আমাদের বাঙালিদের জীবনে ভাত ছাড়া কিন্তু কোনও কথা নেই। তা যতই আমরা ডায়েট করি না কেন, মনটা কিন্তু ভাত ভাত করে ছুঁক ছুঁক করে। কিন্তু ভেতো বাঙালি হয়েও কি আমরা জানি কত রকমের চাল আছে আমাদের চারপাশে! বেশির ভাগ বাঙ্গালিই সেটা জানেন না। আসুন আজ আপনাদের নানা জাতের চালের জগতে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
আতপ আর সিদ্ধ চাল:
নাম শুনে থাকলেও আমরা অনেকেই এদের পার্থক্য ভালো বুঝি না। আসলে যে কোনও ধান থেকেই এই দুই ধরণের চাল তৈরি করা যায়। মূলত ধান থেকে চাল বের করার পদ্ধতির উপর এই নাম নির্ভর করে। ধান ঝেড়ে রোদে শুকিয়ে ধানকলে যখন ধান তৈরি হয় সেটা হয় আতপ চাল। আর অন্যদিকে ধান যখন গরম জলের ভাপে ৫ থেকে ১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে তারপর শুকিয়ে ধানকলে ঝেড়ে চাল বের করা হয় সেটা হয় সিদ্ধ চাল। আমরা সাধারণত এই সিদ্ধ চাল খাই রোজ। শীতকালে চালের গুঁড়ো যে ব্যবহার করি পিঠে তৈরি করার জন্য, সেই চাল হয় মূলত আতপ চাল।
আয়তন অনুযায়ী চাল:
আয়তন দেখে আমরা মূলত চালকে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি, লম্বা দানার, মাঝারি দানার আর ছোট দানার।
লম্বা দানার চালঃ
এই চাল সাধারণ চালের থেকে তিন-চার গুণ বড় হয়। এগুলির স্টার্চ উপাদানের জন্য এগুলি খুবই হাল্কা, ঝরঝরে হয় আর রান্না করলে ভাল ফুলে যায়। তাই আকারে আরও বড় হয়ে যায়। আমরা বিরিয়ানি করতে কিন্তু এই চাল ব্যবহার করি। দেরাদুন চাল কিন্তু এই লম্বা দানার চাল। আমাদের বাংলার নিজস্ব দুটি চাল, কনকচূড় আর তুলাইপাঞ্জি এই গোত্রের। মূলত উত্তরবঙ্গের জেলায় এই চালের চাষ হয়।
মাঝারি দানার চালঃ
লম্বা দানার চালের তুলনায় এই চাল বেশ খাটো আয়তনে। এই চাল খানিক বাঁকাও হয়। তবে এই চালের সমস্যা হল রান্না করার পর এই চাল লম্বা চালের মতো তেমন ঝরঝরে থাকে না। খানিক গায়ে গায়ে লেগে যায়।
ছোট দানার চালঃ
এই চাল লম্বা তো হয়ই না, বরং বেশ চ্যাপ্টা ধরণের হয়। আর এই চাল খুবই চটচটে হয়। জাপানী এক ধরণের খাবার আছে- সুসি। সেই সুসি কিন্তু এই ধরণের চালের ভাত দিয়ে খাওয়া হয়। আমরা হোটেলে গিয়ে অনেক সময়ে জ্যাসমিন রাইস চাই, মূলত এশিয়ান খাবারের সঙ্গে। ওই জ্যাসমিন চালও এই ধরণের। এই চাল হয়ও মূলত দক্ষিণ-পূর্ব আর পূর্ব ভারতে। এই চালই বিশেষ করে চালের গুঁড়ো করার ক্ষেত্রে লাগে। আমরা সাধারণ রোজকার দিনে এই ছোট চাল খেয়ে থাকি।
রঙ অনুযায়ী চাল:
ধান মূলত হাল্কা বাদামী বা ব্রাউন হয়। কিন্তু ঝাড়াই বাছাই করার পর যখন চালের বাইরের খোসা চলে যায় তখন চাল সাদা হয়। কিন্তু কিছু কিছু চাল বাদামী, লাল, কালো হয়। এগুলি আর কিছুই না, মূলত চালের খোসার রঙের নানা মাত্রা। অনেক সময়ে চালের গুণগত মান বাড়ানোর জন্য বা দেখতে ভালো লাগার জন্য এই খোসা রেখে দেওয়া হয়।
সাদা চালঃ
এই চাল আমরা সাধারণত খাই। একে পলিশড চালও বলা হয় কারণ এই চালের থেকে সমস্ত খোসা বের করে নেওয়া হয়।
ব্রাউন রাইসঃ
এই চালের রঙ হাল্কা বাদামী। বাদামী রঙ কারণ বাইরের খোসা সবটা ঝেড়ে ফেলে দেওয়া হয় না। তাই এই চালের পুষ্টিগুণ অন্য চালের থেকে বেশি। ডায়েট করলে এই চাল খেতে বলা হয়। এই চাল রান্না হতে একটু সময় লাগে।
কালো চালঃ
এই চালের পুষ্টিগুণ অন্য সব চালের থেকে অনেক বেশি। এই চালের মধ্যে হাল্কা একটা বাদামের গন্ধ থাকে, যেটা আসলে খোসার গন্ধ। এই চাল রান্না করলে বেশ চটচটে হয়ে যায়। মূলত চাইনিজ বা থাই রান্নায় এই চাল বেশি ব্যবহার করা হয়। একটু দাম দিয়ে কিনতে পারলে আপনিও কিন্তু এই চাল খেতে পারেন।
গন্ধ অনুযায়ী চাল:
দুপুরে পাঁঠার মাংসের সঙ্গে গরম ভাতের গন্ধের মিশেল আমাদের পাগল করে দেয়। তাই ভাল গন্ধ আছে কোন কোন চালের তা দেখা প্রয়োজন।
বাসমতি চালঃ
এটি লম্বা দানার চাল আর বেশ ভাল গন্ধও। এই চাল দেখতে সাদা হয় আর একটু দামী। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে এই চালের উৎপাদন আর ব্যবহার বেশি। বিরিয়ানি করতে বা মুঘলাই কোনও পদের সঙ্গে এই চাল বেশ ভালো যায়।
গোবিন্দভোগ চালঃ
শোনা যায় গোবিন্দ মানের কৃষ্ণের ভোগে এই চাল দেওয়া হত বলে নাম গোবিন্দভোগ চাল। গন্ধে এই চাল অসাধারণ। সাধারণ পোলাও হোক কি বাসন্তী পোলাও, এই চাল ছাড়া ভাবাই যায় না। পায়েস বানাতেও এই চাল আর পুজোয় নৈবেদ্য দিতেও এই চাল। গোবিন্দভোগ চাল আর মাছের মাথা দিয়েই কিন্তু মুড়িঘণ্ট করা হয়। তাই আমাদের বাঙালি জীবনে এই চালের গুরুত্ব একটু বেশিই।
জ্যাসমিন রাইসঃ
আগেই এই চাল নিয়ে বলেছি। ছোট আকারের এই চালের গন্ধ অনেকটা জুঁই ফুলের মতো, আর তেমনই ছোট। তাই এই রকমের নাম। খানিক স্টিকি হয় বলে চাইনিজ, থাই, এশিয়ান রান্নায় বেশি ব্যবহার করা হয়। এর চাষও বেশি হয় থাইল্যান্ডে।
তাহলে এতো রকমের চাল দেখে নিশ্চয়ই আপনার খেতে ইচ্ছে করছে। সব চাল আপনার কাছের বাজারে না পেলেও মলে বা অনলাইনে পেয়ে যাবেন। এখন ভালো খাওয়া আপনার হাতের মুঠোয়।
মন্তব্য করুন