ভারত ও মধ্য ভারতে নাগদেবতার পুজো বহুল রূপে প্রচলিত আছে। একটা সময় সাপের দংশনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভয়ের থেকে বহু মানুষ নাগেদের পুজো করতেন আর পরবর্তীতে মনস্কামনা পূরণের জন্য, সন্তান লাভ ও ঐশ্বর্য প্রাপ্তির জন্য নাগেদের পুজো করা চালু হলো।
বছরের যেকোনো সময় সর্প কুলের আরাধনা করা যায় তবে প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে অষ্টনাগের পুজো অধিক ফলপ্রসূ হয়। তাই শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিকে নাগ পঞ্চমী বলা হয়। কথিত আছে নাগ পঞ্চমীর দিন অষ্টনাগের পুজো করলে গ্রহ দোষ কেটে যাওয়ার সাথে সাথে সর্বমনস্কামনা পূরণ হয়। তবে নাগকুল যেমন অতি অল্পেই সন্তুষ্ট হন তেমনি তিনি আবার অল্পেই কুপিত হন, তাই আজকের প্রতিবেদন বন্ধুদের বলবো নাগ পঞ্চমীর দিন কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়।
২০২১ এর নাগ পঞ্চমী কবে ও পুজোর সঠিক সময়ঃ
- এইবছর অর্থাৎ ২০২১ এর নাগ পঞ্চমী পরছে আগামী ২৮ শে জুলাই অর্থাৎ বুধবার।
- নাগ পঞ্চমী শুরু হচ্ছে ২৭ শে জুলাই মঙ্গলবার রাত্রি ৪ টে ৩৪ মিনিট থেকে। আর ২৮ শে জুলাই বুধবার রাত্রি ৪ টে ৫২ মিনিট অবধি পঞ্চমী থাকছে।
নাগ পঞ্চমী পুজো কারা করে থাকেনঃ
- ১. যারা মনসা দেবীর ভক্ত তারা নাগ পঞ্চমীর দিন দেবী মনসার ও অষ্টনাগের পুজো করে থাকেন।
- ২. দেবীর কাছে কোন মনস্কামনা করে থাকলে তা পূর্ণ হওয়ার জন্য অনেক সময় মানুষ নাগ পঞ্চমী ব্রত করেন।
- ৩. অনেকের কুষ্টিতে কালসর্প দোষ থাকে, এই দোষ কাটানোর জন্য অনেকেই এই নাগপঞ্চমীর পুজো করে থাকেন। কারণ বলা হয় যে নাগ পঞ্চমী ব্রত করলে কালসর্প দোষ কেটে যায়।
- ৪. স্বপ্নে সাপে কামড়ানো দেখে বা সর্পদংশন দেখে অনেকে নাগ পঞ্চমী করেন। কারণ বলা হয় এই ব্রত করলে সর্পদংশনের থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
- ৫. যাদের সর্প ভীতি আছে তারা এই ব্রত করেন।
- ৬. কারোর হয়তো মনস্কামনা পূরণের জন্য অনেক আগে দেবীর পুজো করার কথা ছিল কিন্তু মনের ভুলবশত তিনি ভুলে গিয়েছেন, তখন ক্ষমা প্রার্থনার জন্য অনেকেই নাগ পঞ্চমীর ব্রত করে থাকেন।
- ৭. দেবী মনসা ও নাগেদের বলা হয় পরম বৈষ্ণব। অনেক তাই পরম বৈষ্ণবী ঞ্জানে ভক্তিযুক্ত মনে দেবীর পুজো করে থাকেন ও দেবীর কাছে বিষ্ণুভক্তি চেয়ে নেন।
নাগ পঞ্চমীর সূচনা কীভাবে হয়ঃ
পুরাণে এই নাগ পঞ্চমী পর্ব শুরু হওয়া প্রসঙ্গে দুটি কাহিনীর প্রচলন আছে-একটি পরীক্ষিত পুত্র জন্মেঞ্জয়ের প্রসঙ্গ, অপরটি শ্রীকৃষ্ণের প্রসঙ্গ।
কথিত আছে যে অর্জুনের পৌত্র জন্মেঞ্জয় তার পিতার সর্পদংশনে মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একটি যঞ্জের আয়োজন করেছিলেন সেই যঞ্জের লক্ষ্যই ছিল নাগ বংশকে একেবারে ধ্বংস করা। মন্ত্র বলে এবং সেই যজ্ঞের ফলে যজ্ঞের অগ্নিতে এক এক করে নাগেরা এসে পরছিলেন ও প্রাণ হারাচ্ছিলেন।
এদেরকে রক্ষা করবার জন্যই তখন দেবী মনসা ও জরৎকারু মুনির পুত্র আস্তিক মুনি উপস্থিত হন এবং তিনি নিজের বুদ্ধি ও যুক্তি দ্বারা জন্মেঞ্জয়কে এই নাগ বংশধ্বংসকারী যজ্ঞ করার হাত থেকে আটকান। যেদিন এই যঞ্জ থেমেছিল সেই দিনটি ছিল শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথি। আস্তিক মুনির সেই যঞ্জে পৌঁছনোর ফলে তক্ষক নাগ ও নাগ বংশ বেঁচে যায়। তাই সেই সময় থেকেই নাগ পঞ্চমীর পর্ব শুরু হয়েছিল।
অনেকে আবার বলেন কালীয় নাগকে পরাজিত করে শ্রীকৃষ্ণ যেদিন বিজয়ী হন সেই দিনটি ছিল শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথি এবং সেই থেকেই নাগ পঞ্চমী পালিত হয়।
নাগ পঞ্চমী কীভাবে পালন করা উচিতঃ
নাগ পঞ্চমীর দিন নাগ দেবতার মূর্তির সামনে দুধ, চন্দন, হলুদ ও সিঁদুর রাখা হয়। এরপর নাগ দেবতার মূর্তির সামনে কর্পূরের প্রদীপ জ্বালানো হয়। এরপর নাগেদের আরতী করা হয় ও আরতী শেষে নাগ পঞ্চমীর ব্রতকথা (কদ্রু বিনতার কাহিনী, জন্মেঞ্জয়ের সর্পযঞ্জের আখ্যান) পাঠ করা হয়।
নাগ পঞ্চমীর ব্রতকথাঃ
গরুর পুরাণ মতে ব্রহ্মপুত্র মহামুনি কাশ্যপের তৃতীয় স্ত্রী কদ্রুই হলেন নাগ বংশের জননী। অন্যদিকে কাশ্যপের অপর স্ত্রী বিনতার পুত্র গরুড়। বিনতার প্রতি কদ্রু সবসময় বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ছিলেন, যার ফলে তিনি বিনতাকে কষ্ট দিতেন।
ছোটবেলা থেকেই মায়ের এই কষ্ট দেখে দেখে গরুড় প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি সর্পদের ধ্বংস করবেন কিন্তু পরবর্তীকালে এই প্রতিজ্ঞার থেকে তিনি বিরত হলেও সর্পদের সাথে তার শত্রুতা থেকেই যায় তবে এই পুণ্যজন্মের কারণে এবং দেবাদিদেব মহাদেব ও ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত হওয়ার কারণে নাগেরা চিরপূজিত হয়ে থাকেন। (মহাভারতের জন্মেঞ্জয়ের সর্পযঞ্জের কাহিনীটি পূর্বেই বলেছি)
নাগ পঞ্চমী ব্রত পালনের ফলঃ
নাগপঞ্চমী ব্রত নিষ্ঠাভরে পালন করলে নাগলোক ও পাতাললোকের সর্প কুল মর্তের মানুষকে আশীর্বাদ করেন আর এই আশীর্বাদের ফলে মর্তের মানুষের জীবনে অভাব-অনটনে ঘুছে গিয়ে সুখ ও সমৃদ্ধি আসে।
এছাড়া বলা হয় নাগপঞ্চমী করলে দেবাদিদেব মহাদেব এবং ভগবান বিষ্ণু সেই ব্যক্তির প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হন। নাগপঞ্চমী যে ব্যক্তি করে তার সর্পদংশন হতে আর কোন ভয় থাকেনা। দেবী মনসার কৃপায় তার সংসারেও সুখ শান্তি বিরাজ করে।
নাগ পঞ্চমীর দিন কী কী করবেনঃ
- ১. নাগপঞ্চমী দিন নাগের পুজো করুন। এইদিন সর্পকে ফুল ফল ও দুধ অর্পন করুন। এরফলে দেবী আপনার উপর প্রসন্ন হবেন।
- ২. নাগ পঞ্চমীর দিন আপনি শিবলিঙ্গের অভিষেক করাতে পারেন জল বা দুধ দিয়ে, এরফলে আপনি মহাদেবের আশীর্বাদ লাভ করবেন।
- ৩. নাগ পঞ্চমীর পুজো করার কালে মনে কোন খুঁতখুঁতানি আনবেন না, ভক্তিযুক্ত মনে সরল চিত্তে পুজো করুন।
- ৪. মন্দিরে খোদাই-করা সাপের প্রতিমাকে দুধ অর্পণ করুন।
- ৫. এই দিন মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করুন। এতে অষ্টনাগ, দেবী মনসা ও দেবাদিদেব মহাদেব সন্তুষ্ট হবেন।
- ৬. দেবী মনসাকে পরম বৈষ্ণবী বলা হয়, তাই এই দিন সর্ব মনস্কামনা পূর্তির জন্য দেবী প্রণাম করার আগে ও পরে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন।
নাগ পঞ্চমীর দিন ভুলেও এই কাজ গুলি করবেন নাঃ
- ১. এইদিন লোহার তৈরি পাত্রে রান্না করবেন না।
- ২. নাগ পঞ্চমী দিন সূঁচ বা অন্য কোন তীক্ষ্ণ বস্তু ব্যবহার না করাই উচিত।
- ৪. নাগ পঞ্চমী দিন সাত্ত্বিক ভোজন করুন এই দিন আমিষ খাবার খাবেন না।
- ৫. এদিন ভূগর্ভস্থ জীবিত কোন প্রাণী দের আঘাত করা উচিত নয় এবং কোন কারণে জমিতে লাঙ্গল করা বা খনন করা উচিত নয়।
- ৫. এদিন ভূগর্ভস্থ জীবিত কোন প্রাণী দের আঘাত করা উচিত নয় এবং কোন কারণে জমিতে লাঙ্গল করা বা খনন করা উচিত নয়।
- ৬. এইদিন গাছপালা কাটবেন না।
- ৭. এই দিন কোন সাপকে প্রাণে মারবেন না। যদি আপনি হঠাৎ দেখেন যে, সাপ আপনার ঘরে ঢুকে গিয়েছে তাহলে তাকে লোকজন ডেকে বাড়ির বাইরে বের করার ব্যবস্থা করুন অথবা দূরে কোনো বন জঙ্গলে (যেখানে মানুষের যাতায়াত কম) ছুঁড়ে ফেলে দিন। কিন্তু ভুলেও নাগ পঞ্চমীর দিন কোন সাপকে প্রাণে মারতে যাবেন না। মারলে তার ফল ভয়ানক হয়।
- ৮. এইদিন দাঁড়ি কামাবেন না।
মন্তব্য করুন