সেই কবে অপুর সাথে বাঙালির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তারপর তার সাথে বাঙালির শেষ দেখা ১৯৫৯ সালে ‘অপুর সংসারে’। সেখানে স্ত্রী অপর্ণার মৃত্যুর পর ছেলেকে কাঁধে চড়িয়ে বেড়িয়ে পরে অপু অজানার সন্ধানে। তারপর আর তার ফেরা হয়নি বাঙালির জীবনে।
কিন্তু সেই অপু যদি আবারও ফিরে আসে তাহলে কেমন হবে? হ্যাঁ এটাই হতে চলেছে। অপু ফিরছে দীর্ঘ ৬০ বছর পর তার ছোট্ট ছেলে কাজলের সাথে, পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রের হাত ধরে। ডিজিটাল যুগে রঙবেরঙের চাকচিক্যে নয় সাদাকালো ফ্রেমে। ফিরছে অপু, ফিরছে অপর্ণা সাথে তাদের ছোট্ট ছেলে কাজল। আবার রানুদি, লীলাও। ছবির নাম ‘অভিযাত্রিক’।
অপুর বাকি থাকা অধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’ উপনাসের ৬০ শতাংশ নিয়ে তৈরি হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় ও শেষ ছবি। কিন্তু তার পরের অংশটি, মানে অপুর ছেলে কাজলের জার্নি সেটা ভাবাত পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রকে। ‘অপুর সংসার’এ অপু কাজলকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিল অজানার সন্ধানে। কিন্তু তারপর কি হয়েছিল? সেই জার্নি তো বাকি থেকে গেছে। এই থেকেই এই ছবির ভাবনা পরিচালকের।
সত্যজিৎ রায় যেখানে তাঁর অপু ট্রিলজি শেষ করেছিলেন, অর্থাৎ ১৯৫৯ ‘অপুর সংসার’এ। ঠিক সেখান থেকেই শুরু হবে ‘অভিযাত্রিক’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘অপরাজিত’র শেষ ৪০ ভাগ নিয়ে তৈরি হয়েছে এই ছবি।
কে কোন ভূমিকায়
অপু বলতেই মনে ভেসে ওঠে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবি। এবং অপর্ণার চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর। তাদের সেই অনস্ক্রীন কেমিস্ট্রি আজও গেঁথে রয়েছে বাঙালির মনে। এবার অপুর চরিত্রে দেখা যাবে অর্জুন চক্রবর্তীকে। অপুর স্ত্রী কাজলের ভূমিকায় দেখা যাবে টেলি দুনিয়ার জনপ্রিয় মুখ দিতিপ্রিয়া রায়কে। এখানেও ফুটে উঠবে অপু অপর্ণার কেমিস্ট্রি। সে চলে গেলেও অপুর মনে সে সবসময় থাকে।
তাদের ছেলে কাজলের ভূমিকায় শিশুশিল্পী আয়ুষ্মান। এছাড়াও রানু দির চরিত্রে রয়েছেন শ্রীলেখা মিত্র। অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় রয়েছেন লীলার চরিত্রে। সব্যসাচী চক্রবর্তীকে দেখা যাবে শঙ্করের চরিত্রে। প্রসঙ্গত এই প্রথম অনস্ক্রীন দেখা যাবে বাবা ছেলেকে একসাথে। এছাড়াও রয়েছে টলিউডের আরও অনেক জনপ্রিয় মুখ।
নজর কেড়েছে ট্রেলার
“রেলগাড়ি দেখতে যাবি দিদি”… সেই চেনা সংলাপেই ট্রেলারে ফিরেছে অপু। সম্প্রতি গেল সত্যজিৎ রায়ের ১০০তম জন্মবার্ষিকী। সেইদিনই পরিচালক সামনে আনেন ট্রেলার এবং মুক্তি পাওয়া মাত্রই বাঙালি আবেগে ভেসে, ওঠে সাড়া ফেলে দেয় ট্রেলারটি। হবে নাই বা কেন কতবছর পর অপু ফিরছে বলে কথা, স্পেশাল তো হবেই।
সাদা কালো ফ্রেমেই গোটা ট্রেলার নজর কেড়েছে সকলের। ট্রেলারে দেখা যাচ্ছে অপু ফিরছে তার ছোট্ট ছেলে কাজলের হাত ধরে। দেখা যাচ্ছে তার স্ত্রী অপর্ণাকেও। অপর্ণার সাথে তার কেমিস্ট্রি। সাথে রানুদি, লীলা, শঙ্কর সবাইকে।
মুক্তির আগেই একের পর এক সাফল্য
মুক্তির আগেই ‘২৬তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসব’এ প্রশংসা তো পেয়েছেই, আবার গোয়ায় ‘৫১তম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া’তেও প্রশংসা পেয়েছে এই ছবি। পাশাপাশি মিলছে একের পর এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সম্প্রতি ২৪তম সাংঘাই চলচিত্র উৎসবেও মনোনীত হয়েছে এই ছবি। পাশাপাশি ৩৮তম মিয়ামি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও মনোনীত হয়েছে। এইভাবেই ইতিমধ্যেই প্রায় ১৮টি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে জেয়গা করে নিয়েছে ‘অভিযাত্রিক’।
এই ছবির অন্যতম আকর্ষণ
বাঙালির চিরকালীন আবেগে মিশে রয়েছে অপু। অপু দুর্গাকে নিয়ে হাজার হাজার বাঙালির একটা আলাদাই ইমশন সাথে সত্যজিৎ রায়কে নিয়েও। তাই এই ছবি নিয়ে অত্যন্ত সিরিয়াস ছিলেন পরিচালক। তাই এই ডিজিটাল যুগেও কোনোরকম চাকচিক্যে নয় গোটা ছবি চলবে সাদা কালো ফ্রেমে। ছবিতে ফুটে উঠেছে ৪০এর দশকের প্রেক্ষাপট। ৬০ বছর পর অপুকে দেখবে বাঙালি তাই সেই আগের ফিলটা তুলে ধরতে এবং যেহেতু এটা একটা পিরিওডিক্যাল ফিল্ম, ‘অপুর সংসার’ এর শেষ হওয়া অংশের পরই শুরু হবে এই ছবি তাই এই পরিকল্পনা।
ছবি শুট হয়েছে বিভিন্ন জেয়গাতে। বারানসি, টাকি, ডুয়ার্স, বোলপুরের বিভিন্ন জেয়গা সহ আরও অনেক জেয়গায়। মিউজিকের দায়িত্বে ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক বিক্রম ঘোষ। সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্ব সামলেছেন সুপ্রতিম ভোল। এরআগে ‘পথের পাঁচালী’র থিম তৈরি করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এবার তাঁরই কন্যা অনুষ্কা শঙ্কর সেই বিখ্যাত থিমের রিক্রিয়েট করেছেন এই ছবিতে। এছাড়াও পোশাকের দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত ফ্যাশান ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল।
ছবির মুক্তি কবে?
করোনা পরিস্থিতিতে কবে মুক্তি পাবে এই ছবি তা নিয়ে সংশয়ে সকলে। পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক না হলে, এতো বড় মাপের ছবির মুক্তি সম্ভব নয়। এইরকম আন্তর্জাতিক মানের ছবি মুক্তি নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে রাজি নন পরিচালক থেকে টিম কেউই। এখন ছবি মুক্তির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা বলছেন সকলেই। তাই মানুষ আবার আগেরমত সিনেমাহলে যখন আসতে পারবে তখনই ছবি মুক্তির কথা ভাবা হবে।
একইমত অপু ওরফে অর্জুন চক্রবর্তীরও। তার মতে মানুষের সুস্থ হওয়া আগে জরুরী। ‘অভিযাত্রিক’ অপেক্ষা করবে। একই বক্তব্য সব্যসাচী চক্রবর্তীরও এতো বড় আন্তর্জাতিক মানের ছবি তাড়াহুড়ো করে মুক্তি অপ্রয়োজনীয়। এটা একদম অন্য ধরণের একটা কাজ।
বড় পর্দায় অপুকে আবার একবার ফিরে পেতে অধীর অপেক্ষায় আপামর বাঙালি। তবে অপু রূপে অর্জুন চক্রবর্তীকে কবে দেখতে পাবেন দর্শক তা এখন অজানা সকলেরই। আপাতত সময়ের অপেক্ষা।
মন্তব্য করুন