দুর্গা পূজা বাঙালীর সবচেয়ে প্রিয় উৎসব। সারা বছর বাঙালী এই কয়েকটা দিনের জন্য অপেক্ষা করে। দুর্গাপুজো আমাদের কাছে আসলে পূজার থেকেও অনেক বেশী উৎসব, মিলনক্ষেত্র। তাই আমরা যতটা আনন্দ করি ততটা পূজার উপাচারের দিকে খেয়াল করি না। খেয়াল করলে দেখব যে ১০৮ টা পদ্মফুলের ব্যবহার এই পুজোর জন্য খুবই আবশ্যিক। সন্ধিপুজো তো ১০৮ পদ্মফুল ছাড়া ভাবাই যায় না। অন্যান্য পুজোতেও পদ্মফুল সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেন এই পদ্মফুল এত জরুরি তা আসুন জেনে নেই।
রামের অকালবোধন ও পদ্ম
রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময়ে রামকে বলা হয় দেবী দুর্গার শরতকালে অকালবোধন করতে। রাবণ ও লঙ্কাপুরী ভদ্রকালীর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সুরক্ষিত ছিল। তাছাড়া রাবণ দেবীর আরাধনা করে তার রথকে দেবীর আশীর্বাদে সুরক্ষিত করেন। তাই রাবণকে ধ্বংস করতে হলে আগে তাকে দেবী ভদ্রকালীর সুরক্ষা থেকে বের করে আনতে হত। তাই রাম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। কিন্তু, দেবী কিছুতেই সন্তুষ্ট হচ্ছেন না দেখে বিভীষণ রামকে পরামর্শ দেন ১০৮ নীল পদ্ম দিয়ে দেবীর পুজো করার জন্য।
রামের আদেশে হনুমান দেবীদহে গেলেন যেখানেই একমাত্র নীল পদ্ম পাওয়া যায়। পদ্ম আনার পর পুজো করতে করতে রাম দেখেন একটি পদ্ম নেই। তখন রাম নিজ পদ্ম সদৃশ চোখ দেবীকে দান করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন দেবী আবির্ভূত হন ও এই বর দেন যে তিনি রাবণের থেকে নিজ সুরক্ষা সরিয়ে নেবেন। রাম পুজো শুরু করেন ষষ্ঠীতে, দেবী অষ্টমী ও নবমী তিথির মাঝে রামের অস্ত্রে প্রবেশ করেন। দশমীর দিন রাবণের বধ হয়। এই কারণে ১০৮ পদ্মফুল এত গুরুত্বপূর্ণ । কার্যসিদ্ধিতে সহায়তা করে পদ্মফুল বলে ধরা হয়।
সন্ধিপূজা ও পদ্মফুল
দুর্গাপুজোর অন্যতম অংশ হল সন্ধিপুজো। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট হল, মোট ৪৮ মিনিট সন্ধিক্ষণ। পুরাণ মতে দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে রত তখন তাঁর দুই সেনা চন্ড ও মুন্ড দেবীকে আক্রমণ করে। তখন দেবী দুর্গার তৃতীয় নয়ন থেকে এক দেবীর আবির্ভাব হয় যিনি চন্ড ও মুন্ডকে বধ করেন। এই কারনে দেবীর নাম হয় চামুন্ডা। সন্ধিক্ষনে আসলে দেবী চামুণ্ডারই পূজা হয় ১০৮ পদ্ম ও ১০৮ প্রদীপ জ্বালিয়ে।
পদ্ম ও ১০৮ সংখ্যার গুরুত্ব
আমাদের দেশের জাতীয় ফুল হল পদ্ম। পদ্মফুলের বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য আমাদের নজর টানে। পদ্মফুলের জন্ম পাঁকে। কিন্তু, তবুও পদ্মফুল পাঁক থেকে ওঠে গায়ে পাঁকের দাগ না নিয়ে। পদ্ম আসলে আমাদের এই ইঙ্গিতই দেয় যে পরিবেশ শেষ কথা নয়। খারাপ পরিবেশে জন্মেও অনেক ভালো কাজ করা যায়, যেমন পাঁকে জন্মে পদ্ম আমাদের দেশের জাতীয় ফুল, যে কোন পূজার আবশ্যিক অঙ্গ। আবার পদ্ম যেহেতু কাদায় জন্মেও কাদা নিজ শরীরে না লাগিয়ে বেড়ে ওঠে, তেমনি মানুষেরও উচিৎ পরিস্থিতির দাস না হয়ে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো। সংসারের আবর্জনা যেন মানুষের বিকাশে বাধা না হয়। আমাদের মনে আসতে পারে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা। মনে আসতে পারে গীতার কথা যেখানে পদ্মেরই উদাহরণ আছে। পদ্ম এই বিশেষ দিকগুলোর প্রতীক পবিত্রতার পাশাপশি।
আমাদের হিন্দু শাস্ত্র মতে ১০৮ সংখ্যাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেবতাদের থাকে অষ্টোত্তর শতনাম। ১০৮ পদ্ম, ১০৮ প্রদীপ। যোগের ক্ষেত্রেও ১০৮ সংখ্যাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আয়ুর্বেদ মতে আমাদের শরীরে ১০৮ টি ‘পয়েন্ট’ আছে। আমাদের হিন্দু শাস্ত্র যন্ত্রের পূজায় বিশ্বাস করে। শ্রী চক্র যন্ত্রে ৫৪ টি করে কোন পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন হিসাবে দেখা হয়, যার থেকে সৃষ্টি, অর্থাৎ এখানেও ১০৮।
আমরা মোটামুটি দেখার বা জানার চেষ্টা করলাম ১০৮ টি পদ্মফুল লাগে কেন সেই বিষয়ে। সামনেই আসছে পুজো। সবার পুজো ভালো কাটুক।
মন্তব্য করুন