শব্দটা খুব একটা অপরিচিত নয় বলুন। মোটামুটি যারা একটু ইতিহাস টিতিহাস ঘাঁটেন তাঁরা তো বটেই, এছাড়াও সাধারণ মানুষের মরমেও এই ক’দিনে শব্দটা পশিয়ে গেছে। রোহিঙ্গা, যাদের আজ দেশ নেই, ঘর নেই। আমরা ছিটমহলের বাসিন্দাদের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু, রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। আমরা কতটুকু কী করতে পারব বা পারছি তাদের জন্য জানি না, কিন্তু, আমাদের পাশের দেশ বাংলাদেশ যেভাবে বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গাদের দিকে সেই নিয়েই আজ কিছু কথা লিখব, যা আমাদেরও শেখাবে কীভাবে মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়।
নিজস্ব চাপ সামলেও পাশে বাংলাদেশ
কোনো ইতিহাসের প্রসঙ্গ এখানে আনবো না, সেটা সবাই প্রায় জানতেই পারবেন। সেই কবে থেকে এই সমস্যা হয়ে চলেছে ও সবচেয়ে বেশি আঁচ বোধহয় বাংলাদেশই সহ্য করেছে পার্শ্ববর্তী দেশ হিসাবে। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের তো সেই দেশের নাগরিক বলে স্বীকার করা হয়ই না, বরং বলা হয় তারা নাকি বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।
সমস্যাটার সঙ্গে বাংলাদেশের নাম শুরু থেকেই জড়িয়ে আছে। যখনই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার মাত্রা ছাড়া হয়েছে তখনই তারা বাংলাদেশের আশ্রয় নিতে এসেছে আর বাংলাদেশও তাদের দু’হাত দিয়ে গ্রহণ করেছে। সেই কবে থেকে এখনও অবধি চার ধাপে রোহিঙ্গারা এসে বসবাস করছে বাংলাদেশে। উত্তর রাখাইনের প্রায় ৮০০০০ মতো রোহিঙ্গার ৩০% এখন কক্সবাজারে আছেন। এদিকে বাংলাদেশের নিজস্ব জনসাধারণের দায়ভারও তো তাকেই নিতে হবে। প্রায় ১৭ কোটির মত মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করতে হয় বাংলাদেশ সরকারকে। তাও এই বিপুল শরণার্থীদের ওপর নির্যাতন করেনি বাংলাদেশের মানুষ, যেমন নাকি করা হয়েছিল থাইল্যান্ডে। নিজস্ব চাষের জমির ওপরেই তো চাপ রয়েছে জনগণের। তার ওপর এই মানুষদের চাপ। কিন্তু, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কথা আমাদের মুগ্ধ করে। তিনি বলেছেন যে যদি বাংলাদেশের মানুষ খেতে পেতে পারেন, তাহলে রোহিঙ্গারাও খেতে পাবেন। একজন যোগ্য নেত্রী ও মানবতাবাদীর মতো কথা শুনতে পেলাম আমরা যেখানে রোহিঙ্গা সমস্যাকে সবাই ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই যেন বাঁচেন।
বন্ধুত্বের আসাধারণ নজির বাংলাদেশের
আমরা ছোট থেকেই শুনে আসি সুজলা সুফলা বাংলাদেশ। কিন্তু, এই সবুজের ওপরেই ধেয়ে এসেছে কালো ছায়া রোহিঙ্গারা আসার পর। খুলেই বলি ব্যাপারটা। রোহিঙ্গারা আসার পর তাদের অস্থায়ী আবাস নির্মাণের জন্য উখিয়া আর টেকনাফ অঞ্চলের ২০০০ একর বনভূমির জমি বরাদ্দ হয়েছে। এই বনভূমির মধ্যে যেমন প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে ওঠা গাছ আছে, তেমনি আছে রোপণ করা গাছ, যাদের বয়স খুবই কম, যেমন দুই থেকে পাঁচ বছর। তার ওপর আবার রোহিঙ্গারা ২৮ টি পাহাড় কেটে তাদের বসতি স্থাপন করেন। পাহাড় এভাবে কাটার ফলেও প্রকৃতির ওপর বিরূপ চাপ পড়ছে। টেকনাফ এরিয়াতে হাতি রয়েছে, যাদের রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা নেয় সরকার। কিন্তু, এখন সেই সুরক্ষাও ব্যাহত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য। রোহিঙ্গাদের রান্না করার জন্য জ্বালানীও নিতে হয় সেই বনভূমি থেকেই, মানে কত গাছ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু, এত ক্ষতির পরেও বাংলাদেশ সরকার সমগ্র বিষয়টা মানবিকতার দিক থেকেই দেখছেন। তাই রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা চরে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেই নিয়েও ভাবছেন। তাই গোটা বিশ্বকে বাংলাদেশের থেকেই মানবিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা নিতে হবে।
প্রশংসায় বাইরের দেশও
বাংলাদেশের এই ইতিবাচক কর্মকান্ডের প্রশংসা করেছেন তুরস্ক সরকার। ৩১ অগষ্ট বৃহস্পতিবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তারিপ এরদোয়ান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো আব্দুল হামিদকে ফোন করে প্রশংসা বার্তা দেন। পাশাপাশি বলেন যে তুরস্ক আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ফোরামও গঠন করবে যেখানে বাংলাদেশকেও পাশে চাই। তিনি আরও বলেন সীমিত সম্পদ ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও যেভাবে বাংলাদেশ সাহায্য করছে রোহিঙ্গাদের তা অনবদ্য।
আসলে উৎখাত হওয়ার যন্ত্রণা, উৎখাত হওয়া কাকে বলে এই সবই বাংলাদেশের মানুষ জানেন। মাথার ওপর ছাদ না থাকা, নিজভূমে পরবাসী হওয়ার রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা তাঁদের অজানা নয়। তাই হয়তো কোথাও গিয়ে রোহিঙ্গাদের যন্ত্রণার সঙ্গে নিজেদের পূর্ব স্মৃতিকে তাঁরা একাত্ম করে ফেলেছেন। না, দুই পরিস্থিতির পার্থক্য বহুত, তা জানি। কিন্তু, সব মিলে বাংলাদেশের এই মনুষ্যত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সত্যিই আমাদের আরেকবার বলতে বাধ্য করে, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” ।
মন্তব্য করুন