আমাদের বাংলা নানা দিক থেকে খুব সমৃদ্ধ। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প সব দিক থেকেই আমাদের বাংলা বহু প্রাচীন কাল থেকেই ইতিহাসে নির্দিষ্ট স্থান করে নিয়েছে। এই সবের পাশাপাশি আরেকটা দিক থেকেও আমাদের গর্বিত হওয়া উচিৎ, সেটা হল আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক বোধ।
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আমাদের বাংলা
বাংলা বরাবরই রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে নানা সময়ে, সেটা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে হলেও। স্বাধীনতার আগে তো বটেই, স্বাধীনতার পরেও আমাদের বাংলা থেকে আমরা অনেক মহান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতাকে পাই যারা তাঁদের বিচক্ষণতা, বুদ্ধি ও ভাষণের মাধ্যমে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। আমরা জানি যে ইন্দিরা গান্ধী খুবই ভরসা করতেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মতামতকে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিজেপি দলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। বর্ষীয়ান নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় তো আমাদের দেশের প্রথম বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু, আজ কী আমরা এই রাজনৈতিক পরিবেশের উত্তরসূরী হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলতে পেরেছি? আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়া কী আমাদের সবার চোখে ছোট করে দিচ্ছে না!
রাজনীতির কূট-কচালী
রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা দলের অবস্থান স্বাভাবিক। প্রধান শাসক দল ও তার বিরোধী দল নিয়েই তো রাজনীতির লড়াই জমে ওঠে। কিন্তু, যে কোন দলেরই প্রধান লক্ষ্য থাকা উচিৎ সাধারণ মানুষের যাতে ভালো হয় সেটা দেখা। কিন্তু, আমরা আমাদের রাজ্যে তার থেকে বেশি দলাদলি দেখতে অভ্যস্থ। প্রথমে বড় দলগুলোর কথা বলি। এই দলাদলির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য অশ্লীল কথা বলা। আমরা ভুলে যাই নি বাম নেতা অনিল শীলের তখনকার বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বলা অশ্লীল কথা। নানা অঙ্গভঙ্গি করেও কথা বলতে দেখা গেছে আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যা একজন মহিলার উদ্দেশে করা ঠিক না। অন্যান্য দলও যে এর বাইরে, এমনকি খোদ শাসক দলও যে বাইরে তা নয়। আমরা তাপস পালের কথাগুলো কেউ ভুলি নি। তার মত মানুষের থেকে এই ধরনের কথা শোনা আমাদের দুর্ভাগ্য।
ঘটনার দলাদলি
কোন ঘটনা ঘটলেই আমরা আগে তার সঙ্গে রাজনৈতিক রঙ জড়িয়ে অন্য দলকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করি। সেটা কামদুনির ধর্ষণ কান্ড হোক কি পার্কস্ট্রীটের ধর্ষণকান্ড। পোস্তার সামনে ব্রিজ ভেঙ্গে পড়লে দলগুলো এটা বলতে শুরু করেন যে কার আমলে ব্রিজটা তৈরি, যে সংস্থা এই নির্মানের সঙ্গে যুক্ত, সেটা কোন দলের সঙ্গে যুক্ত।
আহত ও নিহত মানুষদের নিয়ে আলোচনা হয়ত দু-তিনদিন হয়। সারদা কান্ডে এতো মানুষের কষ্টের টাকা নষ্ট হল, কিন্তু, তা নিয়ে কারোরই কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। কীভাবে টাকাগুলো ফেরত আনা যায় ও সবার মধ্যে দিয়ে দেওয়া যায় সে নিয়ে চিন্তার থেকেও বেশি চিন্তিত তারা কীভাবে কোন দলের নেতাদের জড়িয়ে কুৎসা করা যায় ও ফায়দা লোটা যায়। সরকার যদি কোন ব্যবস্থা করেও থাকেন টাকা ফেরতের সেখানেও অন্যান্য দল সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব?
আরেকটি বিষয় হল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এই বিষয়টা ইদানিং খুবই বেড়ে গেছে। এর ফলে দলের মধ্যেই কত লোকের মৃত্যু হয় বিনা কারণে। সবের মূলেই আসলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা।
রাজনীতি কলেজে কলেজেও
এবার আসা যাক কলেজ রাজনীতিতে। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশই কলেজ রাজনীতি করে উঠে আসা, সে সব দলেরই। কিন্তু, তাদের মধ্যে সাধারণ সহবত জ্ঞান ছিল। বর্তমানে সেখানে অনেকাংশেই শুধু দলীয় স্বার্থই চলে আসছে। রাজনীতির শিক্ষা ভালোভাবে না হওয়ার জন্য সঠিক পথ অনেকসময় নেওয়া সম্ভব হয় না। এতটাই রাজনীতি বেড়ে গেছে যে সরকারকে ক্যাম্পাসের নির্বাচন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ার বাইরে করানোর কথা ভাবতে হচ্ছে।
কলেজের মধ্যেও কোন ঘটনা ঘটলে নানা ছাত্রদল একে অন্যকে দোষারোপ করে। আর অনেকসময় এই সবের মধ্যে ইন্ধন দেন এক শ্রেনীর শিক্ষক-অধ্যাপক যারাও নানা দলের সঙ্গে যুক্ত।
দলাদলিতে ধর্মও?
রাজ্যে দলাদলির আরেকটি বড় জায়গা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল এমন একটা বিষয় দেখায় যেন সংখ্যালঘুর জন্য তাঁরা অনেক চিন্তিত। কিন্তু, আদৌ কি সত্যিই কোন উন্নতি সেভাবে হয় তাদের? যদি ইমাম ভাতা দেওয়া হয় তাহলে পুরোহিতদের কেন দেওয়া হবে না এ নিয়ে কথা ওঠে। বসিরহাটে যে প্রায় দাঙ্গার মত অবস্থা হল তা নিয়ে তেমনভাবে কোন দলকে মুখ খুলতে দেখা গেল না কারণ এখানে ভোটবাক্স যুক্ত। নৈহাটির দিকে কিছু জায়গা, হাওড়ার ধূলাগড়ের দিকে বা বারাসাতের দিকে অনেকসময়তেই এইরকম দাঙ্গার পরিস্থিতি হয়। তখন আসল বিষয়টা না দেখে সবাই বিপরীত দলের দিকে আঙুল তোলে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত রাখেন। বিধ্বস্ত মানুষদের কথা ওই দুএকদিন বললেই যথেষ্ট।
আসলে এই কথাটা ভুলে যান প্রায় সব দল যে বিরোধী দল হল শাসকের প্রধান আয়না। সেটা হয়ে ওঠাই তার প্রধান কাজ। আর শাসকদলের কাজ সেই আয়নায় নিরন্তর নিজেদের দেখে শোধন করা। এই সমীকরণ যতদিন না তৈরি হবে ততদিন এই দলীয় ক্ষুদ্র রাজনীতি, দলাদলির বাইরে বেরনো সম্ভব নয়।
মন্তব্য করুন