কেল্লাফতে,বিন্দাসের মত সিনেমায় কমেডি চরিত্র করে সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন অভিনেতা সুরজিৎ সেন। একই সাথে অমানুষ ২,পাত্র চাই, সোনার পাথর বাটি সিনেমায় পজেটিভ রোল ও গোলমাল, জানেমন, রংবাজ, হিরোগিরির মতো একাধিক সিনেমায় নেগেটিভ রোলে সমানতালে অভিনয় করে গিয়েছেন অভিনেতা।
আজ ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দা, বলিউড থেকে টলিউড ইন্ডাস্ট্রির অতি পরিচিত মুখ তিনি, কিন্তু কীভাবে এই জগৎ’এ এলেন তিনি, সেই গল্প অনেকেরই অজানা। সুরজিৎদার অভিনয় জীবনের শুরুর দিকটা ঠিক কেমন ছিলো, অভিনয়ের এই লড়াইয়ে কাদের পাশে পেয়েছিলেন? সেই সব নিয়েই সাক্ষাৎকার দিলেন আমাদের প্রতিনিধি সঙ্গীতা চৌধুরীর কাছে।
১) দাদা রূপোলি পর্দার জগতে আপনি কী করে এলেন?
সুরজিৎ দাঃ আমি ছোট থেকেই বাইরে বাইরে থেকেছি, আমার যখন ছয় মাস বয়স তখন পরিবারের সাথে আমি চেন্নাই চলে যাই। তারপর তো বাইরে বাইরেই মানুষ হয়েছি। তারপর কলেজ কমপ্লিট করে যখন পশ্চিমবঙ্গে আসি, তখন আমি একটা মডেলিং কোর্স করেছিলাম, সেই সময় টেলিগ্রাফে বিভিন্ন রকম এড বেরোতো, সেটা দেখে আমি একটা প্রোডাকশন হাউজে গিয়েছিলাম। বুম্বাদার বোন পল্লবীদির প্রোডাকশন হাউজ ছিল সেখানেই আমি প্রথম একটা ছোট্ট চরিত্রে কাজ করি।
২) আপনি তাহলে থিয়েটার বা অন্যকিছু এর আগে করেননি?
সুরজিৎ দাঃ না অভিনয়ে আসার আগে সেরকম কিছু করিনি। তবে পরবর্তীকালে একটা হিন্দি থিয়েটারের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম।
৩) অভিনয়ে আসবেন সেটা ভেবে ছিলেন?
সুরজিৎ দাঃ হ্যাঁ, সে তো ছোট থেকেই ভেবেছিলাম, তবে আসতে পারবো কিনা, বাড়ি থেকে অনুমতি দেবে কিনা সেটা জানতাম না। তবে আমার ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল অভিনয় জগতে আসার।
৪) মডেলিং কেন করেছিলেন?
সুরজিৎ দাঃ কারণ আমি শুনেছিলাম মডেলিং থেকে অভিনয়ে আসা যায়, তবে সত্যি বলতে কি আমার প্রচুর টাকা জলে গেছে মডেলিং করতে গিয়ে (হাসতে হাসতে)।
৫) এইমুহুর্তে খেলাঘর ছাড়া কি অন্য কোন ধারাবাহিকে কাজ করেছেন?
সুরজিৎ দাঃ না, এখন এটাই করছি।
৬) ব্লুজের আর কোনো কাজ করেছেন?
সুরজিৎ দাঃ না, এটাই প্রথম।
৭) সিনেমার পাশাপাশি আপনি হিন্দি ও বাংলা ধারাবাহিকে কাজ করেছেন, জনপ্রিয় কয়েকটি ধারাবাহিকের বিষয়ে একটু বলুন?
সুরজিৎ দাঃ আমার প্রথম সিরিয়ালটাই ভীষণ জনপ্রিয় ছিলো। আলফা বাংলায় ‘তমসারেখা’ ধারাবাহিকে পাঠান বলে একটা মেন ভিলেনের চরিত্র ছিলো। আমার করা ‘সতীন কাঁটা’, আমার ‘গুরুদক্ষিণা’ ধারাবাহিকও খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো, এছাড়া ‘রাত ভোর বৃষ্টি’, ‘রাইকিশোরী তুমি এলে তাই’ , ‘মা দুর্গা’, তোমায় আমায় মিলে ধারাবাহিকেও কাজ করেছি আর হিন্দিতে ‘সি আই ডি’, ‘বিট্টি বিজনেসওয়ালী’, ‘কৌন হে’, ‘কুমকুম ভাগ্য’, ‘এম বি এ সারপাঞ্চ’, ‘হকিকত’ তে কাজ করেছি।
৮) আপনার অভিনয় জীবনের স্ট্রাগল সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
সুরজিৎ দাঃ রবিবার করে বর্তমান, আনন্দবাজারে বিভিন্ন এড বেরোতো, সেগুলো দেখে খাতায় লিখে, ছুটির দিন করে বেরিয়ে সব জায়গায় ছবি দিয়ে দিয়ে বেড়াতাম। বছরের পর বছর করেছি সেইকাজ, সেইসময় কম করে ৫০-৬০ হাজার টাকার ছবিই বিলি করে দিয়েছি। রোদ গ্রীষ্ম বর্ষা ঘুরেছি কোনো কিছুকেই সেভাবে পাত্তা দিইনি।
৯) আপনি তো বোম্বেতেও কাজ করেছেন?
সুরজিৎ দা: হ্যাঁ হিন্দি থিয়েটারে কিছুদিন যুক্ত হয়েছিলাম ,তখন অফার আসে বোম্বেতে ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস দ্য ফরগটেন হিরো’ তে একটা জার্নালিস্টের ক্যারেক্টারের। আমি করেছিলাম। সেটায় আমার কাজ ওনাদের পছন্দ হয় তারপর ‘যুবা’ ও ‘হকিকত’ বলে দুটো কাজ করেছিলাম। সব অত মনেও নেই।
১০) আপনার পরিবারের সাপোর্ট ছিলো?
সুরজিৎ দাঃ আমার পরিবার যেভাবে আগে সাপোর্ট করেছিল আজও সেই ভাবেই সাপোর্ট করেন। আমি যে সাপোর্ট আমার পরিবারের থেকে পেয়েছি এরকম সাপোর্ট সচরাচর সবাই পায়না, এই বয়সেও আমার বাবা-মা যেভাবে সকাল বেলায় উঠে রান্নাবান্না করে আমার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে সবকিছু করে দেন, তার জন্য আমি সত্যি খুব লাকি। এই সাপোর্টটা না পেলে আজ আমি ইন্ডাস্ট্রিতেই থাকতাম না। আমি অভিনয় করে যখন টাকা পেয়েছি, তখন বাবা-মা খুব খুশি হতেন।
১১) অভিনয় ছাড়ার কথা ভেবেছিলেন কখনো?
সুরজিৎ দাঃ মাঝেমধ্যে একটু হতাশ লাগতো তখন অভিনয় ছেড়ে অন্য কিছু করার কথা ভাবতাম। জানো তিনবার অভিনয় ছেড়ে অন্য কাজে ঢুকেছিলাম, কিন্তু পারিনি, অভিনয়ের প্রতি একটা অসম্ভব টান ছিলো, সেটা কাটানো আমার পক্ষে এত সহজ ছিলোনা। (আবেগ তাড়িত হয়ে বলেন কথাগুলো)।
১২) বাবা মা কী ভেবেছিলেন ছেলে অভিনেতা হবে?
সুরজিৎ দাঃ তখনকার দিনে যা হয় সেই সময় কেউ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসার কথা ভাবতেন না। আমার বাবা-মা ভাবতেন ছেলে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে, আমি অল ইন্ডিয়া ডাক্তারি পরীক্ষা দিয়েছিলাম কিন্তু মন স্থির করতে পারিনি। ঐ যে অভিনয়ের স্বপ্নটা সবসময় তাড়া করে বেড়াতো।
১৩) নেতিবাচক, ইতিবাচক চরিত্রের পাশাপাশি আপনি তো কমেডিও ভালো করেন?
সুরজিৎ দাঃ হ্যাঁ দুবার কমেডি চরিত্র করেছি, তবে সেটা সিনেমায়। টেলিভিশনে আমি সেভাবে কমেডি করার সুযোগ পায়নি, তবে কমেডি চরিত্রটা আমি করতে চাই।
১৪) কোন ধরণের চরিত্রে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
সুরজিৎ দাঃ দেখুন আমি জানি না কেন, কোনো চরিত্র করতেই আমার কখনো অসুবিধা হতো না। হয়তো বাবা মায়ের আশীর্বাদের জন্যই এমনটা হতো, সব চরিত্রেই আমি মানিয়ে নিতে পারতাম নিজেকে।
১৫) টলিউডের মধ্যে কাকে গুরু বলে মানেন?
সুরজিৎ দাঃ উত্তম জেঠুকে খুব ভালো লাগতো। উনি একজন ভার্সাটাইল অভিনেতা। সন্ন্যাসী থেকে জমিদার, রোমান্টিক নায়ক থেকে গুন্ডা সব চরিত্র অনায়াসেই ফুটিয়ে তুলতেন তিনি।
১৬) আর বলিউড জগতের মধ্যে পছন্দের কে?
সুরজিৎ দাঃ অনেকেই আছেন অমিতাভ বচ্চন থেকে ঋষি কাপুর। তবে এই নিয়ে একটা আক্ষেপ আছে, ইরফান খানের সাথে কাজ করার ইচ্ছে ছিলো খুব। ইরফান খান বড্ড ক্যাজুয়াল, ঐ অভিনয়টা করা কিন্তু খুব একটা সহজ নয়, ওনার চোখ কথা বলতো।
১৭) খেলাঘরে শান্টুর সাথে কী রকম সম্পর্ক?
সুরজিৎ দাঃ আমি যখন স্ট্রাগল করতাম তখন থেকেই ওকে চিনি। এরপর বোম্বেতেও দেখা হয়েছিলো তারপর এখানে এসে দেখা হয়েছে, বেশ ভালো ছেলে।
১৮) সবাই বলে আপনি খুব চাপা ধরণের মানুষ, কথাটা কি সত্যি?
সুরজিৎ দাঃ হ্যাঁ আমি খুব বেশি কথা বলতে পারিনা, একটু চুপচাপ। খুব বেশি মিশতে পারিনা, এই কারণে সমস্যাও হয় অনেক। আমাকে যারা কাজ দিয়েছেন তারা আমার আগের কাজ দেখেই কাজ দিয়েছেন।
১৯) খেলাঘর গ্রুপের মধ্যে খুব ভালো বন্ধু কে?
সুরজিৎ দাঃ নিপুণের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক।
২০) আপনি এত চুপচাপ কম কথা বলেন, আর নিপুন দা তো সম্পূর্ণ অন্যরকম, খুব মিশুকে মানুষ…বন্ধুত্ব কীভাবে হলো?
সুরজিৎ দাঃ হ্যাঁ এই বৈপরীত্যের কারণেই হয়ত মিলে গেছে।
২১) আপনি তো সব চরিত্রেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন কিন্তু কোন চরিত্র করতে আপনার বেশি ভালো লাগে ?
সুরজিৎ দাঃ দেখো আমার কমেডি চরিত্র করতে বেশি ভালো লাগে, যদিও আমি খুব কম সুযোগ পাই, তবে সত্যি বলতে কি আমি কমেডিটা করতে চাই। কমেডি খুব পাতলা একটা লাইন তো, এপারে থাকলে লোকে হাসবে না, ওপারে থাকলে বলবে ভাঁড়ামো হচ্ছে। ঐ মিডল লাইনটাকে ধরাটা খুব চাপ।
২২) নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক চরিত্রে উত্তরণ হয়েছে খেলাঘরে, অসুবিধা হয়নি চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে?
সুরজিৎ দাঃ আমি যখন কোন কাজ শুরু করি তারপর যখন আমি স্টুডিওতে ঢুকি তখন আমি সেই মানুষটাই হয়ে যায়, সেই চরিত্রটা হয়েই আমি বাঁচি। কোনো কিছুকে জোর করে আমায় আরোপ করতে হয় না। প্রথম কয়েকদিন বুঝে নিতে হয় চরিত্রটা ঠিক কী হতে চলেছে তারপর আমি সেই চরিত্রটাই হয়ে উঠি। তাই নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক হতে বা মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে বদলে নিয়ে কমেডি অ্যাক্টর হয়ে উঠতেও আমার বেশি সময় লাগে না।
২৩) আপনাকে ফিল্মের লোক বলেই জানি, ফিল্ম বাদে এর আগে কোনো ধারাবাহিকে কি খেলাঘরের মতো এরকম জনপ্রিয়তা পেয়েছেন?
সুরজিৎ দাঃ না, খেলাঘর ধারাবাহিকের মতো এতো জনপ্রিয়তা অন্য কোনো ধারাবাহিকে পাইনি, সেই কারণে ব্লুজের স্নেহাশীষদার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
২৪) খেলাঘর ধারাবাহিকের ববিন দা আপনি, এই ধারাবাহিকের অভিনবত্বের পিছনে কী কারণ বলে আপনার মনে হয়?
সুরজিৎ দাঃ কনসেপ্ট। কারণ দাদা এই যে কনসেপ্টটা এনেছেন এরকম কনসেপ্ট আগে আসেনি। গরীব বড়লোকের কনসেপ্ট আগেও এসেছে কিন্তু এই যে বস্তির গুন্ডা আর অভিজাত পরিবারের মধ্যে যে সম্পর্ক, তারমধ্যে আজকের সমাজের এই যে রাজনৈতিক বিষয়গুলো উঠে এসেছে সবটাই এই ধারাবাহিকে উঠে এসেছে।
২৫) আপনার ছবিগুলো নিয়ে যদি একটু বলেন?
সুরজিৎ দাঃ দ্যাখো হিট ১৮টা ছবি আছে আমার। ‘বিক্রম সিংহ’ সিনেমায় আমার করা চরিত্র, তারপর ‘রকি’, ‘হিরোগিরি’,’বিন্দাস’ এর মতো সিনেমা গুলো খুব হিট হয়েছিলো।
২৬) ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ সিনেমায় ভীম চরিত্র করেছিলেন আপনি, লোকের রিয়েকশন কেমন ছিলো?
সুরজিৎ দাঃ এখনো রাস্তা দিয়ে গেলে লোকে ঐ ভীমদা বলেই ডাকেন।
২৭) হেমা মালিনীর নাটকের গ্রুপেও আছেন আপনি?
সুরজিৎ দাঃ হেমা মালিনীর নাটকের গ্রুপে আমি একজন লিড এক্টর, দ্রোপদী বলে একটা নাটকে আছি আমি।
২৮) জীবনের সবথেকে বড় প্রাপ্তি বলতে কী বলবেন?
সুরজিৎ দাঃ অভিনয়টা আমার শখ ছিল তবে আমি কোনদিনও ভাবিনি, যে সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হবে। আমার বাবা-মা আমার নামে পরিচিত হবেন, কিন্তু আজ ওনারা তাই হন। বাজারে গেলে বাবা মাকে সবাই বলে সুরজিৎদার বাড়ির লোক এসেছেন। তাদের এই বিষয়গুলো ভালো লাগে আবার আমারও ভালো লাগে। মাঝে অনেকবার আমি যখন মন ভেঙে চাকরি করবো ভেবেছিলাম, তখন বাবা মা আমাকে আটকে ছিলেন। তাই আজ ওনারাও খুব খুশি।
২৯) এখন আর কি অভিনয় ছেড়ে যাবার কথা ভাবেন?
সুরজিৎ দাঃ দেখো হতাশা প্রথম দিকে ছিলো তবে একটা সময়পর বুঝলাম যে অভিনয় ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এখন এই ইন্ডাস্ট্রিতেই কাজ করতে চাই। অভিনয়টা করবো, তার পাশাপাশি যদি পরিচালনার কাজ করা যায়, একটা গল্প লিখেছি আমি, প্রডিউসার খুঁজছি।
৩০) কীসের গল্প, কী ধরণের একটু শুনি?
সুরজিৎ দাঃ বাংলারই গল্প তবে থ্রিলার টাইপ। আসলে আমি থ্রিলার, হররটা খুব পছন্দ করি।
৩১) দর্শকদের মধ্যে কোন চরিত্র হয়ে থেকে যেতে চান?
সুরজিৎ দাঃ কোনো একটা পার্টিকুলার চরিত্র নয়, আমি চাই দিনশেষে মানুষ আমাকে একজন অভিনেতা হিসেবেই মনে রাখবেন।
মন্তব্য করুন