দুর্গাপুজো শেষ। টানা চার-পাঁচদিনের ঠাকুর দেখা, সাজগোজ আর জমিয়ে খাওয়া-দাওয়ার প্রবল ব্যস্ততার শেষে দশমী থেকেই মন খারাপ হতে শুরু করে বাঙালির। বিসর্জনের শেষে ফাঁকা প্যান্ডেল দেখে সেই মন খারাপ যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। কিন্তু বিজয়া দশমীর পাঁচ দিন পরেই আসে কোজাগরী পূর্ণিমা। ফলে অচিরেই বাড়িতে-বাড়িতে কিংবা প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে শুরু হয় মা লক্ষ্মীর আবির্ভাবের তোড়জোড়। পুজোর যোগাড়যন্ত্রের ব্যস্ততায় বাঙালির মন আবার খুশিতে ভরে ওঠে।
কেন ‘কোজাগরী’?
আপনারা সকলেই জানেন, মা লক্ষ্মী হবে ধনসম্পদের দেবী, বাড়িতে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্যে দেবী লক্ষ্মীর পুজো আমরা করে থাকি। আশ্বিনের শেষে শরৎ পূর্ণিমায় যে-লক্ষ্মী পুজো করা হয়, তাই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো নামে পরিচিত। কিন্তু কেন ‘কোজাগরী’? এই নামের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে প্রচলিত এক কাহিনি। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, ‘কোজাগরী’ কথাটি এসেছে ‘কো জাগর্তি’ থেকে, যার অর্থ ‘কে জেগে?’ মনে করা হয়, পূর্ণিমার এই বিশেষ তিথিতে ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মী স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন ধরিত্রী পরিক্রমায় ও গৃহস্থকে আশীর্বাদ করেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, বাড়ির দরজা বন্ধ থাকলে সেখানে তিনি পদার্পণ করেন না। ফলে লক্ষ্মী পুজোর এই দিনে দেবী লক্ষ্মীর আগমনের প্রতীক্ষায় দরজা-জানলা খুলে, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাতে জেগে থাকাই দস্তুর।
লক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে জড়িত কৃষি
শাস্ত্রে রয়েছে, “নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী/তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।” অর্থাৎ সারারাত জেগে যিনি অক্ষক্রীড়া করেন, দেবী তাঁকেই সম্পদ দান করেন। আবার কারওর মতে, বাঙালির লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত কৃষি। বর্ষাশেষে শরতকালই হল ধান পাকার প্রকৃষ্ট সময়। তাই ধান যাতে চুরি না হয়, সেজন্যে অনেকেই মাঠেই রাত জেগে শস্য পাহারা দেন। আর এই শস্য পাহারা দেবার সূত্রেই দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ কামনা করা।
চোরেদের বিশেষ দিন!
এছাড়া আর একটি মজার গল্পও এর সঙ্গে জড়িত। গ্রাম বাংলায় আগেকার দিনে চোরেদের কাছে গৃহস্থ বাড়িতে চুরি করা ছিল বিশেষ সম্মানের। কারণ এই একটি দিনে দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যে বেশিরভাগ গৃহস্থই জেগে থাকেন। ফলে পূর্ণিমা রাতে জাগ্রত গৃহস্থের চোখ এড়িয়ে যদি কেউ চুরি করতে পারত, সে সমাজে বিশেষ সম্মান পেত। তাই চোরেদের কাছেও এই দিনের গুরুত্ব ছিল।
নানারূপে লক্ষ্মীর আরাধনা
মূর্তি ছাড়াও নানাভাবে বাঙালি মা লক্ষ্মীর আরাধণা করে। কোন গৃহস্থ বাড়িতে কুনকের মধ্যে ধান ভর্তি করে সিঁদুর কৌটো লাল শাড়িতে মুড়ে অনেকসময় লক্ষ্মীর রূপ দেওয়া হয়, আবার পটচিত্রে অঙ্কিত লক্ষ্মীর উপাসনাও অনেকে করেন।
লক্ষ্মী পুজোয় কী কী করবেন না?
তবে লক্ষ্মীপুজোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখা অবশ্য কর্তব্য। সেগুলি এক নজরে দেখে নিন-
- লক্ষ্মীপুজোর ক্ষেত্রে সাদা রংয়ের ফুল ব্যবহার করবেন না। লাল, হলুদ, গোলাপি ইত্যাদি অন্য যে-কোনও রংয়ের ফুল ব্যবহার করুন। তাছাড়া এই পুজোয় তুলসির ব্যবহারও হয় না।
- লক্ষ্মীর আসনে সাদা ও কালো কাপড় পাতবেন না। লাল, গোলাপি ইত্যাদি রংয়ের কাপড় পাতুন। মা লক্ষ্মী এতে তুষ্ট হবেন।
- লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদে কখনও ‘না’ বলবেন না। এতে দেবী অসন্তুষ্ট হন। অল্প হলেও প্রসাদ খাবেন। এছাড়া পুজোর সময় অনেকে দক্ষিণমুখো করেও প্রসাদ নিবেদনের কথা বলে থাকেন।
- পুজোর সময় কোনওভাবেই কালো জামা বা শাড়ি পরবেন না।
- দেবী লক্ষ্মী শব্দ পছন্দ করেন না বলে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টা ইত্যাদি পুজোয় বাজানো হয় না। শুধু শাঁখ বাজালেই চলবে।
- যেহেতু অলক্ষ্মীর পুজো লোহার বাসনে করা হয়, তাই লক্ষ্মী পুজোর প্রসাদ বা পুজোসামগ্রী স্টিলের বা লোহার পাত্রে রাখবেন না। তামার বা পিতলের বাসনে রাখুন, এছাড়া কলাপাতাতেও পুজোর সামগ্রী ও প্রসাদ রাখতে পারেন।
২০২১ সালে লক্ষ্মী পুজোর নির্ঘণ্ট
২০২১ সালে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর তিথি পড়েছে দু’দিনে।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে-
পূর্ণিমারম্ভ- ২ কার্তিক, মঙ্গলবার, (১৯ অক্টোবর)
সময়- সন্ধে ৭টা ৫ মিনিট
পূর্ণিমা সমাপ্তি-৩ কার্তিক, বুধবার (২০ অক্টোবর)
সময়- রাত ৮টা ২৭ মিনিট
এই সময়ের মধ্যে সকলে বাড়িতে মা লক্ষ্মীর পুজো করতে পারেন। তবে ১৯ অক্টোবর রাত ১১.৩৫ থেকে ১২.২৭—এই ৫২ মিনিটের মধ্যে যদি পুজো করেন, তাহলে সেটি শুভ বলে গণ্য হবে। সাধারণত প্রদোষকালেই মা লক্ষ্মীর উপাসনা করা হয়। তাই দু’দিন পুজো থাকলে কোন দিন পুজো করবেন, সেই নিয়ে অনেকেই সংশয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন, যদি আগের দিন রাত থেকে পরদিন প্রদোষকাল পর্যন্ত তিথি থাকলে বেশিরভাগই পরদিন প্রদোষে পুজো করেন। আর যদি পরের দিন প্রদোষে তিথি না থাকে, তাহলে আগের দিনই করে নেবেন। এক্ষেত্রে ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে পুজোর ক্ষণ স্থির করাই বাঞ্ছনীয়।
লক্ষ্মী পুজোর খুঁটিনাটি
বাঙালির বিশ্বাস অনুযায়ী, ভক্তি মনে যারা কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো করেন, তাঁর গৃহেই সারাবছর চঞ্চলা মা লক্ষ্মী অধিষ্ঠান করেন ও সেই গৃহস্থকে সুখ, সমৃদ্ধি ও সম্পদে ভরিয়ে দেন। দেবী লক্ষ্মী অল্পেই সন্তুষ্ট হন, ফলে পুজোয় খুব একটা বাহুল্য নেই। তবে মনে রাখবেন, দেবী লক্ষ্মী কিন্তু পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। তাই এই দিন ভাল করে ঘর পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে নিন। তারপর ভাল করে নিষ্ঠাভরে আলপনা দিন। এই আলপনার মধ্যে দেবীর পা অঙ্কন করতে ভুলবেন না। এরপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে ধুপ, ধুনো দিয়ে পুজো শুরু করুন। প্রসাদের মধ্যে কিন্তু অবশ্যই বাড়ির তৈরি নাড়ু, মুড়কি, মোয়া রাখুন।
লক্ষ্মী পুজোয় পাঁচালি পাঠের মাহাত্ম্য
লক্ষীপুজোর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ। এই পাঁচালি পাঠের মাহাত্ম্য অপরিসীম। এই পাঁচালি পাঠে দেবী ভক্তের উপর সন্তুষ্ট হন এবং এর ফলে বিভিন্ন রোগ থেকে আমাদের মুক্তি মেলে ও কর্মক্ষেত্রে সাফল্য মেলে।
তাহলে এবার লক্ষ্মী পুজোর নির্ঘণ্ট ও খুঁটিনাটি তো জেনেই গেলেন। পুজোর যোগাড়যন্ত্র করে ভক্তিভরে মাকে পুজো করুন। দেখবেন সারাবছর আপনার গৃহে শান্তি বজায় থাকছে এবং মা লক্ষ্মী আপনাকে ধনসম্পদে ভরিয়ে দিচ্ছেন।
মন্তব্য করুন