বিদ্রোহী কবি ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান”। অর্থাৎ, হিন্দু-মুসলমান কোন ভিন্ন সত্তা নয়, সবই অভিন্ন ‘মনুষ্যত্ব’ নামক বৃক্ষের ফুল। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে খ্রিস্টান, তা অতি তুচ্ছ। মানবধর্মের কাছে সবাই সমান। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, সংখ্যালঘুতার চাইতে বড় অভিশাপ আর কিছু নেই।
কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ে তান্ডবঃ
ঘটনার সূত্রপাত কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড় এলাকায় একটি পূজা মন্ডপ থেকে। পূজা চলাকালীন সময়ে হঠাৎ আবিষ্কৃত হয় মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ দেবী মূর্তির পায়ের কাছে। আবিষ্কার হওয়া মাত্রই দাবানলের মতো এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার হতে থাকে বিতর্কিত এই ছবি। সেখান থেকে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ছবির সাথে যোগ হয় উস্কানিমূলক মন্তব্য ও নানা কটু কথা। কে বা কারা কোরআন শরীফ এভাবে রেখেছে তা না জানা গেলেও, ততক্ষণে শুরু হয়ে যায় পূজা মন্ডপে হামলা।
নানুয়া দীঘিপাড়ের মূর্তিটি ভেঙে পুকুরে ফেলে দেয়া হয় পুলিশ আসার আগেই। ঘটনাস্থলে ৩ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এই ঘটনার তিনদিনের মধ্যে সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০০টির মতো দূর্গামূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। বাংলাদেশ হিন্দু কাউন্সিলের মতে, সনাতনী ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যই এমন ভয়াবহতা ঘটানো হয়েছে।
সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, দেবীমূর্তির নিচে কুরআন শরীফ রাখা ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পরিচয় পাওয়া গেছে তার, নাম ইকবাল হোসেন। তবে কেন সে এই কাজটা করেছে সেটা সম্পর্কে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় দুষ্কৃতিকারীদের হামলা
কুমিল্লার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রংপুরের হিন্দু অধ্যুষিত ঠাকুরপাড়ায় দুষ্কৃতিকারীরা হামলা চালায়। এই ঘটনার সূত্রপাত হয় একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে। তাও আবার সেটি ছিল চার বছর আগে দেয়া স্ট্যাটাস।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর ‘ভালোবাসার প্রস্তাব’ নামে একটি আইডিতে কা’বা শরীফের ছবি ছিল প্রোফাইল ফটো হিসেবে। সেখানে করা একটি উস্কানিমূলক কমেন্ট থেকে রংপুরে হামলার সূত্রপাত ঘটে। পুলিশের ধারণা, কমেন্টকারীর আইডিটা ফেক ছিল।
সেই কমেন্টের জেরে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি, দোকান, মন্দিরে হামলা হয়। হয় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো ধিক্কারজনক ঘটনা। মোট ৩টি গ্রামে ৫০টিরও বেশি বাড়িতে এই ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায় নি।
ক্ষতিগ্রস্তরা প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে ছিল জঙ্গলে ও ধানক্ষেতে। আগুনে তাদের সর্বস্ব পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী জানান, প্রাণের ভয়ে নিজের শিশু সন্তানসহ বেরিয়ে এসেছেন সহায়-সম্বল ছাড়া। এখন তাদের কিছুই অবশিষ্ট নেই৷ সন্তানকে কি খাওয়াবেন তাও জানেন না।
কুমিল্লার ঘটনার পর থেকে পুলিশ ও প্রশাসন সতর্ক ছিল। তাই দুর্বৃত্তরা এর চাইতে বড় কোন অঘটন ঘটাতে পারেনি বলে দাবি করেছেন রংপুরের রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫০ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ধর্ম বনাম অনুভূতি
ধর্ম মানুষের সবচাইতে দুর্বল জায়গা। যার জেরে যুগের পর যুগ ধরে হয়ে এসেছে মারামারি, হানাহানি। বাংলাদেশ বাঙালির দেশ। এখানে ধর্মের চাইতে বড় পরিচয় হচ্ছে জাতীয়তা, বাংলা ভাষা। অথচ সেই জাতীয়তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে নষ্ট করায় লিপ্ত থাকে কুচক্রী মহল।
ধর্মকে পুঁজি করে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিষবাস্প। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক করার ষড়যন্ত্র করে চলেছে।
কোন ধর্মেই সহিংসতাকে বড় করে দেখানো হয়নি। এটা কখনোই কোন কিছুর সমাধান হতে পারেনা। কুরআন অবমাননার প্রতিবাদে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের হামলা ইসলামের প্রকৃত অর্থ নষ্ট করেছে। কারণ, প্রকৃত মুসলমান কখনোই উগ্র, চরমপন্থী হবে না। অন্য ধর্মকে অসম্মান বা বিনাশ করবেনা।
শুধু ইসলাম নয়, এই কথাটি প্রতিটি ধর্মের জন্য প্রযোজ্য। ধর্ম সম্পর্কে যার মনে ন্যূনতম শ্রদ্বাবোধ আছে, তার অনুভূতি কখনোই উস্কানিমূলক কর্মকান্ডে প্ররোচিত হবে না। অথবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষতি করবেনা। যা কেবল ঠুনকো ধার্মিকদের পক্ষেই সম্ভব।
ধর্ম যার যার, উৎসব তার তার
সবাই নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে, এটা তাদের মৌলিক অধিকার। এক ধর্মের অনুসারী হয়ে অন্য ধর্মের উৎসব নিয়ে কোনরূপ কটাক্ষ, বিদ্রূপ, উগ্রতা বা বাড়াবাড়ি দেখানো চলবে না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের বাঙালিরা নিজেদের ধর্মান্ধতার কারণে এই সাধারণ কথাগুলো ভুলতে বসেছে।
লাল রক্তে না লেখা থাকে ধর্ম, না সামাজিক স্ট্যাটাস, না জাতীয়তা। শুধু মনে থাকে বিশ্বাস, যা সকল বাঙালির একমাত্র বন্ধন। বাঙালির দেশ বাংলাদেশে এই তান্ডবলীলা কখনোই কাম্য নয়। এখানে সব ধর্ম, বর্ণ, বংশের মানুষের নির্বিঘ্নে বাঁচার অধিকার আছে। যতদিন না এই সত্য বাংলাদেশের উগ্রপন্থী মুসলিমরা বুঝতে পারবে, ততদিন পর্যন্ত তারা ধর্মান্ধতার ছোবল থেকে বের হতে পারবেনা।
মন্তব্য করুন