দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থাকার পর কমবেশি প্রত্যেকেরই মন উড়ু উড়ু করে, মনে হয় দিন কয়েকের ছুটিতে কোথাও থেকে একটা ঘুরে এলে মন্দ হয়না। এখন সব সময় দীর্ঘ ছুটি পাওয়া যায় না, কাজের ফাঁকে হয়ত অল্প সময়ের ছুটি মেলে, অল্প দিনের সেই ছুটিতে কোথায় ঘুরবেন এটাও একটা চিন্তার বিষয়।
তবে কাজের ব্যস্ততার মধ্যে থেকে দুই-তিন দিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে পরিবার নিয়ে ঐতিহাসিক স্থান মুর্শিদাবাদ থেকে ঘুরে আসতেই পারেন। কিন্তু মুর্শিদাবাদ তো আর ছোটো জায়গা নয়, সেখানে ঘুরবেন কীভাবে? চিন্তা নেই বন্ধু, আপনারা কীভাবে মুর্শিদাবাদে পৌঁছাবেন আর গিয়ে কোথায় উঠবেন, সেখানে গিয়ে কোন কোন জায়গাই বা দেখবেন- সব কিছুর হাল-হকিকত জানাতে দাশবাস হাজির।
১. কীভাবে যাবেন?
শিয়ালদহ থেকে লালগোলাগামী যে কোন ট্রেনে করেই মুর্শিদাবাদ যাওয়া যাবে। শিয়ালদা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব ১৯৫ কিমি তাই ট্রেনে করে গেলে মোটামুটি পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই ঐতিহাসিক জেলায় পৌঁছে যাবেন।
কলকাতা থেকে সকাল ৬:৫০ মিনিটে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস ধরলে সকাল ১১ টা নাগাদ মুর্শিদাবাদে পৌঁছে যাবেন। এছাড়া কলকাতা থেকে প্রচুর সরকারি ও বেসরকারি বাস বহরমপুর যায়, এক্ষেত্রেও ৬ ঘন্টা সময় লাগে। সেখান থেকে লালবাগ ১০ কিমি। বাস থেকে নেমে একটা অটো রিক্সা করেই পৌঁছে যাবেন লালবাগ।
২. কোন সময়ে যাবেন?
বর্ষাও গরমের সময়টা বাদ দিয়ে আপনার মনমতো যেকোনো সময় মুর্শিদাবাদ ঘুরতে যেতে পারেন।
অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে যে কোন সময় দিন তিনেকের ছুটি নিয়ে মুর্শিদাবাদ যেতে পারেন।
৩. কোথায় থাকবেন?
পুরো মুর্শিদাবাদেই অসংখ্য সস্তা থেকে মাঝারি মানের হোটেল ছড়িয়ে আছে। এখানকার হোটেলগুলোতে ভাড়া মোটামুটি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। বহরমপুরে পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়ন নিগমের টুরিস্ট লজ আছে সেখানে ভাড়া পনেরোশো টাকা।
হাজারদুয়ারীর কাছে আছে ইয়ুথ হোস্টেল, PWD এর রেস্ট হাউস আর পৌর অতিথি নিবাস রয়েছে। এছাড়া লালবাগে সম্রাট হোটেল, ইন্দ্রজিৎ হোটেল, হোটেল অন্বেষা, মঞ্জুষা নামের একাধিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া বহরমপুরে লালদিঘির কাছে রয়েছে বহরমপুর লজ- এগুলোর মধ্যে কোন একটাই থেকে যেতে পারেন।
৪. কীভাবে ভ্রমণের প্ল্যান করবেন?
ট্যুর গাইড প্রথমদিনঃ
প্রথম দিন সকাল এগারোটা নাগাদ ট্রেন থেকে নেমেই সোজা হোটেলে চেকিং করে একটু রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন লালবাগের মতিঝিলের উদ্দেশ্য। লাঞ্চটা বাইরেই সেরে নেবেন।
ক. মতিঝিলঃ
মতিঝিল হলো একটি ইউ আকৃতির ঝিল। নবাব আলীবর্দী খাঁর জামাই এটি তৈরি করেছিলেন। এখানে একসময় মুক্ত চাষ হতো। মতিঝিলের অপরূপ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। গোটা মতিঝিল ঘুরে দেখতে ২ ঘন্টা সময় তো লাগবেই।
এখানে একটি মসজিদ ও আছে, মসজিদের পাশে আছে একটি ঘর, সেখানকার দেয়ালের শক্ত ইটের গাঁথুনি কেউ কখনো ভাঙতে পারেনি। লালবাগে মতিঝিল দুটো আছে একটি পুরোনো একটি নতুন- এই দুটি মতিঝিল ঘুরবার মাঝে পথের ধারের কোন দোকান থেকে দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে নিতে ভুলবেন না।
নতুন মতিঝিলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইকো পার্কের মতো করে একটি বিশ্ব বাংলা পার্ক তৈরি করেছে। আপনি সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কে সময় কাটান, এখানে সন্ধ্যার পর মুর্শিদাবাদ ইতিহাসকে অবলম্বন করে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’ হয়, আপনি এই শো টি দেখে তবেই হোটেলে ফিরে আসুন। তারপর হোটেলে ফিরে হাল্কা কোন খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
দ্বিতীয় দিনঃ
ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন খুব সকালেই একটি গাড়ি বা টোটো ভাড়া করে বেরিয়ে পড়তে হবে। প্রথমে জাহানকোষা কামান দেখে আসুন। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করার সময় এটি নিয়ে আসেন। এই কামানটির দৈর্ঘ্য ১৭ ফুট ৬ ইঞ্চি। এই কামানটির ওজন ২১২ মন। বিস্ফোরণের জন্য এই কামানটিতে ১৭ কিলো বারুদ লাগতো।
ক. জাহানকোষা কামান ও কাটরা মসজিদঃ
জাহানকোষা কামান দেখে ঐতিহাসিক কাটরা মসজিদে চলে যান। এই কাটরা মসজিদে নামাজ পড়ার পাশাপাশি ছাত্রাবাসও ছিল। মসজিদের সামনের দিকের চাতালে একসাথে অনেক লোক মিলে নামাজ পড়তে পারতেন। মসজিদের প্রবেশ সিঁড়ির নীচেই দেখতে পাবেন মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি। নবাবের ইচ্ছাতেই তাকে সিঁড়ির নীচে কবর দেওয়া হয়েছিলো। মসজিদের পাঁচটা গম্বুজের মধ্যে তিনটে ভূমিকম্পে ভেঙ্গে গেছে। এই মসজিদের ছাদটি পুরোপুরি অনাবৃত।
কাটরা মসজিদ দেখে বেরিয়ে পথের মধ্যে দেখে নিন ফুটি মসজিদ। অনাদরে ধ্বংস প্রাপ্ত এই মন্দির আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে রয়ে গিয়েছে। এরপরের গন্তব্য স্থল হলো কাঠগোলা বাগান।
খ. কাঠগোলা বাগানঃ
কাঠগোলাপ বাগান পূর্ব বাংলার নবাবদের রাজধানী ছিল। কাঠগোলা প্রাসাদটি লক্ষ্মীপুর সিং দুর্গা দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এটির ভিতরে একটি চিড়িয়াখানা ও জৈন মন্দির আছে। জৈন মন্দিরের সামনে একটি ছোট লেকে বোটিং এর ব্যবস্থা করা আছে। কাঠগোলা বাগানের নামেই রয়েছে বাগান তাই বুঝতে পারছেন, ভিতরে নানান রকম ফুলের বাগান আপনাকে মুগ্ধ করবে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন ধারাবাহিকের শুটিং হয়েছে এই কাঠগোলা বাগানে।
কাঠগোলা বাগান দেখে চলুন জগত শেঠের বসত বাড়ি অর্থাৎ বাসস্থান দেখতে, এটি বর্তমানে একটি মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। জগৎশেঠ ছিলেন একজন ধনকুবের তিনি নবাবদেরকে টাকা ধার দিতেন। তার বাস ভবনটির ভিতরে তার পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলি রয়েছে যেগুলি দেখলেই তাদের আর্থিক অবস্থার কথা অনুমান করা যায়।
গ. নিমক হারাম দেওরিঃ
এটা মীরজাফরের প্রাসাদ, যেখানে মীরজাফরের বংশধররা এখনো বসবাস করেন। এর পরবর্তী গন্তব্য নশিপুর রাজবাড়ী।
ঘ. নশিপুর রাজবাড়ীঃ
চারশো বছর আগেকার নশিপুর রাজবাড়ী দেখলে পুরনো যুগের রাজবাড়ী সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি হবে। এই রাজবাড়ীর চারপাশে রয়েছে বাগান।
ঙ. মীরজাফরের কবরস্থান ও আজিবুন্নেসার সমাধিঃ
নশিপুর রাজবাড়ী দেখা হয়ে গেলে মীরজাফরের কবর স্থান দেখতে যেতে হবে। এখানে মীরজাফর, তার স্ত্রী ও পুত্র মিরনের কবর সহ মীরজাফরের পরিবারের অসংখ্য সদস্যের কবর মিলিয়ে মোট এগারোশো কবর আছে। এরপর কিছুটা গিয়ে রাস্তার ধারেই চোখে পড়ে আজিবুন্নেসার সমাধি, ইনি মুর্শিদকুলি খাঁর কন্যার ছিলেন। ওনাকে ইতিহাসে কলিজা খাকি বেগম বলা হতো, তাই ওনার কবরকে কলিজা খাকি বেগমের কবর বলা হয়। বাবা মুর্শিদকুলি খাঁর মতো তাকেও মসজিদের সিঁড়ির নীচে কবর দেওয়া হয়েছে।
চ. হাজারদুয়ারিঃ
মীরজাফরের কবর স্থান ঘোরার পরে লাঞ্চ করে নিয়ে দুপুর দুটো নাগাদ চলে আসুন হাজারদুয়ারি দেখতে। এটি বর্তমানে একটি সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। যেখানে হাজারটি দরজা আছে, তার মধ্যে ১০০ টি নকল দরজা আর ৯০০ টি আসল দরজা রয়েছে। নবাব হুমায়ুন ঝা এটি নির্মাণ করেন। নবাব ও ইংরেজদের ব্যবহৃত বহু অস্ত্রশস্ত্র,জিনিসপত্র, বাসনপত্র ও আসবাবপত্র সহ বহু শিল্পীদের আঁকা ছবি এখানে রয়েছে। এটি দেখতে অন্ততপক্ষে দুই ঘন্টা সময় লাগবে।
হাজারদুয়ারীর সামনে আছে ইমামবাড়া নবাব সিরাজউদ্দৌলা এটি কাঠ দিয়ে তৈরি করেছিলেন।তবে এটি আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর ১৮৪৭ সালে নবাব মনসুর আলী খান এটি ইট দিয়ে তৈরি করেন।এটিতে খুব সুন্দর ভাস্কর্য আছে। হাজারদুয়ারি মাঠের মধ্যে আছে মদিনা মসজিদ, সিরাজদৌলার দাদু আলিবর্দি খাঁ সুদূর মদিনা থেকে মাটি এনে এটি তৈরি করেছিলেন। এরপর আপনি সন্ধ্যা অবধি হাজারদুয়ারিতে কাটান রাতের হলুদ আলোয় সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখুন।
তৃতীয় দিনঃ
ক. খোশবাগ, রোশনবাগ,ভবানীশ্বর মন্দিরঃ
তৃতীয় দিন গঙ্গার ওপর পাড়ের খোশবাগ থেকে ঘুরে আসুন। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবর রয়েছে খোশবাগে। খোশবাগ মূলত ছিল নবাবদের পারিবারিক অবকাশ যাপন কেন্দ্র , এটি ১৭৪০ সালে নবাব আলীবর্দী খান স্থাপন করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে নবাব আলীবর্দী খাঁ ১৭৫৬ তে মারা গেলে তাকে এখানে দাফন করা হয়।
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে নবাবের শোচনীয় পরাজয়ের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে এখানে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে তার বেগম,সন্তান সহ তার পরিবারের অন্যান্য লোকেদেরকেও এখানে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো। এটি দেখা হয়ে গেলে রোশন বাগ, জগৎবন্ধু ধাম (ডাহাপাড়া) ভবানীশ্বর মন্দির, কিরীটেশ্বরী মাতার মন্দির, ভট্টবটির শিব মন্দির ও রাধামাধব মন্দির ইত্যাদি দেখে বিকেল ৫ নাগাদ হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে করে কলকাতা ফিরুন।
খরচঃ শিয়ালদা থেকে মুর্শিদাবাদ একেকজনের ট্রেন ভাড়া প্রায় ৪৫ টাকা। মতিঝিলে প্রবেশ মূল্য ২০ +২০ =৪০ টাকা। টুকটুকে করে মুর্শিদাবাদ জেলার দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াতে মাথা পিছু নেবে ১২৫ টাকা, কাঠগোলা প্রাসাদের প্রবেশ মূল্য ৩০+২০=৫০ টাকা, জগৎশেঠের বাসভবনে প্রবেশ মূল্য ১৫ টাকা, নসিপুর রাজবাড়ীর প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা, মীরজাফরের বংশধরের কবরখানায় প্রবেশ মূল্য ৫ টাকা, হাজারদুয়ারিতে প্রবেশ মূল্য ২৫ টাকা।
এরপর নৌকা করে খোশবাগ যেতে খরচ পড়বে ১০ টাকা। নৌকা থেকে খোশবাগ যেতে টোটো খরচ পড়বে আরো ১০ টাকা। মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা স্টেশন ফিরতে আরো ৪৫ টাকা, এছাড়া দুপুরের জলখাবারের ৮০ টাকা চিকেন থালি ও সকালের জলখাবার এর ৩০ টাকা ধরে সব মিলিয়ে একেকজন পিছু মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে খরচ পড়বে ৫০০ টাকার কাছাকাছি।
মন্তব্য করুন