গরমকালে ত্বকের নানারকম সমস্যার মত চুলেরও নানান রকম সমস্যা দেখা যায়।গরমকালে আমাদের চুল প্রচন্ড পরিমাণে তৈলাক্ত হয়ে ওঠে আবার কখনো দেখা যায় চুল প্রচন্ড পরিমানে রুক্ষ কর্কশ হয়ে উঠেছে। স্ক্যাল্প তৈলাক্ত হয়ে উঠুক অথবা রুক্ষ দুটি ক্ষেত্রেই মাথার ত্বকে চুলকানি অর্থাৎ ইচিং জাতীয় সমস্যা হয়।
স্ক্যাল্পে হওয়া এই ইচিং অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে গেলে মানুষ ডাক্তারের পরামর্শ নেন তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ঘরোয়া কতগুলি উপায়ের সাহায্যেও স্ক্যাল্পের এই চুলকানির থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চলুন জেনে নিই গরমকালে স্ক্যাল্পের চুলকানির থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘরোয়া কতকগুলি উপায়।
স্ক্যাল্পে হওয়া চুলকানি বা ইচিং কিন্তু উকুন জাতীয় সমস্যার কারণে হয় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় তৈলাক্ত স্ক্যাল্পের ফলেই ইচিং হয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় শুষ্ক স্ক্যাল্পের কারণেও ইচিং হয়। তাই তৈলাক্ত স্ক্যাল্পের চুলকানি ও শুষ্ক স্ক্যাল্পের চুলকানি দূর করতে গেলে স্ক্যাল্পে হওয়া অতিরিক্ত পরিমাণে এই তৈলাক্ততা ও শুষ্কতা দূর করতে হবে।আর এর জন্য সবার আগে জানতে হবে তৈলাক্ত স্ক্যাল্পে ইচিং ও শুষ্ক স্ক্যাল্পে ইচিং কী কী কারনে হয়?
তৈলাক্ত স্ক্যাল্পে ইচিং কী কী কারনে হয়?
১. মানসিক দুশ্চিন্তা
মানুষের মানসিক অবস্থাও ত্বক ও শরীরের ওপর নানা রকমের প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত পরিমাণে দুশ্চিন্তা হতাশা বোধ এর থেকেও মাথার ত্বকের মধ্যে তৈলাক্ত ও ইচিং জাতীয় সমস্যা হয়।
২. পুষ্টিকর খাবারের ঘাটতি
ক্যালসিয়াম ও প্রোটিন জাতীয় পুষ্টিকর খাবারের অভাবের জন্য চুলের স্ক্যাল্প তৈলাক্ত হয়ে যায় ও মাথার তালু চুলকাতে থাকে।
৩. অন্যান্য কারণ
হরমোনের সমস্যা,চুলের টেক্সচার ও অ্যান্ডরোজেনিক হরমোন জনিত ঔষধ সেবন করার ফলে মাথার স্ক্যাল্প তৈলাক্ত হয়ে যায়।]
শুষ্ক স্ক্যাল্পে ইচিং জাতীয় সমস্যা কী কী কারণে হয়?
১.আবহাওয়া
উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়ার কারণে চুল অতিরিক্ত পরিমাণে শুষ্ক হয়ে পড়ে আর চুল কর্কশ হওয়ার ফলেই ইচিং হয়।
২. পার্লার ট্রিটমেন্ট
বিভিন্ন ধরনের পার্লারের ট্রিটমেন্ট যেমন হিট করা, স্ট্রেট করা এছাড়া নিত্যনতুন হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহারের ফলেও চুল শুষ্ক হয়ে যায় ও মাথার ত্বকে চুলকানির সৃষ্টি হয়।
৩. এলার্জি
মাথার ত্বকের কোন ফাংগাল ইনফেকশন জনিত কারণে ও স্ক্যাল্প শুষ্ক হয়ে যায় ও ইচিং এর মত সমস্যাগুলির সৃষ্টি হয়।
ইচিং এর ফলে কী কী সমস্যা হয়?
স্ক্যাল্পে ইচিং এর ফলে মাথার ত্বকে খুব বেশি চুলকায় এরফলে অনেক সময়ই আমরা নখ দিয়ে স্ক্যাল্প চুলকাতে থাকি। যার ফলে চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে যায় এবং চুল প্রচুর পরিমাণে পড়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রে মাথার ত্বক পুরোপুরি ড্যামেজ হয়ে যায়। ইচিং এর প্রভাবে অতিরিক্ত পরিমাণে চুলকানোর ফলে অনেক সময় মাথার ত্বকে ঘা হয়ে যায়। অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও অতিরিক্ত শুষ্ক স্ক্যাল্পের এই সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারলেই মাথার ত্বকে চুলকানি বা ইচিং জাতীয় সমস্যার থেকে মুক্তি ঘটে।
তৈলাক্ত স্ক্যাল্পের চুলকানির থেকে মুক্তির উপায়-
১. অ্যাপেল সিডার ভিনেগার
ড্রপারে করে সরাসরি স্ক্যাল্পে ব্যবহার করুন অ্যাপেল সিডার ভিনেগার। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন ব্যাবহার করলে উপকার পাবেন। এক্ষেত্রে মাথায় রাখবেন স্ক্যাল্প যদি খুব বেশি তৈলাক্ত হয়,তাহলে জল না মিশিয়ে সরাসরি অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করুন। আর যদি স্ক্যাল্প মোটামুটি তৈলাক্ত হয় তাহলে ১:১ অনুপাতে জল আর অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করুন। এরফলে চুলের ত্বকের তৈলাক্ততা কমে আসবে আর ইচিং ও হবে না।
২. লেবুর রস
অত্যন্ত তৈলাক্ত স্ক্যাল্প হলে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন স্ক্যালে লেবুর রস ব্যবহার করুন। স্ক্যাল্প মোটামুটি তৈলাক্ত হলে সপ্তাহে একদিন উপকার করলেই ফল পাবেন। লেবুর রস স্ক্যাল্পে ব্যবহারের ফলে তৈলাক্ত স্ক্যাল্প ও ইচিং এর হাত থেকে মুক্তি পাবেন। অ্যাপেল সিডার ভিনেগারের মত এক্ষেত্রেও খুব বেশি তৈলাক্ত স্ক্যাল্প হলে সরাসরি লেবুর রস
ব্যবহার করবেন আর মোটামুটি তৈলাক্ত হলে ১:১ অনুপাতে জলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করবেন।
৩. টি ট্রি ওয়েল
এটিও খুব ভালো অ্যান্টি ইচিং হিসেবে কাজ করে সাথে সাথে খুব ভালো অ্যান্টিসেপটিক হওয়ার কারণে যেকোনো ফাঙ্গাল ইনফেকশনকেও দূর করে। সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন চুলের গোড়ায় তুলার সাহায্যে টি ট্রি অয়েল লাগিয়ে দিন। এক্ষেত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে লাগালে বেশি ভালো ফল পাবেন আর পরদিন সকালে শ্যাম্পু করে নিন।
৪. চুল নিয়মিত পরিষ্কার
চুলা অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন থাকলে তেল চিটচিটে ভাব আসে আর ইচিং হয়। তাই চুল নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।চুলে প্রতিদিন চিরুনি বা হেয়ার ব্রাশ ব্যবহার করুন, যাতে চুলে কোনো জট বা অপরিচ্ছন্নতা না থাকে।
৫. তৈলাক্ত খাবার বর্জন
তৈলাক্ত খাবারের ফলে তৈলাক্ত স্ক্যাল্প হয় তাই তৈলাক্ত স্ক্যাল্পের থেকে মুক্তি পেতে গেলে তৈলাক্ত খাবার খাওয়া কমিয়ে দিন।
৬. কেমিক্যালের ব্যবহার কমান
কেমিক্যাল জাতীয় জিনিসের ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন কারণ কেমিক্যালের ব্যবহার ফলে চুলের ত্বকের নানান ধরনের ক্ষতি হয়।
৭. জল পান
ত্বকের তৈলাক্ততা হোক অথবা চুলের সবক্ষেত্রেই প্রচুর পরিমাণে জল পান করা উচিত। কেউ যদি দিনে অন্তত তিন লিটার করে জল পান করেন তাহলে স্ক্যাল্প তৈলাক্ত হয় না।
৮. তেলের ব্যবহার
স্ক্যাল্প যাদের অত্যন্ত পরিমাণে তৈলাক্ত তাদের চুলের গোড়ায় তেল না দিয়ে চুলের আগায় তেল লাগানো উচিত। এক্ষেত্রে তৈলাক্ত স্ক্যাল্পের থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৯. শ্যাম্পু
চুলের তৈলাক্ততা থেকে মুক্তি পেতে চুলে অবশ্যই শ্যাম্পু করতে হবে এক্ষেত্রে সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন শ্যাম্পু করা প্রয়োজন।
১০. ডায়েট
অনেক সময় ডায়েট করতে করতে আমরা খাদ্য তালিকা থেকে পুষ্টিকর উপাদান গুলি বাদ দিয়ে ফেলি যার প্রভাব সরাসরি আমাদের চুলের ওপর পড়ে। তাই খাদ্য তালিকায় প্রোটিন আর ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবারের যেন ঘাটতি না হয় তা অবশ্যই নজর রাখবেন।
১১. চিরুনি থেকে চুল বাঁধার ফিতে বা রুমাল পরিস্কার
ইচিং জাতীয় সমস্যাকে দূর করতে চাইলে মাথার ত্বককে সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে, তাই চুলে ব্যবহার করার চিরুনি থেকে শুরু করে রাতে চুলে যে রুমাল বা ফিতে বাঁধেন সেগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করুন। এছাড়া বালিশের তোয়ালে ও ওয়াড় নিয়মিত কাচুন। এর ফলে ইচিং এর সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
চুলের রুক্ষতার কারণে ইচিং হয় সেক্ষেত্রে কী করণীয়?
শুষ্ক ত্বকে ইচিং হলে-
১. অয়েল ম্যাসেজ
মাথার ত্বকে নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল দিয়ে ম্যাসাজ করুন। তারপর ঘণ্টাখানেক রেখে দিয়ে কেমিক্যালমুক্ত বা ভেষজ উপাদান দিয়ে তৈরি কোনো শ্যাম্পু দিয়ে মাথা পরিষ্কার করে নিন। তেল চুলে দেওয়ার আগে উষ্ণ গরম করে নিলে আরো ভালো ফল পাবেন। সপ্তাহে দুদিন এরকম অয়েল ম্যাসেজ করুন।
২. অ্যালোভেরা জেল
সপ্তাহে দুদিন অ্যালোভেরা জেল দিয়ে পনেরো-কুড়ি মিনিট করে মাথায় ম্যাসাজ করার পর ঠান্ডা জল দিয়ে মাথা ধুয়ে নিন।
৩. অ্যাপেল সিডার ভিনেগার
শুষ্কতার কারণে যদি মাথা চুলকায় তাহলে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে জলের সাথে প্রতিদিন অ্যাপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে মাথা ধুয়ে নিলেই উপকার পাবেন।
৪. পার্লার ট্রিটমেন্ট কমান
অনেক সময় দেখা যায় যে হিট স্টাইলিং বা হেয়ার স্ট্রেটনিং করার ফলে বা কোন নতুন হেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করার ফলে চুল অত্যন্ত পরিমাণে ড্রাই হয়ে যায় আর শুষ্ক চুলে ইচিং এর সৃষ্টি হয়। শুষ্কতার কারণে যদি ইচিং হয় এক্ষেত্রে অবশ্যই কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট থেকে বিরত হতে হবে।
৫. চুলে সঠিক কন্ডিশনারের ব্যবহার
চুলে মশ্চারাইজার কমে গেলে অনেক সময় চুল শুষ্ক হয়ে যায় ও ইচিং জাতীয় সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই শ্যাম্পুর পর ভেষজ অথবা প্রাকৃতিক উপাদানে প্রস্তুত কন্ডিশনার ব্যবহার করুন।
৬. সানবার্ন এড়িয়ে চলুন
সূর্যের প্রখর রশ্মির কারণেও চুল কর্কশ ও শুষ্ক হয়ে ওঠে তাই এইসব ক্ষেত্রে বাইরে বেরোলে চুল কোন স্কার্ফের সাহায্যে ঢোকে নিন, আর বাইরে বেরোনোর আগে ভেজা চুল অবশ্যই শুকিয়ে নিয়ে তারপর বেরোবেন।
৭. বেকিং পাউডার
১ চামচ বেকিং পাউডার ও ২ টেবিল চামচ জল মিশিয়ে সপ্তাহের একদিন স্ক্যাল্পে দিন। এর ফলে চুলকানি ভাব বন্ধ হবে।
৮. সঠিক শ্যাম্পু বেছে নিন
চুল ধোওয়ার জন্য কেমিক্যাল মুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। এক্ষেত্রে ভেষজ শ্যাম্পু বা বেবি শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন।
৯. ঠান্ডা জল
স্নান করার সময় কখনই চুলে গরম জল দেবেন না, এমনকি শীতকালেও না। সবসময় সাধারণ জল ব্যবহার করুন চুল ধোওয়ার জন্য।
মন্তব্য করুন