কেমন হয় যদি বাংলাদেশের খাবার চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায়? বাংলাদেশের প্রতিটা ঘরে যা রান্না হয় তা যদি বিদেশি মানুষকে খুশি করে তাহলে এর চাইতে বড় আনন্দ আর হয় না। ঠিক এই কাজটাকেই সম্ভব করে দেখিয়েছেন মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ১৩ তম আসরের প্রতিযোগী কিশোয়ার চৌধুরী।
মাছে-ভাতে বাঙালির রসনায় মাছ ছাড়াও থাকে হরেক রকমের ভর্তা আর ভাজি। স্বাদের দিক থেকে এই সাধারণ খাবারগুলো ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ, থাই, কন্টিনেন্টাল খাবারের চাইতে কোন অংশে কম নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এই মুখরোচক বৈচিত্র্যময় খাবারগুলোর কোন প্রচারই নেই। আমরা বিদেশি খাবারগুলো সানন্দে খাই, কিন্তু দেশি খাবার সেভাবে গ্রহণ করতে পারি না বা চাই না। আমাদের আগের প্রজন্ম অনেক সময় আর যত্ন নিয়ে রেঁধে খাওয়াতেন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম তো ভুলতেই বসেছে এসব খাবারের নাম, অনেকে তো নামই শোনেনি এসবের।
তবে বাংলাদেশী খাবারকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করার এক মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন কিশোয়ার চৌধুরী৷ একেকটি বাংলাদেশী পদ রেঁধে খাওয়াচ্ছেন বিচারকদের আর তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আজকের আর্টিকেলে থাকছে তার মাস্টারশেফ যাত্রার গল্প।
কিশোয়ার চৌধুরীর পরিচয়
কিশোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তার বাবার নাম কামরুল হাসান চৌধুরী ও মায়ের নাম লায়লা চৌধুরী। এই দম্পতি অস্ট্রেলিয়ায় সমাজসেবার জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রাপ্ত। জন্ম থেকেই কিশোয়ার বাবা-মায়ের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন।
৩৮ বছর বয়সী কিশোয়ার পড়াশুনা করেছেন মেলবোর্নের মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাণিজ্যে স্নাতক সম্পন্ন করে পেশাজীবন শুরু করেছেন বিজনেস ডেভেলপার হিসেবে। বর্তমানে তিনি দুই সন্তানের জননী। মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ১৩তম আসরে সেরা ২৪ এ জায়গা করার মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু৷ তুমুল প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে বর্তমানে সেরা ৪ এ উঠে এসেছেন।
মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী খাবার
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটোরিতে চলছে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ১৩ তম আসর। এই আসরে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী বিচারকদের মন জয় করেছেন বিভিন্ন বাংলাদেশী খাবার রান্না করে। বিচারকরা তার রান্নার ভূয়সী প্রশংসা তো করছেনই, অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় দর্শকরাও কিশোয়ারের রান্না দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন।
সম্পূর্ণ গড়পড়তা বাংলাদেশী খাবারকে তিনি তুলে ধরেছেন মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার মত বিরাট বড় একটি প্লাটফর্মে। কেন বাংলাদেশী খাবারকেই বেছে নিলেন – এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান একটু ভিন্ন গল্প। তিনি মূলত অনুপ্রেরণা পান ফো লিং ইয়োকে দেখে। ফো লিং ইয়ো মালয়েশিয়ান বংশোদ্ভূত একজন অস্ট্রেলিয়ান পাচক, যিনি এই প্রতিযোগীতার ১২ তম আসরের প্রতিযোগী ছিলেন। ফো লিং ইয়ো যদি মালয়েশিয়ান খাবার এখানে রান্না করে দেখাতে পারেন, তাহলে তিনিও বাংলাদেশী খাবারই রান্না করবেন।
কিশোয়ারের বাবা-মা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করলেও মনেপ্রাণে বাংলাদেশের টান ভুলতে পারেননি কখনোই। তাদের হাত ধরে কিশোয়ারের রান্নায় হাতেখড়ি। আগে তিনি তার সন্তান ও পরিবারের লোকজনদের বাংলাদেশী খাবার রান্না করে খাওয়াতেন। কিন্তু এবার তিনি তার রান্নার হাতের জাদু দিয়ে সদর্পে এগিয়ে যাচ্ছেন মাস্টারশেফ প্রতিযোগীতায়।
তিনি মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী এবং সুস্বাদু বাংলাদেশী খাবারের বৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ব অবগত নয়। সারাবিশ্বে বাংলাদেশী খাবারকে তুলে ধরতেই তার এই প্রয়াস। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশী খাবারকে অস্ট্রেলিয়ার খাবারের মানচিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা করে দেয়ার ইচ্ছাও আছে তার। তার আরেকটি ইচ্ছা হচ্ছে রান্নার উপরে একটি বই লেখার।
কি কি পদ রেঁধেছেন কিশোয়ার?
আমাদের বাংলাদেশের যা নিয়মিত এবং স্বাভাবিক খাবার, সেগুলোই তিনি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন প্রতিযোগীতার মঞ্চে। খিচুড়ি, শিম ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, মাছের ঝোল, ঘিয়ে ভাজা পরোটা, খাসির ঝোল, বেগুন ভর্তা, মাছ ও কাঁচা আমের টক, মাছ ভাজা, মাংসের কালাভুনা ইত্যাদি ছিল তার রান্নার তালিকায়।
খাসির ঝোল রান্না করাটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। ১৪ রকমের মাংস থেকে যেকোন একটি নিয়ে রান্না শেষ করতে হবে ৭৫ মিনিটের মধ্যে। কিশোয়ার বেছে নেন খাসির মাংস, তার নিজস্ব পদ্ধতিতে রান্না শেষ করেন মাত্র ৩৫ মিনিটে। মাংসের সাথে করেন ঘিয়ে ভাজা পরোটা।
কিশোয়ার কিন্তু ভীষণ রকমের ফুচকাপ্রেমী। সময় পেলেই তিনি বেরিয়ে পড়েন ফুচকা খেতে, বা বাড়িতে নিজেই তৈরি করেন। ফুচকা এবং সমুচার মত মুখরোচক সুস্বাদু খাবারকেও তিনি মাস্টারশেফের মঞ্চে নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত ফুচকা ও সমুচার রেসিপির চাইতে তার রেসিপি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
দুটো রেসিপিই তিনি তৈরি করেছেন পুরোপুরি আলু দিয়ে। সমুচার র্যাপটি তৈরি করার জন্য প্রথমে আলু সিদ্ধ করে সেটাকে জাপানিদের মত পাতলা শিটের মত করে কেটে শুকিয়েছেন। আর ফুচকার খোলসটাও ময়দা বা সুজির পরিবর্তে বানিয়েছেন আলু দিয়ে। অর্ধেক সিদ্ধ করা আলুকে স্কুপ করে পরে সেটাকে ডিপ ফ্রাই করে নিয়েছেন। সমুচা আর ফুচকায় স্টাফিং হিসেবে দিয়েছেন মশলাদার আলু আর ডাবলি।
দুটো জিনিসই পরিবেশন করেছেন টক-ঝাল তেঁতুলের সস দিয়ে। এমনকি ফুচকার টপিংটাও ছিল আলুর তৈরি। আলু ছোট ছোট কুচি করে সেটাকে ডিপ ফ্রাই করে কুড়মুড়ে বানান। বাংলাদেশে কুড়মুড়ে সাধারণত তৈরি হয় সেমাই ভাজা দিয়ে৷
বাড়ামুন্ডি মাছ দিয়ে তৈরি করে দেখিয়েছেন সুস্বাদু মাছের ঝোল, যা দেখে বিচারকদেরও জিভে জল এসে গেছে। আলু, বেগুন, ঝিঙে, কাঁচা কলা, আর কালিজিরা দিয়ে রান্না করা মাছের ঝোল খেয়ে বিচারকরা একেবারে লা-জওয়াব৷
বাংলাদেশের মানুষের কাছে খিচুড়ি অন্যতম একটা জনপ্রিয় খাবার। মন আর আবহাওয়া দুটোই ভাল থাকলে খিচুড়ি একেবারে জমিয়ে দেয় পরিবেশ৷ সেই জমজমাট খিচুড়ির সাথে বেগুন ভর্তা আর মাছ ভাজা প্ল্যাটার পরিবেশন করেছেন বিচারকের সামনে। এই খিচুড়ি-বেগুন-মাছের মজাদার কম্বিনেশন দিয়েও কুড়িয়েছেন বিচারকদের সীমাহীন প্রশংসা।
পরিশেষে
দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ কিশোয়ার-ভক্ত হয়ে উঠেছেন ইতোমধ্যেই। অসাধারণ রান্নার মাধ্যমে এতটা পথ পাড়ি দেয়া মোটেও সহজ কাজ ছিল না। সামান্য একটু ভুলের জন্য পুরোপুরি বাদ পড়ে যাবার আশঙ্কা তো ছিলই, সেই সাথে নিজের স্বপ্ন অধরা থেকে যেত।
শীর্ষ ২৪ এর বাছাই পর্বে আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলা নিজের স্বপ্নের কথা হৃদয় ছুঁয়েছিল বিচারক মেলিসা লিয়ংয়েরও। বই লেখা ছাড়াও কিশোয়ার চৌধুরীর আরেকটা লক্ষ্য আছে। তিনি চান বাংলাদেশী খাবার সম্পর্কে যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারে ও মনে রাখতে পারে। বাংলাদেশী খাবারের এই স্বকীয়তা ধরে রাখার জন্য তার এই চেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়।
মন্তব্য করুন