যতই মেয়েরা জিন্স পরুক আর পালাজো পরুক, শাড়ির প্রতি টানটা কিন্তু একদমই কমে না। কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতে যেতে হলে বা কোনও পার্টিতে, মনটা আগেই শাড়ি শাড়ি করে, তাই না! আসলে রোজ জিন্স, কুর্তি, টি-শার্ট পরে পরে আমাদের নিজেদের অন্য লুকে দেখার জন্য শাড়ির উপরেই নির্ভর করতে হয়। আর শাড়ি তো মেয়েদের কাছে শুধু একটা কাপড় নয়, শাড়ি মানে প্রথম শাড়ি পরা, মায়ের শাড়ি পরা, সরস্বতী পুজোয় শাড়ি পরা, এমন অনেক স্মৃতি।
আর শাড়ি মানেই আমাদের দরকার ভালো কালেকশন। তার জন্য আবার চিন্তা কীসের! এটা ভারত, যেখানে এতো বৈচিত্র্য, আর সেই বৈচিত্র্য ধরা আছে শাড়িতেও। প্রতি রাজ্যেই আছে তাদের নিজস্ব ঘরানায় তৈরি শাড়ি। আজ আপনাদের সেরকমই ১৮টি শাড়ির কথা বলব যা আপনাদের কালেকশনে রাখতেই হবে।
১. বাংলার তাঁত শাড়ি
যতই বলি না কেন তাঁত মানেই ট্র্যাডিশনাল, আজকাল কিন্তু তাঁতের শাড়িতেও যথেষ্ট ইউনিক লুক আসে। চওড়া পাড়, ভরাট জমি, এই তো হল তাঁতের বিশেষত্ব। ধনেখালি, শান্তিপুরের তাঁত কিন্তু এখনও বিখ্যাত। সবচেয়ে বড় কথা, এই তাঁতেই আপনি পাবেন আনকোরা হাতের ছোঁয়া। নতুন যারা পরেন তাদের জন্য এই শাড়ি ম্যানেজ করা একটু কঠিন হয়, কিন্তু আদতে এই শাড়ি গরমে পরার জন্য বেশ ভালো।
২. কেরলের কাসাভু শাড়ি
এটি কেরলের ট্র্যাডিশনাল শাড়ি, যাকে সেত্তু শাড়িও বলা হয়। একটি ধুতির মতো করে পরা শাড়ি, যার পোশাকি নাম মুন্ডু, সঙ্গে ব্লাউজ আর একটি স্টোল, যা ব্লাউজের উপর দিয়ে নিতে হয়, এই তিনটি উপাদান মিলে এই শাড়ি। কেরলের বৃদ্ধা মহিলারা আজও এই শাড়ি পরেন। তবে আজকের মডার্ন দিনে এটির মধ্যে সোনালী পাড় বসিয়ে নতুন লুক আনা হয়েছে, যে সোনালী পাড় আসল সোনার সুতো দিয়ে করা হয়। আজকের দিনের সঙ্গে মিল রেখে একে নানা রকম রঙের মধ্যে আনা হয়েছে।
৩. তামিলনাডুর কাঞ্জিভরম শাড়ি
কাঞ্জিভরমকে কাপড়ের রানি বলা হয়। তামিলনাডুর কাঞ্জিভরম অঞ্চলে এই সনাতন শাড়ি বোনা হয়। এটির বিশেষত্বই হল এর রঙ আর কাজের বাহার। এটি কিন্তু যে কোনও মেয়েকে অনন্য করে তুলতে পারে। তাই এটি একটি থাকা চাই।
৪. ওডিশার বোমকাই শাড়ি
একে সোনপুরি সিল্কও বলা হয়। এই শাড়ি ইক্কত, এমব্রয়েডারি আর সুতোর কাজের এক অনবদ্য মেলবন্ধন। সিল্ক আর কটন, দু ক্ষেত্রেই আপনি এই শাড়ি পেয়ে যাবেন। আপনার যে কোনও উৎসবের দিনকে এই শাড়ি অন্য ধরণের করে তুলবে।
৫. ওডিশার সম্বলপুরি শাড়ি
সম্বলপুরে এই সনাতন শাড়ি তৈরি করা হয়। এটি পুরোটাই হাতে বোনা শাড়ি। এটি নানা রকম পদ্ধতিতে বোনা হয়। বোনার আগে সুতো ডাই করা হয় যাতে শাড়ির রঙ অনেক দিন পর্যন্ত অটুট থাকে। আপনার নিশ্চয়ই এই শাড়ি একটা আছে? না থাকলে এক্ষুণি আনান।
৬. মহারাষ্ট্রের পেথনি শাড়ি
এই শাড়ি মূলত ঔরঙ্গাবাদের। এর বিশেষতে হল ভরাট কাজ। পুরো শাড়িই হাতে বোনা হয়। এর জড়ির কাজ, নানা রকম মোটিফ এর মধ্যে আলাদা লুক আনে। আর এতে থাকে ময়ূরের ডিজাইন, যা একে অন্য এক মাত্রা দেয়। বিয়েবাড়িতে এটি পরলে সবাই আপনাকে দেখবেই।
৭. গুজরাটের বন্ধনী শাড়ি
শুনেই বুঝতে পারছে, এই শাড়ির নাম এসেছে বন্ধন শব্দটি থেকে। যেভাবে শাড়িটা বেঁধে বেঁধে আর ডাই করে তৈরি করা হয় তার থেকেই এই নাম এসেছে। গুজরাট আর রাজস্থান, এই দুই জায়গাই এই শাড়ির জন্য বিখ্যাত। গুজরাটের ক্ষেত্রী সম্প্রদায়ের মানুষ এই শাড়ি অনেক দিন ধরে তৈরি করে আসছে। এখনও এই শাড়ি তৈরি করার জন্য তাঁদের কদর রয়েছে।
৮. অসমের মুগা শাড়ি
এটি অসমের একটি বিখ্যাত শাড়ি। একটি অনন্য পদ্ধতিতে এই শাড়ি তৈরি করা হয়। এই শাড়ি তৈরির জন্য যে সুতো লাগে তা একটি বিশেষ লার্ভা থেকে তৈরি করা হয়, যে লার্ভা দুটি বিশেষ পাতা খেয়ে বড় হয়। তার থেকেই এই বেস্ট সিল্ক পাওয়া যায়। এই শাড়ি খুব সুন্দর হয়, আর খুব টেকসই হয়। আর অসমে যে মুগা তৈরি হয় তার বিশেষত্ব হল এতে সোনালী পাড় থাকে।
৯. উত্তরপ্রদেশ বেনারসী শাড়ি
বেনারসী নিয়ে আর নতুন করে বলার কিছু নেই। এর বিশেষত্বই হল সোনালী আর রুপোলী জড়ির কাজ সারা শাড়ি জুড়ে। সত্যিকারের সোনার আর রুপোর সুতো দিয়ে এটি বোনা হয়। আগেকার দিনে এই শাড়ি এমন নিখুঁত করে তৈরি করা হত যে এক বছর ধরে সময় লাগত। কিন্তু এখনও এই শাড়ির যথেষ্ট কদর রয়েছে, মূলত বিয়েবাড়িতে আর অনুষ্ঠান বাড়িতে।
১০. তেলেঙ্গানার পচামপল্লি শাড়ি
অন্ধ্র প্রদেশের বোধান অঞ্চলে এই বিশেষ শাড়ি তৈরি করা হয়। এই শাড়ির বিশেষত্ব হল জ্যামিতিক আকারের ইক্কতের কাজ আর নানা রকম মোটিফ। এটি সিল্ক আর কটনের মিশ্রণে বানানো হয়। এর মধ্যে একটা রাজকীয় ছোঁয়া আছে যার জন্য আপনাকে এটি কিনতেই হবে।
১১. মধ্য প্রদেশের চান্দেরী শাড়ি
পালকের থেকেও নরম হয় এই শাড়ি। সল্ক, জড়ি আর কটনের মিশ্রণে হাতে বুনে এই শাড়ি তৈরি হয়। রাজকীয় এই শাড়ি দেখতে কিন্তু সত্যিই বেশ অনবদ্য। এটি পরা আর ক্যারি করা খুবই সহজ। আপনি যদি খুবই ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু শাড়ি পড়তে চান, তাহলে আপনার জন্য এটি বেস্ট।
১২. তামিলনাডুর কনরাড শাড়ি
একে মন্দিরের শাড়িও বলা হয়। আসলে প্রাচীন কালে এই শাড়ি মন্দিরের বিগ্রহকে পরানোর জন্যই মূলত তৈরি হত। একটি চওড়া পাড় থাকে এই শাড়ির আর সঙ্গে থাকে স্ট্রাইপ ও চেকের ডিজাইন। চওড়া পাড়েও থাকে কোনও পশু, পাখি বা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের কাজ। এটিই এই শাড়িকে আরও অনন্য করে তোলে।
১৩. রাজস্থানের লেহেরিয়া শাড়ি
আগেই বন্ধনী শাড়ি নিয়ে আলোচনা করেছি। লেহেরিয়া বন্ধনী শাড়িরই আলাদা ডিজাইন। মূলত অন্য ভাবে বেঁধে আর ডাই করে এই লেহেরি বানানো হয়। এটিই এই লেহেরিকে আলাদা করেছে বন্ধনী থেকে। লেহেরি রাজস্থানের একদম নিজস্ব আর সনাতন শাড়ি।
১৪. পাঞ্জাবের ফুলকারি শাড়ি
নামেই বুঝতে পারছেন, এই শাড়ির বিশেষত্ব এর ফুলের নকশা করা কাজে। সুতো দিয়ে নানা রকমের ফুলের ডিজাইন করা হয়। বিখ্যাত হীর- রাঞ্ঝার গল্পে প্রথম এই শাড়ির নাম পাওয়া যায়। কটনের উপর বা খাদির উপর এই ফুলকারি কাজ করা হয়। অনেক সময়ে দোপাট্টার মধ্যেও এই ফুলকারি কাজ করা হয়।
১৫. লখনউ চিকনকারি শাড়ি
লখনউ এর বিশেষত্বই হল চিকনকারি শাড়ি। সনাতন ভাবে মসলিনের উপর এই কাজ করা হত। তবে বর্তমানে অন্য অনেক উপাদানের জমির উপরেই এই কাজ করা হয়। এটি আপনাকে কিন্তু একটি কালেকশনে রাখতেই হবে।
১৬. গুজরাটের পাটোলা শাড়ি
সিল্কের তৈরি ডবল ওভেন ইক্কতের শাড়ি হল এই পাটোলা শাড়ি। গুজরাটের পাটান এলাকা এই শাড়ির আঁতুড়ঘর। খুবই দামী হয়ে থাকে এই শাড়ি কেনার জন্য। কিন্তু একটি পাটোলা শাড়ি আপনার শাড়ির কালেকশান সম্পূর্ণ করে তুলতে পারে। ভেলভেট পাটোলা শাড়ি বেশি বিক্রি হয়, সুরাটে বানানো হয় এই শাড়ি।
১৭. বাংলার জামদানী শাড়ি
বাংলার শাড়ির ইতিহাসে অন্যতম নাম জামদানী শাড়ি। রয়াল শাড়ির ঘরানায় জামদানী শাড়ি জায়গা করে নিয়েছে বহু বছর আগেই। বাঙালী মেয়েদের পছন্দের এই শাড়ি। সুতোর কাজ করা মসলিন কাপড়ের উপর আলাদা লুক এনে দেয়।
১৮. মধ্যপ্রদেশের মাহেশ্বরী শাড়ি
কটন ও পিওর সিল্কের উপর ওভেন ওয়ার্ক করা শাড়ি। এই শাড়ি মধ্যপ্রদেশের ট্রাডিশানাল শাড়ি। অসাধারন সুন্দর ও ক্লাসি দেখতে। এই শাড়িতে মাহেশ্বরী ফেব্রিক ওয়ার্ক করা থাকে। অকেসানে পরার জন্য একেবারে পারফেক্ট।
ভারতবর্ষ অনেক বড় দেশ। আমাদের পক্ষে প্রতিটি রাজ্যের শাড়ি সম্পর্কে জানা খুবই দুষ্কর। তাও এই ১৮টি শাড়ি এত জনপ্রিয় যে শাড়ি প্রেমীদের জানা আবশ্যিক। লেখা পড়ে একবার আলমারি খুলে দেখে নিন কোন কোন শাড়ি আমাদের এই লিস্টের আপনার কালেকশানে নেই। আর তারপর আপনার কাজ হল এর মধ্যে কোনটা কোনটা আপনার নেই তার লিস্ট তৈরি করা আর কর্তাকে মানিয়ে সেগুলো কিনে ফেলা। শাড়ির শখ যদি থাকে তাহলে এই ১৮টি শাড়ি আলমারিতে থাকা মাস্ট। আমি একটা একটা করে কিন্তু জমাতে শুরু করে দিয়েছি এবার আপনাদের পালা।
মন্তব্য করুন