সম্প্রতি ১৩ জুলাই ২০২১ এ হয়ে গেল মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ১৩ তম আসরের ফাইনাল। ফাইনালে টপ ৩ এ ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী, জাস্টিন নারায়ণ, এবং পিট ক্যাম্পবেল। দুইদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত ফাইনালে কিশোয়ার জয়ী না হলেও তার পান্তা ভাত আর আলু ভর্তার রেসিপি গোটা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। এরকম সাদামাটা খাবার যে তিনি সাহসিকতার সাথে মাস্টারশেফে তুলে ধরেছেন – এটাই সবার মন ছুঁয়ে যায়।
ফাইনালের প্রথম দিনের শুরুটা কিন্তু ছিল যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। কিশোয়ার প্রথমে নিয়েছিলেন হাঁসের মাংস দিয়ে একটি রেসিপি তৈরির কাজ। বিচারকরা যখন তার টেবিলে আসলেন, তার রান্নার আয়োজন দেখে বিচারকরা প্রশ্ন করে বসলেন, “এখানে কিশোয়ার কোথায়?” অর্থাৎ কিশোয়ারের আয়োজনে তারা সত্যিকারের কিশোয়ারকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
ততক্ষণে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে, ঘড়ির কাঁটাও এগিয়ে চলছে। এই মুহূর্তে নতুন রেসিপি ঠিক করাটা কঠিন, কারণ সময়ের মধ্যে শেষ করা চাই-ই চাই। তখনি কিশোয়ারের মাথায় খেলে গেল চমৎকার একটা বুদ্ধি। তিনি ঠিক করলেন এমন কিছু রাঁধবেন, যেটা এই অনুষ্ঠানে আগে কখনো করা হয় নি।
বেছে নিলেন অবশেষে পান্তা ভাত আর আলু ভর্তা, সাথে সার্ডিন মাছ ভাজি। সার্ডিন মাছের আকারের সাথে দেশি টেংরা মাছের অনেকটা মিল আছে। যেই ভাবা সেই কাজ, চটজলদি বানিয়ে ফেললেন খাবার তিনটি। পান্তা ভাতকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘স্মোকড রাইস ওয়াটার’। পুরো ডিশের নাম ‘স্মোকড ওয়াটার রাইস উইথ আলু ভর্তা অ্যান্ড ফ্রাইড সার্ডিনস। সাথে আরো ছিল সালাদ।
রান্না শেষে পরিবেশনকালে কিশোয়ার এই পান্তা ভাতের ইতিহাস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পান্তা ভাত সাধারণত গ্রীষ্মকালে বেশি খাওয়া হয়। আগের রাতের বেঁচে যাওয়া ভাতে পানি দিয়ে রাখা হয় সারারাত। পরদিন সকালে খাওয়া হয় সেই পানি দেয়া ভাত।
পান্তা ভাতের সাথে আলু ভর্তা প্রধানত অস্বচ্ছল, নিম্ন আয়ের মানুষের খাবার। স্বচ্ছল মানুষের খাবার টেবিলে বেঁচে যাওয়া ভাত হয়তো ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে গরীবের কাছে পান্তা ভাত আর আলু ভর্তা হচ্ছে অমৃত। আর সেই খাবারকেই কিশোয়ার তুলে ধরেছেন মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার মত আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে।
কিশোয়ার বিচারকদের আরো বলেন যে এই অতি সাধারণ খাবার বাঙালিদের চিরচেনা, কিন্তু কোন রেঁস্তোরায় বিক্রি করা হয় না। এরকম খাবার তৈরির সময় তিনি যথেষ্ট ভয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি একইসাথে সৌভাগ্যবতী এবং আনন্দিত, এরকম একটা খাবার বানাতে পেরেছেন তার জন্য।
বিচারকরা এই খাবার খেয়ে দারুণ খুশি হয়েছেন। এক কথায় এই ডিশটা ‘আনবিলিভ্যাবল’। জক জনফ্রিলো বলেছেন, “আমার জিভে জল চলে এসেছে। সত্যিই এটা দারুণ বৈচিত্র্যময় খাবার”। মেলিসা লিয়ং এই খাবারকে ” স্বাদে এবং ইতিহাসে শক্তিশালী” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই এক ডিশেই কিশোয়ার করেছেন বাজিমাত, পেয়েছেন ৩০ এ ৩০ নাম্বার!
ফাইনাল প্রতিযোগীতার প্রথম দিনে ৫১ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন কিশোয়ার, প্রতিদ্বন্দ্বী পিট ক্যাম্পবেল পেয়েছিলেন ৫৩ পয়েন্ট ও জাস্টিন নারায়ণ পেয়েছিলেন ৫০ পয়েন্ট। দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ দিনে নারায়ণ, পিট, এবং কিশোয়ারকে বানাতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান শেফ পিটার গিলমোরের দুটি ডিশ।
প্রথমে দুটি মেইন কোর্সের অপশন ছিল – একটি হচ্ছে সেভোরি ডিশ, অন্যটি হচ্ছে শেভড সাউদার্ন স্কুইডের সাথে কোজি বাটার এবং শিতাকে কাস্টার্ডের রেসিপি। আর শেষে বানাতে হবে গিলমোরের নতুন ডেজার্ট রেসিপি ‘গোল্ডেন ক্র্যাকল’। সেভোরি ডিশ বানিয়ে কিশোয়ার পান ৩২ পয়েন্ট। তাতে দুইদিনের স্কোর মিলে তার মোট স্কোর দাঁড়ায় ৮৩।
এরপরে ডেজার্ট ডিশ রান্নার পরে ৩১ পয়েন্ট নিয়ে কিশোয়ারের সর্বমোট স্কোর দাঁড়ায় ১১৪। অপর দুই প্রতিযোগী জাস্টিন ১২৫ নাম্বার পেয়ে জয়ী ও পিট ১২৪ নাম্বার পেয়ে প্রথম রানার আপ হয়েছেন, আর কিশোয়ার হয়েছেন দ্বিতীয় রানার আপ। পুরষ্কার হিসেবে কিশোয়ার পেয়ে যান ২০,০০০ ডলার প্রাইজ মানি।
মাছের ঝোল, শিম ভর্তা, মাছ ও আমের টক ইত্যাদি বাঙালি রান্নার পাশাপাশি তিনি মাস্টারশেফে বানিয়েছিলেন বিদেশি বিভিন্ন পদ।
ছাগলের পায়ের নিহারি পছন্দ করে না, এমন মানুষ বাংলাদেশে খুব কম পাওয়া যাবে। প্রাচীন মুঘল আমলের সম্রাটদের রসনা নিহারি ছাড়া কল্পনা করা ছিল অসম্ভব। সেই মুঘল খাবার নিহারি-নান রুটি কিশোয়ার তৈরি করেছিলেন একটু ভিন্ন ধাঁচে, তার বাবা যেভাবে খেতে ভালোবাসেন ঠিক সেভাবে। বিচারকরা তো বলেই বসলেন, এটা শুধু খাবার না, এটা একটা জাদু।
‘গেম মিটস’ চ্যালেঞ্জের দ্বিতীয় পর্বে কিশোয়ার মাত্র ৭৫ মিনিটে তৈরি করেছিলেন খাসির রেজালা আর পরোটা। এই রান্না সম্পর্কে কিশোয়ার বলেন যে মাত্র ৭৫ মিনিটে এই হেভি ডিশ রান্না করা মোটেও কোন সহজ কাজ না। কারণ খাসির মাংস সিদ্ধ হতেই অনেক সময় লাগে। প্রতিযোগীতার এই পর্যায়ে তিনি হারতে রাজি নন, তাই নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে বানিয়েছিলেন ঝাল মাংস আর পরোটা। বিচারক অ্যান্ডি অ্যালেন আর জক জনফ্রিলো এর ভূয়সী প্রশংসা না করে পারেন নি।
নেক-অ্যান্ড-নেক রেসে এলিস আর জাস্টিনের সাথে কিশোয়ার পাল্লা দিয়েছিলেন ‘আফটার ডিনার মিন্ট’ রেসিপি দিয়ে। পানপাতায় আইসক্রিম পরিবেশন করেছিলেন তিনি, উপরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ড্রাই ফ্রুটস। আইসক্রিমের ঠান্ডা স্বাদের সাথে পানপাতার ঝাঁঝালো স্বাদ আর মিষ্টি ড্রাই ফ্রুটস – এ যেন অপূর্ব স্বাদের মিশেল৷ সুন্দর এবং সুস্বাদু এই ডিশ মেলিসার মুখে ফুটিয়েছিল স্বাদের হাসি।
ক্লাসিক এই ডিশটি তৈরিতে কিশোয়ার বেছে নিয়েছিলেন মুরে কড মাছের লেজের অংশ। মাছটাকে তিনি প্রথমে আদা দিয়ে সিদ্ধ করে নিয়েছিলেন। তারপর টমেটোর ঝোল বানিয়েছেন ভাজা পেঁয়াজ পাতা ও জিরা গুঁড়া দিয়ে। তারপর ঝোল আর মাছ একসাথে মিলিয়ে নিয়েছেন।
বহুল জনপ্রিয় এই তিনটা খাবারেই আলুর ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় ব্যবহার দেখিয়েছেন কিশোয়ার। ফুচকা বানিয়েছিলেন আলু স্কুপ করে, সমুচার র্যাপিং আর স্টাফিংয়েও দিয়েছিলেন আলু। এমনকি ফুচকার টপিংয়েও আলুর ঝুরিভাজা ব্যবহার করেছেন। সাথে টক-ঝাল তেঁতুলের সস ছিল পরিবেশনে।
খিচুড়ি প্লেটারে খিচুড়ির সাথে ছিল মাছ ভাজা, বেগুন ভর্তা, ৫ ধরণের সবজির নিরামিষ। এই সাধারণ কিন্তু দারুণ সুস্বাদু খাবার পৃথিবীজুড়ে কয়েকশ মিলিয়ন বাঙালির ঘরে ঘরে পাওয়া যাবে – এমনটাই দাবি করেছেন কিশোয়ার। বর্ষাকালে বাঙালির প্রিয় খাবার খিচুড়ি। আবহমান বাংলার এই জনপ্রিয় খাবারকে তিনি সাজিয়েছিলেন এই ৩ রকমের পদ দিয়ে।
‘ভুনা’ রান্নায় রান্না পদ্ধতি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। উর্দু ভাষা থেকে আগত এই শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘ভাজা’। উত্তরপূর্ব ভারত ও পশ্চিমা বাংলাদেশের মানুষ মাংসের কালা ভুনা খেতে খুব পছন্দ করে। এই জাতীয় রান্নায় মশলাগুলোকে ভালোভাবে ভেজে নিতে হয় আগে।
মাস্টারশেফে যাত্রা শুরু করার পর কিশোয়ার এমন একটা কিছু বানাতে চেয়েছিলেন, যেখানে প্রাচীন রান্না পদ্ধতি ও বাহারি মশলা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব। তাই বিচারকদের তৈরি করে দেখান কালা ভুনা। বাবার শেখানো পদ্ধতিতে মরক্কান অক্সটেইল দিয়ে এই ডিশটি বানিয়েছিলেন তিনি।
পুরান ঢাকার মজাদার বিফ প্যাটিসও কিশোয়ারের জাদুতে উঠে এসেছে মাস্টারশেফের মঞ্চে। মজাদার এই বিফ প্যাটিসের সাথে আরো ছিল টমেটো-তেঁতুলের চাটনি আর কামরাঙ্গার সালাদ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই খাবার ঢাকার কোথায় পাওয়া যায় সেটাও জানিয়েছেন তিনি। গাউসিয়া মার্কেটের কাছে টং দোকানগুলোতে প্রতিদিন তৈরি হয় বিফ প্যাটিস আর কামরাঙ্গার ঝাল সালাদ। সেই পুরান ঢাকার স্মৃতিচারণ করেই তিনি তৈরি করেছিলেন এই খাবার।
এটা আসলে ট্র্যাডিশনাল বার্মিজ নুডলসের নাম। জনপ্রিয় এই বার্মিজ স্ট্রিট ফুডকে কিশোয়ার পরিবেশন করেছিলেন কোকোনাট মিল্ক সস, লেবু, নোনতা বাদাম, শুকনা মরিচ মেশানো সয়া সস, এবং তাজা হার্ব দিয়ে। খেতে এমনই সুস্বাদু ছিল এটা, বিচারক জক জনফ্রিলো কিশোয়ারকে ১০ এ ১১ দিয়ে দেন।
আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…
পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…
আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…
বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…
ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…
প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…