ঠায় ভরা,ডেডিকেশন এ পূর্ণ একটি কাজ। স্ট্যান্ডার্ড মাইনে,স্বতন্ত্র শর্ত, সেলিব্রিটি ম্যানেজমেন্ট,নামিদামি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে মেলামেশা, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ ও অত্যাধুনিক গ্ল্যামার এই জবকে আর পাঁচটা কাজের থেকে আলাদা পরিচিতি দেয়।
প্রমোশন:
দশ বছর কাজের পর এই জবে পদোন্নতির সুযোগ পাওনা যায়। এয়ারহোস্টেস পদ এর পর গ্রাউন্ড হোস্টেস, চেক হোস্টেস বা এয়ারহোস্টেস ট্রেনার ইত্যাদি পদে যোগদান করা যায়।
যোগ্যতার মাপকাঠি:
১) একাডেমিকস:
যেকোনো শাখার গ্রাজুয়েটরা বা ১০+২ যোগ্যতার ভিত্তিতেই এই চাকরিতে পা রাখা যায়।
২) বয়স:
যেহেতু এই জবে তারুণ্যকে সামনে রেখে পরিষেবার মানদন্ড নির্ধারিত হয় তাই এর বয়সের সময়সীমা থাকে ১৮-২৬। তাই অনেকটা আগে থেকেই এর জন্য তৈরী হয়ে থাকা ও পরিকল্পনা ঠিক করে নেওয়া দরকার। এস্পিরেন্টকে অবিবাহিত হতে হয়।
৩) উচ্চতা:
একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় উড়ান এর জন্য শারীরিক উচ্চতা গুরুতপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। সেই জন্য মিনিমাম ১৫৭.৫ সেন্টিমিটার বা ৫.১৬ ইঞ্চি উচ্চতা ধার্য করা হয়ে থাকে।
৪) দৃষ্টি:
কাজের সংশ্লিষ্ট চাহিদার কারণেই আইসাইট প্রখর হওয়া শ্রেয়। দুটি চোখেই দৃষ্টিশক্তির পরিমাপ ৬/৬ বা ৬/২৪ হতে হয়। বর্ণান্ধতা থাকা চলবেনা।
৫) ভাষাজ্ঞান:
এয়ার লাইন্স এর পরিধি সারাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকায় কথোপকথন এর জন্য ও অনান্য আনুসঙ্গিক কাজ করার জন্য ইংরেজি বলতে, লিখতে ও পড়তে খুব ভালোভাবে জানা দরকার। এছাড়াও বিদেশী কিছু ভাষা যেমন রাশিয়ান, জার্মান, ফ্রেন্চ ইত্যাদি জানা থাকলে বা এগুলোর উপর কোর্স করা থাকলে অগ্রাধিকার পাওয়া যায়।
৬) ফিটনেস:
সম্পূর্ণ শারীরিক সুস্থতা একান্তভাবেই কাম্য। বহাল করার আগে মেডিকেল টেস্ট করিয়ে নেওয়া হয় তাতে উত্তীর্ণ হতে হয়। কোনোরকম মানসিক অসুস্থতার রেকর্ড থাকা যাবে না।
৭) অনান্য:
- ক্যান্ডিডেট এর ভারতীয় পাসপোর্ট থাকা দরকার।
- ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং এর কারণ এ বা জরুরি আপত্কালীন পরিষেবা দিতে তথা যাত্রীদের সুরক্ষা ও উদ্ধার কাজের জন্য সাঁতার শিখে রাখা বাধ্যতামূলক। যেমন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এ ৫০ মিটার অব্দি সাঁতার কৌশল জেনে রাখতে হয়।
- শরীরে কোনরকম ক্ষতচিহ্ন বা ট্যাটু রাখা যাবে না কোনমতেই। কিছু এয়ারলাইন্স এ চুল ছোট রাখার বিধান ও দেওয়া হয়ে থাকে।
- ত্বকের কমপ্লেক্সন গৌরবর্ণ হতে হয় নতুবা উজ্জ্বল টোনের হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
আচরণগত গুণাবলী:
এই পেশায় বিহেভিয়ার বা আচরণের গুরুত্ব সবচয়ে বেশি। যোগ্যতার থেকেও বেশি অনুশাসনের উপর জোর দেওয়া হয় তাই কিছু শর্ত স্বাভাবিকভাবেই অন্যতম ক্র্য়াইটেরিয়া হিসেবে উঠে আসে।
১) ব্যক্তিত্বের মাধুর্য:
গলার মিষ্টতা গুড লুকস ফ্রেন্ডলি ব্যবহার ও সামাজিক ইন্টারএকশনের দক্ষতা যাচাই করা হয়।
২) কথোপকথন:
ভাষাগত জ্ঞান ও কমিউনিকেশন স্কিল এর উপর নজর দেয়া হয়।
৩) উপস্থিত বুদ্ধি:
ফ্লাইটে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিলে অথবা ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং অথবা প্যাসেঞ্জার অসুস্থ হলে বা প্যানিক করলে কখনো মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করা আবার কখনো ভাবনাচিন্তার অভিনবত্ব দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হয়।
৪) টিম ওয়ার্ক:
বিমানে কেবিন ক্র’দের সাধারনত ১২-১৪ জনের টিম থাকে। তাই দৈনিক কাজ ও দায়িত্ব একে অপরের সাথে বোঝাপড়া ও সদ্ভাব বজায় রাখা উহ্য হয়ে পড়ে।
৫) পজিটিভিটি:
যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থেকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রেখে কাজ করতে হয়। মোদ্দা কথা হলো ওয়ার্কলোড নেবার।
৬) ধৈর্য:
প্যাসেঞ্জারদের বায়ান্নক্কা সামলানো হোক বা ফ্লাইট ডিলে বা টেকনিক্যাল সমস্যা এসবের ক্ষেত্রে কাজের নরমাল এর থেকে ৩-৪ঘোন্ত মত বাড়তে পারে। তাই পরিবর্তিত সব পরিস্থিতি তে মানিয়ে নেবার মত ধৈর্য্য ও মানসিক কাঠিন্য রাখতে হয়।
এই কাজের অজানা সাত সতেরো:
- আমরা সবাই মোটামুটি জানি যে বিমানসেবিকাদের কি কি কাজ করতে হয়।যাত্রীদের খাদ্য, পানীয় সরবরাহ করা তাদের দেখভাল, জার্নির গাইডলাইন বুঝিয়ে দেওয়া তাদের ডিউটির মধ্যে পড়ে। কিন্তু এসব বাদেও কিছু তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরছি যা সাধারণের অগোচরে থেকে যায়।
- জার্নি শুরুর আগে এয়ার হোস্টেসদের কাজ থাকে এমার্জেন্সি ও মেডিকেল কিট সঠিক অবস্থায় ও যথাযথ পরিমানে উপলব্ধ আছে কিনা খতিয়ে দেখা।
- এমনকি টয়লেট এর অবস্থান ও তার হাইজিন যত্ন সহকারে রক্ষিত হচ্ছে কিনা সেবিষয়েও তাদের খেয়াল রাখতে হয়। মিল ও পানীয়ের সরবরাহ ও যোগান এর বিষয়ে থাকতে হয় ওয়াকিবহাল।
- যাত্রীদের লাগেজ তুলতে হেল্প করতে হয় করিডর এর জায়গা থেকেই ও বাচ্চা ও বয়স্কদের বিশেষ কেয়ার নিতে হয়। সিত বেল্ট বাঁধতেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হয় ওনাদের। কেউ অতিরিক্ত মদ্যপান করছেন কিনা সেটাও তীক্ষ্ণ নজরদারির মধ্যে রাখতে হয়।
- টানা ৩০ দিনের মধ্যে কোনো বিমানসেবিকাই ১২৫ ঘন্টার বেশি সফর করতে অনুমতি প্রাপ্ত হন না। তাই এই জবে ক্লান্তি ও স্ট্রেস এর জায়গা নেই বললে চলে ।
নিয়োগ প্রক্রিয়া:
কয়েকটা ধাপে নিয়ম মেনে নিয়োগ করা হয়ে থাকে।
লিখিত:
এই ধাপে গণিত,রিজনিং ও জেনারেল নলেজ এর উপর এমসিকিউ প্যাটার্ন এ প্রশ্ন থাকে। ভালো প্রস্তুতি ও অধ্যাবসায় দিয়ে যা উতরে দেওয়া যেতে পারে।
গ্রূপ ডিসকাশন:
লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলে গ্রূপ ডিসকাশন এর জন্য ডাক আসে। দলে আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজের উপস্থিত বুদ্ধি, তাত্ক্ষণিক বিচারবোধ, বাচনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতার মত বিষয় গুলি সুক্ষ্মভাবে যাচাই করে নেব হয়। পরিমিত এটিচিউড ও নিয়মিত অনুশীলন করলে সাফল্য পাওয়া যায়।
ইন্টারভিউ:
এই সর্বশেষ পর্যায়। বোর্ড প্যানেল এর সামনে উপস্থিত হয়ে নিজের যোগাযোগ ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের ইন্টিগ্রিটির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজেকে উন্নীত করতে হয়।
ট্রেনিং:
ইন্টারভিউতে ছাড়পত্র পেলে এয়ারলাইন্স সংস্থার তরফে বাছাই করে ৬ মাসের ট্রেনিং পর্ব শেষ করে বিমানসেবিকা পদে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়।
স্যালারি:
বিভিন্ন ইয়ার্লায়নস সংস্থা অনুযায়ী বেতনের হেরফের ঘটে থাকে। তবে গড়ে বিমান্সেবিকাদের বেতন ইনিশিয়াল স্টেজ এ ২০ হাজার থেকে ৮০ হাজার এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ডোমেস্টিক এয়ারলায়েন্স স্যালারি রেঞ্জ হয় ৪০ হাজার অব্দি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেটার অঙ্ক হয় প্রায় ৮০ হাজার মত। অবশ্য ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স এর উপর ভিত্তি করে এর হেরফের হতে পারে।
এর সাথে থাকে ফ্লাইট এর টিকেট এর উপর ডিসকাউন্ট,মেডিক্যাল ইনসিউরেন্স ও রিটায়ারমেন্ট পরবর্তী অনান্য সুযোগ-সুবিধে।
কোথায় করবেন কোর্স?
কোর্সের প্রকারভেদ অনুযায়ী সার্টিফিকেট কোর্স থেকে মাস্টার্স কোর্স পর্যন্ত করতে পারেন। ১০+২ যোগ্যতাতেই আবেদন করার যোগ্য হবেন। কোর্সের মেয়াদ হবে সাধারণত ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত।
Kingfisher Training Academy, Mumbai
যোগাযোগ নম্বর – 022-26262200
Rajiv Gandhi Memorial College of Aeronautics, Jaipur
যোগাযোগ নম্বর – 0141- 2792359, 2791654
Universal Aviation Academy, Chennai
যোগাযোগ নম্বর – 044-42948000
Air Hostess Academy (AHA), Bangalore
যোগাযোগ নম্বর – 080-30578222/27-29
Air Hostess Academy (AHA), Delhi
যোগাযোগ নম্বর – 011 – 47096060, 9891984999
Air Hostess Academy (AHA), Mumbai
যোগাযোগ নম্বর – 022-66611581-86, 66611590
Air Hostess Academy (AHA), Pune
যোগাযোগ নম্বর – 020-66048421-29
Frankfinn Institute of Air Hostess Training, Mumbai
যোগাযোগ নম্বর – 022 – 26706039,26706040
Frankfinn Institute of Air Hostess Training, Delhi
যোগাযোগ নম্বর – 011 – 26255061,26255064
যে যে কোম্পানিতে বেছে নিতে পারেন স্বপ্ন পূরণের ঠিকানা:
- জেট এয়ারওয়েজ
- ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স
- গাল্ফ এয়ার
- গো এয়ার
- লুফথানজা
- সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ইত্যাদি।
মন্তব্য করুন