ফ্যাশন আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আজকের দিনে যা ট্রেন্ডি, আগামীকালই কিন্তু তা হয়ে যেতে পারে ওল্ড ফ্যাশন বা সেকেলে। আর এটাই কিন্তু ফ্যাশনের সবচেয়ে মজার বিষয়, যে ফ্যাশন হল নিত্য পরিবর্তনশীল।
বছরের পর বছর প্রতিনিয়তই পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই- নিত্যনতুন এবং মজাদার (ফাঙ্কি) সমস্ত ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে চলেছেন। কারণ, নিত্যনতুন উপায় সাজগোজ করতে কে না ভালবাসে বলুন তো? আর বাঙালির মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত স্টাইল সেন্স রয়েছে।
বাঙালিদের সনাতনি শাড়ি পরার ধরনে বিশেষ একটা মাত্রা থাকে, যা দেখলে কার্যত মাথা ঘুরে যাবে আপনাদের। কিন্তু বাঙালি ফ্যাশনে আজকের দিনে যা যা সংযোজিত হয়েছে, তা কিন্তু একদিনের বিবর্তনের ফল নয়। বাঙালির বহুদিনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের ফ্যাশন ট্রেন্ড এসেছে। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক, গত ১০০ বছরে বাঙালি ফ্যাশনের প্রবর্তনের ধারা।
১) প্রাক ঔপনিবেশিক যুগ (১৮৫০-এর আগে)
ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মহিলারা সেই সময় কিন্তু ব্লাউজ বা কোনও অন্তর্বাস পরিধান করতেন না। একটি মাত্র কাপড় গায়ে পেঁচিয়েই লজ্জা নিবারণ করতেন। আর বাঙালি পুরুষরা সাধারণত, ধুতি বা লুঙ্গি পরতেন। আপার বডি গারমেন্টস হিসাবে কিছু ব্যবহার করতেন না।
২) ব্রিটিশ রাজ (১৮৫০-এর দশক থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত)
ব্রিটিশদের শাসনকালে মহিলাদের শাড়ি পরার ধরনে একটা বিশেষ পরিবর্তন এসেছিল। পাশাপাশি প্রাচীনকালে যে ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরার প্রবণতা ছিল, সেই অভ্যেসটাকে নীচু চোখে দেখা হত, আর সেই কারণেই মহিলারা সেই সময় থেকেই ব্লাউজ বা জামা (আন্ডারশার্ট) এবং পেটিকোট পরা শুরু করলেন। আর এইভাবে শাড়ি পরার পদ্ধতিটি সেই সময় ‘ব্রাহ্মিকা শাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল, যা মূলত ব্রাহ্মণ বাড়ির মহিলারাই পরতেন।
ব্রাহ্মিকা শাড়ি মূলত রবীন্দ্রনাথল ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুরই জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। আর এই ব্রাহ্মিকা শাড়ি মূলত গুজরাতি এবং পার্সি মহিলাদের শাড়ি পরার দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল।
অন্যদিকে ব্রিটিশ রাজে গ্রাম বাংলায় সনাতনি ধুতিই পরতেন ছেলেরা।
৩) ১৯৫০ থেকে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত
এই সময়টা ফ্যাশন দুনিয়ার একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ এসময়ে শাড়ি পরার ক্ষেত্রে একটা নতুন ধারা চলে এসেছিল। পাশাপাশি শাড়ির সঙ্গে স্টকিংস বা বডিকার সঙ্গে শর্টস স্কার্ট যা অনেকটা পেটিকোটের মতো। সঙ্গে গায়ের ওপর একটা শাল বা চাদর জড়িয়ে নেওয়ার চলও ছিল।
এই সময় বাঙালি মহিলারা শাড়ির আঁচল পিন আপ করা শুরু করলেন এতে করে শাড়ির আঁচল সরে যেত না এবং আঁচলকে বিভিন্ন ধরনের ব্রোচ দিয়ে আটকে নিতেন। সত্যি বলতে আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সেই ব্রোচ পরার কালচারটা ফিরে আসছে, যা মাঝখানে একটু সেকেলে হয়ে গিয়েছিল। আজকাল ক্লে বা ফেব্রিকের ওপর তৈরি করা ব্রোচের চাহিদা কিন্তু যথেষ্ঠ। হ্যান্ডলুম শাড়ির সঙ্গে এই ধরনের মানানসই ব্রোচ পরার ট্রেন্ড ফের ফিরে আসছে।
৪) উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরুর দিক
এই সময়টা বাঙালি মহিলাদের মধ্যে শাড়ি পরার একটা অন্য়রকমের প্রবণতা বিরাটভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেই সময়ে অধিকাংশ বাঙালি মহিলাই মান্টিলা (mantilla) পরতে শুরু করলেন। আর এটি হল মূলত শাড়ির সঙ্গে আলাদা লেস বসিয়ে পরা। এই স্টাইলটি মূলত উচ্চ শ্রেণীর ব্রিটিশ মহিলাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
যদিও বাঙালি মহিলাদের শাড়ির আসল ড্রেপিং স্টাইলটি বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তিত হয়নি তবে ব্লাউজগুলির স্টাইলে সূক্ষ্ম পরিবর্তন দেখা যায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে।
সেইসময়ে উচ্চশ্রেণীর ধনি মহিলারা ব্য়য়বহুল জামদানি এবং বেনারসি শাড়ি পরতে, যা ‘পরিণীতা’ ছবিতে বিদ্যা বালান পরতেন। ব্লাউজে পাফ স্লিভ খুবই প্রচলিত ছিল। সত্যি বলতে সেইসব ট্র্যাডিশন যেন পুনরায় ফিরে ফিরে আসছে।
১৯৮০-এর ইনফরমেশন অ্যান্ড ভিসুয়াল কমিউনিকেশন মিডিয়া শাড়ির বুননের ধরণে একটা আকস্মিক পরিবর্তন এনেছিল। টাই এবং ডাই শাড়ি এবং হ্যান্ড ব্লক প্রিন্ট করা শাড়ি ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠে। অদ্ভূতভাবে ব্লক প্রিন্ট ইন্ডিগো শাড়ি ২০২০-তে এসেও সমানভাবে জনপ্রিয়। পাশাপাশি এই সময়ের মতো আজকের দিনেও মহিলারা রিচ এবং ভাইব্রেন্ট রঙের শাড়ি পরতে দেখা যায়।
এই সময় থেকে মহিলারা যেহেতু বাইরে যেতে এবং বাইরে গিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন, তাই সেই সময়ে বাঙালি মহিলাদের স্বচ্ছন্দ্য এবং উপযুক্ত যে অন্য ধরণের পোশাকটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তা হল সালোয়ার কামিজ। মূলত মোগল এবং পাঠানদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল এই সালওয়ার কামিজ।
৫) বিশ শতকের শেষ থেকে আজ পর্যন্ত- এই সময় পশ্চিমি ভাবধারার জোয়ার আসতে শুরু করল। এই সময় থেকে পুরুষ এবং নারী নির্বিশেষে সকলে পশ্চিমি পোশাকগুলি পরতে শুরু করেন। তবে ফ্যাশনে যে জিনিসটা অপরিবর্তনীয় ছিল, তা হল বাঙালির সনাতনী পোশাক পরিচ্ছদ, অর্থাৎ পুরুষের ধুতি-পাঞ্জাবী বা কুর্তা এবং মহিলাদের ট্র্যাডিশনাল লাল পাড় সাদা শাড়ি। সঙ্গে মহিলারা সজ্জিত হতেন বাঙালির ট্রেডমার্ক শাঁখা-পলা এবং সোনার গয়নায়। সাজপোশাকে যতই বদল আসুক না কেন বাঙালির সনাতনী এই সাজ তাঁদের ভিড়ের মাঝে অনন্য করে তোলে।
এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক ২০২০-র ফ্যাশনে ট্রেন্ডিং কী কী
- পাফ স্লিভ- এর আগেই বলেছি সময় হয়তো অনেকটাই পেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু পাফ স্লিভ বা ঘটি-হাতা ব্লাউজের স্টাইল কিন্তু আজও সমানভাবে ট্রেন্ডিং। সেই ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকে পাফ স্লিভের প্রচলন শুরু হয়েছে। ব্লাউজ হোক কিংবা টপের হাতা যদি পাফড থাকে তাহলে তা দেখতে ভারি রোমান্টিক দেখায়।
- নিয়ন- নিয়ন এবং উজ্জ্বল ইলেকট্রিক রঙগুলি চলতি বছরে খুবই ট্রেন্ডিং। বাজারে নিয়ন রঙের অনেক পোশাকই উপলব্ধ। শাড়ি হোক বা ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ঝকঝকে সবুজ, লেমন ইওলো, ইলেকট্রিক ব্লু-এর মতো রঙগুলি ট্রাই করতে পারেন। আর সাজটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এইসব রঙের পোশারকের সঙ্গে মানানসই বেল্ট, ব্যাগ, হেয়ার অ্যাকসেসরিজ আদর্শ। এছাড়াও পোশাকে কোনও কনট্রাস্ট নিয়ন রঙের পাইপিংও লাগাতে পারেন।
- পোলকা ডটস- পোলকা ডট শুনলেই যদি আপনার ঋষি কাপুর অভিনীত ‘ববি’ ছবির ববি প্রিন্টের কথা মনে পড়ে, তাহলে আপনাদের বলে রাখি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কিন্তু ববি প্রিন্টের সংজ্ঞা একেবারেই বদলে গিয়েছে। বোল্ড গ্রাফিক পোলকা ডটস আজকের দিনে যথেষ্ট ট্রেন্ডিং। পাশাপাশি এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য আপনার কাছে অসংখ্য ফেব্রিকের অপশন রয়েছে। শুধু তাই নয়, শাড়ি কিংবা ফর্ম্যাল ওয়্যারেরও পোলকা ডট প্রিন্ট খুব ভাল যায়। ক্রিস্প শার্ট বা প্লিট করা স্কার্টে পোলকা ডট খুবই আকর্ষণীয় দেখায়।
- বাহারি হলুদ- ২০২০ সালে কিন্তু প্যাস্টেল হলুদের বিভিন্ন শেড যথেষ্ট ট্রেন্ডিং। এটি বাটারকাপ ইওলো বলেও পরিচিত। বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাকে এই বিশেষ শেডটি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষত মহিলাদের মধ্যে এর চাহিদাও বেশি।
- ট্যাডিশনাল ভার্সেস মর্ডান শাড়ি- চলতি বছর ডিজে বাদশা-র ব়্যাপের সঙ্গে চিরাচরিত বাংলার লোকগান ‘বড় লোকের বিটি লো’-তে খোদ জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজকে সনাতনি লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে নাচ করতে দেখা গিয়েছে, যা সারা দেশবাসীর মনে বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে আলোড়ন তৈরি করেছিল। তবে যে যা-ই বলুন না লাল-পাড় সাদা শাড়ির কনসেপ্ট কিন্তু কখনওই ব্যাকডেটেড হয় না।
পাশাপাশি এই একই গানে জ্যাকলিনকে দেখা গিয়েছিল পার্পেল এবং অফ হোয়াইট ট্রানজিশান কালারের শিফন শাড়িতেও। সুতরাং বুঝতেই পারছেন বাঙালি স্টাইল করবে অথচ শাড়ি পরবে না এটা কিন্তু একেবারেই ভুল ধারনা, বরং শাড়ি পরার কনসেপ্ট আজ আর বাংলা বা বাঙালির মধ্যে আবদ্ধ নেই। সারা দেশের মানুষ মজেছেন শাড়িতে।
এছাড়াও বিভিন্ন অ্যাকসেসারিজের মধ্যে জাম্বো সাইজ সানগ্লাস বেশ ট্রেন্ডি। আর জানলে অবাক হবেন যে, এই কোভিড পরিস্থিতিতে মাস্কও কিন্তু এখন স্টাইল স্টেটমেন্ট। কীভাবে? বর্তমানে বিভিন্ন নামি-দামী ব্র্যান্ড তাদের পোশাকের সঙ্গে মানানসই মাস্কও বিক্রি করছেন। এতে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সহজ হচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে স্টাইলও করা যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালিদের কাছে ফ্যাশনের সংজ্ঞা হয়তো বদলে গিয়েছে, কিন্তু বাঙালির সাজপোশাকের চিরাচরিত ভাবধারা আজও বহমান।
মন্তব্য করুন