ইংরেজিতে Fenugreek, বিজ্ঞানে Trigonella foenum-graecum, আর বাংলায় মেথি – যে নামেই ডাকুন না কেন, এর গুণের কিন্তু তারিফ করতেই হয়। অসংখ্য পুষ্টি উপাদানে ভরপুর মেথি রান্নায় স্বাদ যোগ করার পাশাপাশি চুলেও এনে দেয় চিরাচরিত ছন্দ।
ইট-কাঠ-পাথরের শহরে চুলের বেহাল দশায় ভোগেন সবাই। চুল পাকা, ফেটে যাওয়া, গোড়া আলগা হয়ে যাওয়া, লালচে হওয়া, খুশকি ইত্যাদির সমাধানে একমাত্র মেথিই পারে তাক লাগানো ফলাফল দিতে।
আজকের আয়োজনে থাকছে মেথির তেল ঘরে বানানোর পদ্ধতি আর চুলের যত্নে এর ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত।
মেথির তেলের উপকারিতা কি?
- চুলের সমস্যাগুলোর মধ্যে খুশকি একটি অতিপরিচিত সমস্যা। আর এই খুশকি দমনের জন্য মেথির চাইতে কার্যকরী ওষুধ আর হয় না। মাথার ত্বকে যখন ঈস্ট তৈরি হয় তখন সেগুলোই খুশকির জন্ম দেয়। মেথির অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান ঈস্ট দমন করে খুশকির জন্ম প্রতিরোধ করে।
- মেথি দিয়ে প্রাকৃতিকভাবেই পান মজবুত ও লম্বা চুল। কারণ এতে আছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন এবং প্রোটিন, যা চুলের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্টস। নিয়মিত মেথির তেল মাসাজে চুলে প্রাণ ফিরে আসে এবং হয় মনের মতো সুন্দর।
- চুলকে স্ট্রেইট, কার্লি, ওয়েভি, কালার করার জন্য আমরা যেসব যন্ত্রপাতি এবং কেমিক্যাল ব্যবহার করি তাতে চুলের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যায় এবং ভেঙে যায়। মেথি চুলের হারিয়ে যাওয়া স্বাভাবিকতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম।
- চুলকে দ্রুত লম্বা করার উপায় খুঁজছেন? মেথির তেল আপনার চিন্তা দূর করতে সাহায্য করবে। চুলের বৃদ্ধির জন্য দরকার ভিটামিন এ, কে, সি, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়ামের মতো উপাদান। মেথি এসবের জন্য ভালো একটি উৎস।
- যেহেতু মেথি চুল মজবুত ও লম্বা করে, যারা দীর্ঘদিন ধরে চুল পড়ার সমস্যায় ভুগছেন তারা আজ থেকেই মেথির তেল ব্যবহার করতে পারেন। কারণ এতে আছে নিকোটিন অ্যাসিড ও লেসিথিন। এই তেল আপনার চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, চুল পড়া আটকাতে সাহায্য করবে, এবং চুলের ঘনত্ব বাড়াবে।
- এছাড়াও অল্প বয়সে চুলকে পেকে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যও মেথি একটি জাদুকরী হার্ব।
মেথির তেল ঘরে বানানোর পদ্ধতিঃ
- প্রথমে একটি কাচের জারে আধা কাপ আস্ত মেথির দানা নিন। অথবা ব্লেন্ডারে দানা মিহি গুঁড়া করেও নিতে পারেন।
- এবারে জারে দানার সাথে যেকোন একটি তেল মিশিয়ে ভিজিয়ে রাখুন। আপনি নারিকেল তেল, জলপাই তেল, জোজোবা অয়েল, আমন্ড অয়েল ইত্যাদির মধ্যে যেকোন একটি নিতে পারেন। সবগুলো তেলের মধ্যে নারিকেল তেল বেশি ভালো।
- দানা ও তেল একসাথে মিশানোর পরে জারের মুখ ভালো করে আটকে পরিষ্কার, শুষ্ক, ও সূর্যের আলো আসেনা এমন স্থানে রেখে দিন। ৩ থেকে ৬ সপ্তাহ তেল এভাবেই রেখে দিতে হবে। যতদিন যাবে তত দানার নির্যাস তেলের সাথে ভালোভাবে মিশবে এবং রং গাঢ় হতে থাকবে।
- ৬ সপ্তাহ পরে তেলটা ছাঁকনি বা সুতি কাপড়ে চিপে দানা আলাদা করে ফেলে দিন।
- এবারে পরিষ্কার প্লাস্টিকের বোতলে তেলটা ঢেলে ফ্রিজে রেখে দিন। সর্বোচ্চ এক মাস পর্যন্ত এই তেল ব্যবহার করতে পারবেন। যখন দেখবেন তেলের ভিতর ফেনার মতো তৈরি হয়ে গেছে, তখনই বুঝবেন তেলটা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। ঐ তেল ফেলে দিয়ে পুনরায় একই পদ্ধতিতে আবার মেথির তেল বানিয়ে নিন।
- আরেকভাবেও মেথির তেল বানাতে পারবেন। ১ কাপ নারিকেল তেলে ১ চা চামচ মেথি চুলায় দিয়ে ফুটাতে থাকুন। যখন রং গাঢ় হয়ে আসবে তখন চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করে বোতলে ঢেলে নিন। এই পদ্ধতিতে মেথি তেল থেকে আলাদা করার দরকার নেই।
চুলের যত্নে মেথির তেলের ব্যবহারঃ
চুলের যত্নে মেথিকে তেল বানিয়ে ব্যবহার করতে পারেন আবার হেয়ার মাস্ক হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন। যেভাবেই ব্যবহার করুন না কেন উপাদানের পরিমাণ সঠিক মাত্রায় থাকা চাই।
ব্যবহার ১ঃ
- ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন কিভাবে মেথির তেল তৈরি করতে হয়। নিয়ম মেনে তেল বানিয়ে স্ক্যাল্পে লাগিয়ে নিন আর চুলের ঝরে যাওয়া আর পেকে যাওয়া রোধ করুন।
- পরিমাণমতো নারিকেল তেল আর মেথির দানা নিয়ে গরম করুন। মেথির দানা যখন লাল হয়ে আসবে তখন তেলটা নামিয়ে ঠান্ডা করে নিন। দানা চিপে বের করে তেলটা বোতলে ভরে নিন।
- মেথি-নারিকেলের মিশ্রণ রাতে ঘুমানোর আগে মাথার ত্বকে ও চুলে মাসাজ করবেন। যদি রাতে তেল দেয়ার কথা মনে না থাকে তাহলে গোসলের এক থেকে দুই ঘন্টা আগে তেল মাসাজ করবেন মাথায়। রাতে লাগান বা গোসলের আগে, অবশ্যই শ্যাম্পু করতে ভুলবেন না। সপ্তাহে দুইদিন ব্যবহার করলে ভালো ফল পাবেন, তবে চুল বেশি পড়লে তিনদিন ব্যবহার করবেন।
ব্যবহার ২ঃ
- ড্রাই স্ক্যাল্পের জন্য মেথির তেলের সাথে ডিমের কুসুম যোগ করতে পারেন। তাতে স্ক্যাল্পের চুলকানি ভাব কমবে এবং চুলকে সিল্কি ও জেল্লাদার করবে। একটি বাটিতে ১ টেবিল চামচ মেথির তেলের সাথে ১টা ডিমের কুসুম নিয়ে নাড়তে থাকুন।
- এমনভাবে নাড়ুন যাতে কুসুমটা তেলের সাথে ভালোমতো মিশে যায়। মেশানো হয়ে গেলে মিশ্রণটা স্ক্যাল্প খেকে শুরু করে চুলে মাসাজ করে লাগিয়ে নিন। ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পর শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে একবার করে মেথি-ডিমের এই মিশ্রণ ব্যবহার করবেন।
ব্যবহার ৩ঃ
নারিকেল তেলে মেথি মিশিয়ে অন্যভাবে ব্যবহার করে চুল পেকে যাওয়া বন্ধ করতে পারেন। টানা দুইদিন তেলে মেথির দানা ভিজিয়ে রাখুন। ব্যবহারের আগে তেলটা হালকা গরম করে তারপর মাসাজ করুন। সপ্তাহে দুইদিন এই টনিক ব্যবহার করলেই যথেষ্ট।
ব্যবহার ৪ঃ
- ২ টেবিল চামচ মেথির তেলের সাথে ১ টেবিল চামচ পাতিলেবুর রস মিশিয়ে ১০ মিনিট রেখে দিন। এবারে তেল নিয়ে স্ক্যাল্পে মাসাজ করে ৩০ মিনিট রেখে দিন। সপ্তাহে দুইদিন এভাবে মাসাজ করে শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলুন। লেবুর রস বিশেষ করে খুশকি ভরা মাথার জন্য বেশি উপযোগী।
- চাইলে আরেক পদ্ধতিতেও মেথিতে লেবুর রস ব্যবহার করতে পারেন। প্রথমে ১ টেবিল চামচ মেথি দানা হালকা করে ভেজে রাখুন এবং আধা কাপ নারিকেল তেল গরম করে নিন। তারপরে তেল গরম থাকতেই দানাগুলো দিয়ে ১০ মিনিট রেখে দিন।
- তেলটা ঠান্ডা হলে এর সাথে ২ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। যদি এর সাথে একটু জলপাই তেল যোগ করেন তাহলে ভালো ফল পাবেন, না করলেও সমস্যা নেই। লেবু মেশানো হয়ে গেলে তেলটা চুলের গোড়ায় ৩০ মিনিট ধরে মাসাজ করুন। সপ্তাহে তিনদিন রাতে ঘুমানোর আগে এভাবে মাসাজ করবেন। সকালে শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলবেন।
ব্যবহার ৫ঃ
- মেথির তেল, নারিকেল তেল, জলপাই তেল, আমন্ড অয়েল প্রতিটা ১ টেবিল চামচ করে নিন। সবগুলো তেল একসাথে মিশিয়ে হালকা গরম করে নিন। স্ক্যাল্পে ও চুলে মাসাজ করে ৪৫ মিনিট রেখে দিন।
- এরপরে শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার দিয়ে চুল পরিষ্কার করুন। এই পাঁচমিশালি তেল সপ্তাহে একদিন বা মাসে সর্বোচ্চ দুইবার ব্যবহার করবেন, এর বেশি না। এটি চুল পড়া দূর করে, বিশেষ আগা ফাটা বন্ধ করতে উপকারী।
ব্যবহার ৬ঃ
- আগের রাতে এরপরে ২ টেবিল চামচ মেথিদানা ধুয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখবেন। সকালে ভেজা দানা পাটায় বা ব্লেন্ডারে ভালো করে বেটে নিবেন যাতে দানা আস্ত না থাকে। বাটা মেথির সাথে ১ কাপ টকদই ভালমতো মিশিয়ে ২ থেকে ৩ ঘন্টা রেখে দিবেন। ভালো ফল পেতে চাইলে মিশ্রণে ১ চা চামচ মেথির তেল দিতে পারেন।
- এবারে চুলে মিশ্রণ লাগানোর পালা। প্রথমে প্রয়োজনমতো মেথির তেল স্ক্যাল্পে মাসাজ করে নিবেন। তবে যদি আপনার চুল অতিরিক্ত শুষ্ক হয় তাহলে আগে তেল দিবেন। নাহলে দেয়ার খুব একটা দরকার নেই। প্রয়োজন বুঝে তেল লাগানোর পরে মেথি-দইয়ের হেয়ার মাস্ক চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত লাগিয়ে নিন।
- মাস্ক চুলে লাগিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপরে শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার যোগে চুল ধুয়ে ফেলুন৷ সপ্তাহে একবার করে বা মাসে সর্বোচ্চ দুইবার এই মাস্ক ব্যবহার করবেন।
সতর্কতাঃ
- আপনার মেথিতে অ্যালার্জি থাকলে মেথি থেকে দূরে থাকুন। যদি অ্যালার্জির ব্যাপারটা জানা না থাকে তাহলে যেকোন একটি পদ্ধতি আগে ট্রাই করে দেখুন। সমস্যা হলে এড়িয়ে যান, না হলে নিশ্চিন্তে মেথির তেল ব্যবহার করতে পারেন।
- চুলে মেথি ব্যবহারের জন্য সর্বোত্তম সময় হচ্ছে মাসে দুই থেকে চারদিন। সপ্তাহে যদি দুইদিন তেল ব্যবহার করেন তাহলে পরপর দুইদিন করবেন না। অবশ্যই মাঝখানে কিছুদিন গ্যাপ দিবেন।
- অনেকে মেথি পাউডার করে বা বেটে ব্যবহার তারপর তেলে ব্যবহার করেন। এতে চুলে মেথির গুঁড়া আটকে থাকে, ভালো পরিষ্কার না হলে ওগুলোই চুলে জমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে৷ তাই গুঁড়ার বদলে আস্ত মেথি দানা ব্যবহার করুন।
মন্তব্য করুন