আমরা যারা একুশ শতকের মানুষ তাঁরা যদি একটু তাদের শৈশবের দিকে উঁকি দিই, তাহলে আমরা কিন্তু কোনও উনুন দেখতে পাব না খুব বেশি একটা। তার জায়গায় কেরোসিন তেল আর স্টোভের আওয়াজই বেশি করে ফুটে উঠবে। কিন্তু সত্তরের দশকের সময় থেকে দুটো খুব বড় পরিবর্তন আসে এই রান্নাঘরে যা চিরাচরিত রান্নার পদ্ধতিতে খানিক নতুনত্ব আনে।
একটি হল প্রেসার কুকার আর দ্বিতীয়টি হল এল.পি.জি গ্যাস সিলিন্ডার যা কেরোসিন বা স্টোভ সব কিছুকেই প্রবাদে পরিণত করেছিল। কিন্তু বিপ্লবের এখনও শেষ হয়নি। আপনি খুব তাড়াতাড়ি আপনার বাড়িতে গ্যাস নাও দেখতে অভ্যস্ত হতে পারেন। এর কারণ আস্তে আস্তে সেই জায়গা নিচ্ছে ইন্ডাকশন কুকটপ।
ইন্ডাকশন কাজ করে কীভাবে
ইন্ডাকশন এই আশ্চর্য জিনিসকে আজ সত্যি ভাবতে শিখিয়েছে যে আগুনকেও রান্না করা যায়।
ছবি ঋণঃ ScienceABC
ইন্ডাকশনে রান্না করা হয় মূলত বিদ্যুৎ আর ম্যাগনেট টেকনোলোজির যৌথ সমন্বয়ে। একটা আয়তকার বা চৌকো ক্ষেত্রের উপর একটি সমান প্লেট থাকে যার উপর বাসন রাখা হয় রান্নার জন্য। যখনই বিদ্যুৎ অন করা হয়, তখনই ফিজিক্সের নিয়ম মেনে একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয় ওই প্লেটে। তারপর যখন একটি পাত্র রান্না করার জন্য এই গরম প্লেটের উপর রাখা হয়, তখন তা সঙ্গে সঙ্গে গরম হতে থাকে ওই ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সংস্পর্শে এসে। আর এতো তাড়াতাড়ি গরম হয় যে রান্নাও হয় খুব জলদি। কিন্তু আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে যেন সমগ্র প্লেটটি গরম হয়। তারপরই কিন্তু বাসন রাখা উচিৎ।
কিছু সতর্কীকরণ
রান্নার আগে আপনাদের মনে রাখা দরকার যে শুধু আয়রন বা স্টিলের বাসনই ব্যবহার করা উচিৎ। কোনও ভাবেই অ্যালুমিনিয়ামের কিছু ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
আপনি নিজেও কিন্তু পরখ করে নিতে পারেন যে আপনার বাসন ইনডাকশনে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত কিনা। যে বাসন ব্যবহার করবেন ভাবছেন, তার সামনে একটা ম্যাগনেট নিয়ে যান। যদি বাসন ম্যাগনেটকে আকর্ষণ করে তাহলে বুঝবেন যে বাসন ইনডাকশনে ব্যবহারের যোগ্য, আর না আকর্ষণ করলে যোগ্য নয়।
এবার আসুন ইনডাকশন ব্যবহার ঘিরে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়া যাক
কেন আজকের দিনে রান্নাঘরে ইনডাকশন লাগবেই বা কী এর উপযোগিতা এই সব নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকে। আসুন তার উত্তর খোঁজা যাক।
১. ইন্ডাকশন আর এল.পি.জি গ্যাসের মধ্যে দামের কেমন পার্থক্য
দেখুন ইনডাকশন আর বিদ্যুৎ, দু ক্ষেত্রেই খরচ কিন্তু আপনার শহরের উপর নির্ভর করছে। যদি আপনার শহরে বিদ্যুতের দাম প্রতি পাওয়ার ইউনিটে ৫ টাকার বেশি হয়, তাহলে ইনডাকশন ব্যবহার করলে খানিক খরচ হবেই। কিন্তু যদি আপনার অঞ্চলে এল.পি.জিতে সাবসিডি চালু না হয় আর বিদ্যুতের দাম কম হয়, তাহলে ইনডাকশন ব্যবহার করুন।
২. ইন্ডাকশন ব্যবহার খুবই খরচসাপেক্ষ?
যদি আপনি আপনার প্রেসার কুকারের দামের সঙ্গে ইনডাকশনের তুলনা করেন তাহলে তো দাম অনেক মনে হবেই। কিন্তু যদি আপনি কুকারের পিছনে ব্যয় হওয়া সময় আর ইনডাকশনের সময় নিয়ে ভাবেন, তাহলে আপনার মনে হবে ইনডাকশনই বেস্ট।
৩. ইন্ডাকশন কী গ্যাসের থেকে তাড়াতাড়ি কাজ করে?
হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি কাজ হয়। যেহেতু আধুনিক পদ্ধতিতে ইনডাকশন চলে তাই গ্যাসের থেকে তাড়াতাড়ি কাজ দেয়। আর যেহেতু একটি প্লেটের উপর বাসন রেখে রান্না হয়, তাই অতিরিক্ত শক্তিও খরচ বা নষ্ট হয় না, যা গ্যাসে হতে পারে।
৪. ইন্ডাকশন কুকটপ আর গ্যাস স্টোভের মধ্যে কী পার্থক্য?
রান্নাঘরেই সারা দিন কাটান এমন মানুষের মনে এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। আজ তাই আপনাদের বলে দিচ্ছি ঠিক কী কী মূল পার্থক্য ইনডাকশন আর গ্যাস স্টোভের মধ্যে।
ক. গ্যাস স্টোভে রান্না করতে অনেক সময় লাগে। অন্য দিকে ইনডাকশনে সহজেই তাড়াতাড়ি রান্না হয়ে যায়।
খ. গ্যাসের পাইপে লিকেজ থাকার ভয় সব সময়ে থেকে যায়। কিন্তু এমন কোনও ভয় ইনডাকশনের ক্ষেত্রে থাকে না।
গ. যেহেতু ইনডাকশনে একটি সমতল প্লেটের উপর রান্না করা হয় তাই তাপ সমান ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পাত্রের সব দিকে তাপ যায় আর তাও নীচ থেকে উপরে সমান ভাবে। তাই রান্না কম পোড়ে। কিন্তু গ্যাসের সব দিক সমান তাপ পায় না আর পুড়েও যেতে পারে।
ঘ. গ্যাসের থেকে ইনডাকশনে রান্না অনেক কম সময়ে হয়ে যায়। তাই ইনডাকশন ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ আদতে কমই ব্যয় হয়।
ঙ. রান্নাঘরে গ্যাস জ্বলায় রান্নাঘরের তাপ সব সময়ে গরম থাকে। আর পাখাও চালানো যায় না। কিন্তু ইনডাকশন ব্যবহার করলে রান্নাঘরের তাপমাত্রা নর্মাল থাকে।
চ. গ্যাস জ্বললে নির্দিষ্ট পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। এতে পরিবেশ দূষিত হয়। কিন্তু ইনডাকশন পরিবেশ বান্ধব। এতে কোনও ভাবেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয় না।
ইন্ডাকশন কুকটপ কেনার আগে কী কী দেখে নেওয়া উচিৎ
ইনডাকশন কেনার সময়ে অনেকেই বুঝে উঠতে পারে না যে কী কী দেখে আমি একটি ইনডাকশন ঠিক করব। এখানে তাই আমরা কিছু তথ্য দিলাম যা আপনাকে সাহায্য করবে ইনডাকশনের গুণাগুণ বুঝতে।
ক. ওজন কেমন হওয়া উচিৎ?
যেহেতু বিদ্যুতে চলে ইনডাকশন, তাই শুরুতেই আপনার জানা উচিৎ যে ঠিক কীরকম বিদ্যুৎ আপনার মেশিন নেবে। যদি আপনি খুব কম সময়ে অনেক রান্না করতে চান, তাহলে হাই-কুকড ইনডাকশন ব্যবহার করুন।
খ. সাইজ কেমন হবে?
আপনার রান্নাঘরে কেমন জায়গা আছে আর কত জনের জন্য রান্না হবে, সেটা বুঝেই ইনডাকশনের আয়তন ঠিক করুন।
গ. প্লেট কেমন হবে?
অনেক রকমের প্লেটই থাকে ইনডাকশনের উপরে। কিন্তু দেখে নিতে হবে আপনার ইনডাকশনের প্লেট যেন এ গ্রেড জার্মান ক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি হয়। অনেক প্লেট সেরামিক দিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু তা ভালো হিসেবে গণ্য নয়।
ঘ. বিশেষ ধরণ?
অনেক ইনডাকশনে টাচ মুড থাকে। যদি সম্ভব হয় তাহলে এই রকম বিশেষ ফিচার কিন্তু দেখতে পারেন।
ঙ. চাইল্ড লক ফেসিলিটি?
রান্নাঘর থেকে আমরা ছোটদের সব সময়ে দুরেই রাখি যেহেতু আগুন নিয়ে কাজ হয় সেখানে। ঠিক তেমনই ইনডাকশনেও যেহেতু তাপ আছে তাই অনেক সময়ে তার মধ্যেও চাইল্ড লক ফেসিলিটি থাকে। এরম কিছু যদি পান তাহলে অবশ্যই কিনুন।
চ. টাইমার
আজকাল অনেক কোম্পানি তাদের ইনডাকশনে এই টাইমার ব্যবহার করছেন। ধরুন আপনি কাজে খুব ব্যস্ত। ততটা নজর দিতে পারছেন না রান্নার দিকে। তাহলে আপনি শুরুতেই রান্না বসিয়ে দিয়ে টাইমার দিয়ে দিন। রান্না ওই সময়ে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে।
ছ. স্পিড বুস্টার
স্পিড বাড়ানোর বা কমানোর দরকার তো সব সময়ে থাকেই। তাই ইনডাকশন কেনার সময়ে দেখে নিন এই স্পিড বুস্টার আপনার মেশিনে আছে কিনা!
জ. অটোমেটিক কন্ট্রোল
এটা কিন্তু আপনার ইনডাকশনে থাকা খুব দরকার। ধরুন খুব তাড়াতাড়ি ইনডাকশন গরম হয়ে যাচ্ছে আর আপনি তখন ওটা কমাতে পারছেন না। ইনডাকশন নিজেই তখন বন্ধ হয়ে যাবে। এটা কিন্তু নিরাপত্তার জন্য খুব দরকার।
ঝ. ফ্যান সিস্টেম আছে কিনা
অন্য অনেক সিস্টেমের মতোই ইনডাকশনেও কিন্তু ফ্যান রয়েছে ভিতরের তাপ বের করে দেওয়ার জন্য। তাই কেনার আগে দেখে নিন আপনার ইনডাকশনেও সেই ফ্যান আছে কিনা। আর দেখুন সেই ফ্যান খুব শব্দ করছে কিনা। যদি করে তাহলে বুঝবেন ইনডাকশনের কোয়ালিটি ভালো নয়।
ঞ. ওয়ারেন্টি
এটাও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা মাথায় রাখতে হবে। অন্তত এক বছরের ওয়ারেন্টি আছে এমন জিনিস ব্যবহার করা খুবই দরকার।
ইনডাকশন কুকটপ কীভাবে ব্যবহার করা যায়
যখন রান্না করবেন তখন দেখবেন যাতে ইনডাকশনে ব্যবহার করা যায় এমন জিনিসের তৈরি বাসনই আপনি ব্যবহার করছেন। তাই কাচ, সেরামিক, কপার, ব্রোঞ্জ, অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বাসন ব্যবহার না করাই ভালো। আর অন্য দিকে ব্যবহার করতে পারেন মাইল্ড আয়রন, স্টেইনলেস স্টিল, আয়রন আর নন-স্টিক জিনিস।
বেস্ট ইন্ডাকশন কুকটপ
এতো কিছু জানার পরে এবার মাথায় আসবে যে প্রশ্ন সেটা হল এতো কোম্পানি থাকতে কোন কোম্পানির ইনডাকশন আমি ব্যবহার করব। আসুন আপনার এই চিন্তাও আমরা দূর করি। দেখে নিন নিচের তালিকা,
১. ফিলিপ ভিভা কালেকশন এইচডি ৪৯২৮ / ০১
PHILIP VIVA COLLECTION HD4928/ 01
ফিলিপ ভিভা কালেকশন মডেল নম্বর এইচডি ৪৯২৮ / ০১
এই ব্র্যান্ডের ইনডাকশন কুকটপ ভারতীয় রান্নাঘরের জন্য একদম উপযুক্ত। এর কুকটপ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক টেকনিক দিয়ে তৈরি আর এটা নিশ্চিত করে যে তাড়াতাড়ি রান্না হয়ে যাবে।
গ্যাসের থেকে কম সময় নেয় আর কম সময় নেয় বলে খাবারের খাদ্যগুণ থাকে অটুট। সব ভিটামিন খাবারে মজুত থাকে। টাইমারের সাহায্যে আপনি এর সময় তিন ঘণ্টা পর্যন্ত রাখতে পারেন।
টাচ কন্ট্রোল বাটনের সাহায্যে রুটি, ধোসা সবই বানানো যায়। এটা মূলত ২১০০ ওয়াটের আর প্লেট তৈরি মাইক্রো ক্রিসটাল দিয়ে। এর কর্ড ১.২ মিটার, তাই প্লাগের সঙ্গে লাগাতে সমস্যা হয় না। অটো প্রোগ্রাম আছে বলে রান্না পুড়ে যায় না। আর রান্নার সময়েও ঠাণ্ডা থাকে।
দামঃ Rs. 2,319/-
২. প্রেসটিজ পিক ২০
Prestige Induction Cook Top Model No. Pic 20.0
এই মডেল আমাদের অনেক রকমের রান্না করার সুযোগ দেয়, সেটা দুধ গরম থেকে শুরু করে রুটি, ধোসা, কারি, ডিপ ফ্রাই সব কিছু করতে। ২৩০ থেকে ১২০০ ওয়াটের মধ্যে আপনি এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
এতে পুস বাটন রয়েছে যা এর ব্যবহার অনেক সহজ করে দেয়। এর বিশেষ ব্যবস্থা হল এর মধ্যে থাকা এয়ারোডায়নামিক কুলিং সিস্টেম রান্নাঘর গরম হতে দেয় না। অটোমেটিক ভোল্টেজ রেগুলেটর থাকার জন্য এতে বিদ্যুতের সাশ্রয় হয়। কোম্পানির তরফ থেকে এক বছরের ওয়ারেন্টি থাকে।
দামঃ Rs. 1,675/-
৩. পিজিওন (PEGION)
Stovecraft by Pigeon
এটি কুকটপ পিজিওন নামেই বাজারে বেশি পরিচিত। আমাদের ভারতের রান্না করার ধরণ মাথায় রেখে এটি বানানো হয়েছে। এটা এতই এলিগ্যান্ট যে আপনার রান্নাঘর ছোট হলেও তাতে ভালো ভাবে ধরে যায়। এর প্লেট মাইক্রোক্রিসট্যাল টেকনোলজি দিয়ে তৈরি, যা খুব সহজে পরিষ্কার করা যায়।
আধুনিক হোক বা চিরাচরিত, যে কোনও রান্নাই এতে খুব কম বিদ্যুৎ ব্যয় করে হয়ে যায়। এটি ব্যবহার করলে আগুন লেগে যাওয়ার বা খুব গরম লাগার সমস্যা হয় না। আর এতে ১.২ মিটার কর্ডও আছে।
দামঃ Rs. 1,399/-
৪. প্রেসটিজ পিক ১৫.০
Prestige Induction Cook Top, Model No. PIC 15.0
বাজারে প্রেসটিজের নাম তো বিখ্যাত। এদের পিক ১৫.০ মডেল আপনার রান্নাঘরকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবে। এর বিশেষ ফিচার হল এতে থাকা টাচ বাটন, প্রেসেন্ট ইন্ডিয়ান মেনু আর ভোল্টেজ রেগুলেটর যা আপনাকে আকর্ষণ করবে।
এর অ্যান্টি ম্যাগনেটিক ফিল্ড একে অন্য ইনডাকশনের থেকে আলাদা করবে। এতেও খুব কম বিদ্যুৎ ব্যয় হয় আর এর বিশেষ ফিচার হল আপনার বাসন গরম হয়ে গেলে ইনডাকশনের তাপমাত্রা নিজে থেকেই কন্ট্রোল হয়ে যায়।
দামঃ Rs. 2,580/-
৫. বাজাজ ম্যাজেস্টি আইসিএক্স ৭
Bajaj Majesty Model No. 1CX 7
বাজাজ কোম্পানি আপনার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই এই মডেল তৈরি করেছে। এতে থাকা টাইম আর তাপমাত্রা অ্যাডজাস্ট করার অপশন আপনার ব্যস্ততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।
আপনাকে আলাদা করে আর ভাবতে হবে না। এটি ১৯০০ ওয়াটের আর খুব তাড়াতাড়ি এতে রান্না করা হয়। তাই খাবার থাকে গুণাগুণ সম্পন্ন।
দামঃ Rs 2,779/-
ইন্ডাকশনের দাম বদল হতে পারে, সময়ের সাথে সাথে।
Dhaniya Chutney Recipes: ধনেপাতার চাটনির পাঁচটি অসাধারণ রেসিপি
মন্তব্য করুন