আমরা জানি যে দেবী পার্বতী পিতা দক্ষের গৃহে অনুষ্ঠিত যজ্ঞে বিনা নিমন্ত্রণে গিয়ে ও সেখানে স্বামী মহাদেব শিবের অপমান সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন। সেই দেহ নিয়ে যখন শিব তান্ডব করতে করতে এগিয়ে যান, তখন তাকে থামানোর জন্য বিষ্ণুদেব সুদর্শন চক্র দিয়ে পার্বতীর দেহ খন্ড খন্ড করতে থাকেন ও যেখানে যেখানে সেই দেহখন্ড পতিত হয় সেখানেই স্থাপিত হয় সতীপীঠ। মহাদেব নিজে সেখানে ভৈরব রূপে অবস্থান করেন। আগের পর্বে আমরা সাতটা সতীপীঠ সম্বন্ধে জেনেছিলাম। এই পর্বে বাকি পীঠ সম্বন্ধে জেনে নেব।
৮ অমরনাথ
শিবক্ষেত্র অমরনাথ শক্তিপীঠ রূপেও প্রসিদ্ধ। ভারতের ভূস্বর্গ কাশ্মীরের অমরনাথে দেবীর কন্ঠ পতিত হয়। এখানে দেবীর নাম মহামায়া। মহাদেব এখানে ত্রিসন্ধ্যেশ্বর রূপে বিরাজ করছেন। শ্রীনগর থেকে পেহেলগাও হয়ে বাসে ৯৪ কিমি পথ।
৯ অট্টহাস
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পীঠ। এখানে দেবীর ওষ্ঠ পতিত হয়। দেবীর নাম ফুল্লরা। মহাদেব এখানে বিশ্বেশ নামে পরিচিত। বীরভূমের লাভপুর গ্রাম থেকে ২ কিমি পূর্বে এই সতীপীঠ অবস্থিত। আরও স্পষ্টভাবে বললে কাটোয়া সাবডিভিশনের নিরোল গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই শক্তিপীঠ। ঈশাণী নদীর তীরে অবস্থিত ও নিরোল বাস স্ট্যান্ড থেকে ৫ কিমি দূরে।
১০ বহুলা
অজয় নদীর তীরে কেতুগ্রামের কাছে বহুলা গ্রামে দেবীর বাম হাত পতিত হয়। দেবী এখানে বহুলা নামেই পরিচিত। ভৈরবের নাম ভীরুক। বর্ধমানের কাটোয়া থেকে ৮ কিমি দূরত্বে। শিবরাত্রি ও নবরাত্রি উপলক্ষ্যে মেলা হয়।
১১ বক্রেশ্বর
বীরভূমের সিউড়ি টাউন থেকে ২৪ কিমি দূরে এই সতীপীঠ অবস্থিত। দেবীর নাম মহিষমর্দিনী। ভৈরব হলেন বক্রনাথ। দেবীর ভ্রুযুগলের মাঝের অংশ পতিত হয় এখানে। দুবরাজপু্র রেল স্টেশন থেকে ৭ কিমি দূরত্বে। এই অঞ্চলের মাহাত্ম্য নিয়ে এমন কথিত আছে যে সত্যযুগে লক্ষী ও নারায়ণের বিবাহকালে ইন্দ্রের দ্বারা অষ্টাবক্র মুণি অভিশাপ পেয়ে এই স্থানে শিবের তপস্যা করেন ও সুস্থ হন। তাই শিবতীর্থ রূপেও এটি জনপ্রিয়। অগ্নি কুণ্ড, দুগ্ধ কুণ্ড, শ্বেত গঙ্গা ইত্যাদি অনেক দর্শনীয় স্থান আছে।
১২ ভবানীপুর
এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সতীপীঠ। বাংলাদেশের রাজশাহীর শেরপুরে দেবীর বাম পায়ের মল বা নূপুর পতিত হয়। দেবীর নাম অপর্ণা। মহাদেব এখানে ভীমসেন নামে পরিচিত। শেরপুর টাউন থেকে ২৮ কিমি দূরত্বে এই শক্তিপীঠ।
১৩ ছিন্নমস্তিকা শক্তিপীঠ
হিমাচলপ্রদেশের উর্ণা অঞ্চলের চিৎপূর্ণীতে দেবীর পায়ের পাতা পতিত হয়। দেবীর নাম এখানে ছিন্নমস্তিকা। ভৈরবের নাম রুদ্র মহাদেব।
১৪ গন্ধকী
এটি নেপালে অবস্থিত জাগ্রত পীঠস্থান। পোখারার গন্ধকী নদীর তীরে মুক্তিনাথ মন্দিরের কাছে এই মন্দির। এখানে দেবীর ললাট পতিত হয়। দেবীর নাম গন্ধকী চণ্ডী। ভৈরব চক্রপাণি রূপে বিরাজমান।
১৫ নাসিক
মহারাষ্ট্রের গোদাবরী নদীর তীরে নাসিকে দেবীর চিবুক পতিত হয়। দেবী এখানে ভ্রামরী নামে পরিচিত। ভৈরবের নাম বিক্রিতাক্ষ। পুরাণে পাই যে অরুণাসুর নামে এক অসুর কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার থেকে বর নেয় যে কোন দুই বা চার পায়ের কেউ তাকে মারতে পারবে না। সে তখন দেবলোক আক্রমণ করে। পরবর্তীকালে কৈলাসও আক্রমণ করে ও মহাদেব শিবও তাকে প্রতিরোধ করতে পারেননি। তখন পার্বতী বিশাল দেহ ধারণ করেন ও চারিদিকে মশা, মাকড়শা, মাছি ইত্যাদিতে ভরে যায়। এরাই দেবীর হয়ে যুদ্ধ করে ও শেষে অরুণাসুর পরাজিত হয়। দেবীর নাম হয় ভ্রামরী।
১৬ জয়ন্তী
মেঘালয়ের জয়ন্তী পাহাড়ে দেবীর বাম ঊরু পতিত হয়। দেবীর নাম জয়ন্তী। মহাদেব ক্রমদিশ্বর নামে পরিচিত।
১৭ যশোরেশ্বরী
এটি একটি প্রসিদ্ধ সতীপীঠ। বাংলাদেশের খুলনার ঈশ্বরীপুরে এই মন্দির অবস্থিত। এখানে দেবীর হাতের তালুদ্বয় ও দুই পদতল পতিত হয়। শোনা যায় যে রাজা প্রতাপাদিত্যের এক প্রধান কর্মচারী একদিন ঝোপের আড়াল থেকে আলোকছটা আসতে দেখেন ও সেখানে গিয়ে দেখেন এক প্রস্তর খন্ড যা অনেকটা হাতের তালুর মতো দেখতে। তখন রাজা প্রতাপাদিত্য এই মন্দির নির্মাণ করেন। দেবীর নাম এখানে যশোরেশ্বরী। ভৈরব এখানে চন্ড নামে পরিচিত। এই মন্দির রাজা লক্ষ্মণসেন দ্বারাও রক্ষিত হয়েছিল। তাই এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব কতটা তা আমরা বুঝতেই পারি। দেবী এখানে কালী রূপে পূজিতা। কালী পূজার সময়ে প্রতি বছর মেলা হয়।
এই হল কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ ও প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠ। আশা করি নতুন অনেক তথ্যই জানা গেল। পরবর্তী পর্বে আমরা আরও কয়েকটি সতীপীঠ নিয়ে আলোচনা করবো।
মন্তব্য করুন