ভাল গল্প বা উপন্যাস পড়লে অনেক সময়ে যেমন আমাদের মনে হয় যদি শেষ না হত তাহলে কতই ভাল হত! গল্পের শেষটা অনেক সময়ে আমাদের মনে থেকে যায়। আমরা একটা সম্ভাবনা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যাই গল্পের সঙ্গে। কিন্তু শেষে যদি আমরা সেরকম মিল না পেয়ে অন্য কিছু পাই তাহলে আমরা অবাক হয়ে যাই। বাংলা কিছু সিনেমাও এমন আছে যার শেষটা দেখলে তা আমাদের মনে থেকে যেতে পারে সারা জীবন।
১. মেঘে ঢাকা তারা

ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা, সুতরাং ভাল শুধু নয়, আমাদের কিছু ভাবতেও শেখাবে সেটাই কাঙ্ক্ষিত। এই সিনেমার সব চরিত্র, সব সুর, গান মিলে এমনিতেই একটা মন খারাপ করা আমেজ ধরে রাখে। কিন্তু শেষে সুপ্রিয়া দেবী অভিনীত চরিত্রটির কঠিন রোগের মধ্যে দাঁড়িয়েও বলা, “দাদা আমি বাঁচতে চাই” আমাদের চোখের পাতা ভিজিয়ে দেয় বৈকি আজও! পরিবারের জন্য জীবনের সব সুখ ত্যাগ করা মেয়েটির এই পরিণতি আজও আমরা মানতে পারি না।
২. গল্প হলেও সত্যি

রবি ঘোষের অনবদ্য অভিনয়, আপাত ভাবে হাসির সিনেমা। কিন্তু ধীরে ধীরে সিনেমার শেষে গিয়ে আমরা বুঝি সিনেমাটি কতটা গভীর। শেষ পর্যন্ত দূর দিগন্তরেখা ধরে রবি ঘোষের চরিত্রটির মিলিয়ে যাওয়া আর পিছনে রেখে যাওয়া একটি নিটোল, পরিপূর্ণ পরিবার। আজও আমাদের জন্য শিক্ষণীয় এই সিনেমা। সারাদিন ঝামেলা, অশান্তি করে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া একটি পরিবারকে কীভাবে এক করে ফেলল এক সাধারণ রাঁধুনে, একসঙ্গে থাকার মানে জানালো, তা আজকের নিউক্লিয়ার জীবনের মানুষদের শান্ত করবেই।
৩. উত্তর ফাল্গুনী

সুচিত্রা সেনের ডবল রোল। এক মেয়ের তার মায়ের জন্য লড়াইয়ের গল্প। এই ছবির শেষ দৃশ্য মনে আছে? কোর্ট রুমে মেয়ে তার মায়ের পরিচয়ের জন্য লড়ছে, আর মা জয়ের স্বাদ পাওয়ার আগেই মারা যাচ্ছেন। মা আর মেয়ে কোনও দিনই সুখে একসঙ্গে থাকা হল না। আর মেয়ে যখন জানল তার মা কে, সে তার মাকে হারাল। এই দৃশ্য আমাদের কিন্তু সব সময় মনে থেকে যাবে।
৪. দ্বীপ জ্বেলে যাই

সুচিত্রা সেনের যে কয়েকটি সিনেমা আমাদের সুচিত্রা সেনকে অভিনেতা হিসেবে চেনায়, এটি তাদের মধ্যে অন্যতম। সুচিত্রা সেনের চরিত্র অর্থাৎ রাধা, যে একজন মানসিক রোগীদের নার্স, শেষে নিজেই কীভাবে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন সেটাই দেখানো হয়েছে এই ছবিতে। তার জীবনের ব্যথা, বেদনা আর শেষের এই পরিণতি আজর সিনেমাটি দেখার সময়ে আমাদের কাঁদায়।
৫. আনন্দ আশ্রম

উত্তম কুমারের অন্যতম ভাল একটি কাজ। একজন ডাক্তার তার সব ছেড়ে এসে আছে সাধারণ মানুষদের মধ্যে। এই ছবির শেষের সিন মন ভিজিয়ে দেয় এখনও। বাচ্চা মেয়েটির ফুল নিয়ে এসে ডাক্তারকে দেওয়া, যখন ডাক্তার আর নেই এই পৃথিবীতে, আইকনিক হয়ে আছে। অন্যের জন্য বেঁচে জীবন যে সার্থক হয় সেই বোধ এই সিনেমা দিয়ে যায়।
৬. আলো

তরুণ মজুমদারের ছবি, অভিনয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, গানটা মন দিয়ে শুনলেই কেমন যেন করে ওঠে মনটা। আর ভেবে দেখুন শেষ দৃশ্য। রেকর্ডারে বাজছে এই গান, গ্রামের প্রিয় বৌ আর বেঁচে নেই। গ্রামের সকলকে বাঁচার মানে বুঝিয়েছিল যে, তার মেয়ে আজ তাঁদের কাছে। তাকে বড় করবে সকলে মিলে আর থেকে যাবে তাঁদের বৌএর প্রবহমানতা। অন্যতম ভাল সিনেমা আমাদের বাংলা ইন্ড্রাস্টির।
৭. বাইশে শ্রাবণ

থ্রিলার বলবেন কেউ, কেউ বলবেন ট্র্যাজেডি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল সাসপেন্স আর চিত্রনাট্য। কাহিনির শেষে এসে যখন দেখি, যিনি ইনভেস্টিগেট করছেন তিনি নিজেই একের পর এক খুন করেছেন, সামনে বসিয়ে গোটা ঘটনা বলছেন তখন কিন্তু আমাদের চমকে যেতে হয়। এই ধাক্কা, এই টুইস্টের জন্য কিন্তু দর্শক তৈরি থাকে না। আর দর্শক সব ভাবার আগেই ইন্সপেক্টরের নিজেকে গুলি করা, কাল্ট সিনেমা হয়ে থাকবে এই সিনটির জন্য বাইশে শ্রাবণ।
৮. ঘরে বাইরে আজ

অপর্ণা সেনের কাজ, তাই ভাল হবেই। কিন্তু এটি কেন আমরা মনে রাখব? মনে রাখব কারণ বৃন্দা এখানে সন্দীপকে শেষে গুলি করে মেরেছে। শঠতা, প্রতারণা এই সব বিমলা মেনে নিলেও আজকের বৃন্দা নেয় না। বিমলা তাই বিধবা হয়ে থাকে, বৃন্দা প্রতিশোধ নেয়। এখানেই সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার থেকে অপর্ণা সেনের সিনেমা আলাদা হয়ে যায়। শেষের এই পরিণতির জন্য আমরা তৈরি থাকি না।
৯. বিসর্জন

মনে রাখার মতো বাংলা সিনেমা বলব, আর জয়া আহসানের নাম আসবে না! আবীর আর জয়ার বিসর্জন সিনেমা, সঙ্গে কৌশিক গাঙ্গুলীর চিত্রনাট্য। আমাদের মন কি সত্যি নরম হয়ে আসে না যখন দেখি লক্ষ্মী তার মনের মানুষকে পার করে দিচ্ছে নৌকা! আর ফিরে আসছে বিধ্বস্ত হয়ে গরুর গাড়ি করে নতুন অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের দিকে, জলে ভাসানো প্রতিমার মতো!
১০. নগরকীর্তন

বহু আলোচিত, প্রশংসিত সিনেমা। সমলিঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে আমরা অনেক কথাই বলি, কিন্তু আসলে কতটা অত্যাচার সেই মানুষদের সহ্য করতে হয়, কতটা প্রতারির হতে হয় তাঁদের সেই নিয়ে এই গল্প। কিন্তু শেষে ঋদ্ধি সেনের চরিত্রের মৃত্যু, ঋত্বিকের শাড়ি পরে হিজড়েদের আখড়ায় আসা সভ্য মানুষদের গালে থাপ্পড় মেরে আমাদের অনেক ক্ষণ বসিয়ে রাখে হলের চেয়ারে।
এই সব সিনেমার মধ্যে কিছু যদি দেখা না হয় তাহলে অবশ্যই দেখে নিন। আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে।
মন্তব্য করুন