ধর্ম ও সংস্কৃতি

মহালয়ার দিন প্রত্যেক বাঙালীর কাছে এত বিশেষ কেন?

মহালয়া মানেই ভোরবেলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় স্তোত্রপাঠ শুনে দিন শুরু করা। মহালয়া মানেই বাঙালির সবথেকে বড় পুজো দুর্গা উৎসবের আমেজ শুরু হ‌ওয়া। হ্যাঁ মহালয়ার ঠিক ৬ দিন পর‌ই মহাসপ্তমী আসে, তাই মহালয়া আসা মানেই দুর্গাপুজোর আর হাতে গোনা কয়েকটা দিন। তবে দুর্গাপুজোর আগমন বার্তা আনা ছাড়াও বাঙালির জীবনে মহালয়ার একটি বিশেষ গুরুত্ব‌ রয়েছে। অনেকেই মহালয়ার সেই গুরুত্বের কথা জানেন না, সেই বিষয়ে জানাতেই দাশবাসের তরফ থেকে আমি আজ হাজির।

১. মহালয়ার বিশেষ গুরুত্বঃ

ক. আমাদের হিন্দু ধর্মে কোন শুভকার্য, বিবাহ ইত্যাদি করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়। শাস্ত্রে তর্পন শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে, জল দ্বারা পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধন। এই তর্পণ কার্য প্রত্যেকটি মানুষের জন্য‌ই আবশ্যিক। মহালয়ার দিন প্রয়াত পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয়।

মহালয়ার শুভ তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের প্রয়াত পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। এমনটা করার মধ্য দিয়ে যেমন পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা হয় ঠিক তেমনভাবে পূর্বপুরুষরা উত্তর পুরুষদের এই আচরণ দেখে খুশি হয়ে তাদের আশীর্বাদ করেন আর স্বর্গবাসী সেইসকল পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদে তর্পণকারীর সংসার সুখ ও শান্তিতে ভরে ওঠে।

খ. মহালয়ার দিন যারা গঙ্গাতে অঞ্জলি প্রদান করেন তারা শুধু তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যেই অঞ্জলি দেন না, তারা পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য‌ও প্রার্থনা এবং অঞ্জলি প্রদান করে থাকেন। যাদের পুত্র নেই যাদের স্মরণ করবার কেউ নেই তাদের উদ্দেশ্যেও মহালয়ার এই পূণ্য দিনে তর্পণ করা যায়।

এইদিন তর্পণের সময় বলা হয় যে, যারা আমার বন্ধু নন অথবা আমার বন্ধু যারা জন্ম-জন্মান্তরে আমার আত্মীয় বন্ধু ছিলেন তাঁরা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহণ করুন। যাদের পুত্র নেই যাদের আজকের দিনে স্মরণ করার কেউ নেই তারাও আজ আমার অঞ্জলি গ্রহণ করুন। সমগ্র জগতের এই মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে মহালয়ার এই তিথি হয়ে ওঠে অত্যন্ত পূণ্যপ্রদানকারী শুভ  এক তিথি।

গ. আরেকটি মত অনুসারে বলা হয় যে, মহান আলয়টি হচ্ছে পিতৃলোক। পিতৃলোকে সকল বিদেহী পিতৃপুরুষ, ঋষি ও প্রজাপতিরা অবস্থান করেন তাদের স্মরণমূলক অনুষ্ঠানই মহালয়া। জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী পিতৃলোকে অবস্থান করেন।

পরের প্রজন্মের একজনের মৃত্যু ঘটলে আগের প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে যান অথবা পরমাত্মার মধ্যে লীন হন। মহালয়ার দিন তর্পনকারী ব্যক্তি তাই পিতৃতর্পণের মাধ্যমে পিতৃলোকের সাথে মানসিক ও আত্মিক সংযোগ স্থাপন করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রণাম নিবেদন করেন। আবার এইদিন মাতৃ তর্পণ‌ও করা হয়। এর ফলে এই দিনটিই পিতৃ পূজা ও মাতৃ পূজার পুণ্য লগ্ন বলে বিবেচিত।

ঘ. মহালয়ার দিন কৃষ্ণ তিল, চাল, কলা দিয়ে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে ও প্রয়াত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের উদ্দেশ্য শ্রাদ্ধ করা হয়, একে প্রেত পক্ষবিহিত(মহালয়া পার্বন শ্রাদ্ধ) শ্রাদ্ধ বলা হয়। এমনটা করলে পিতৃপুরুষগণ সন্তুষ্ট হন ও সংসারের উপর আশীর্বাদ বর্ষণ করেন।

২. মহালয়া শব্দের অর্থঃ

আমাদের হিন্দু ধর্মে উল্লেখিত আছে যে, মহালয়ার দিন তর্পন নেওয়ার জন্য মৃত পূর্বপুরুষরা মর্ত্যে এসে হাজির হন। প্রয়াত আত্মাদের এই যে মর্তলোকে হাজির হ‌ওয়া অর্থাৎ এই যে মহৎ আলয়ের সৃষ্টি হওয়া সেটিকেই বলা হয় মহালয় আর এই মহালয় থেকেই মহালয়া শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। আবার মহ শব্দের অর্থ পুজো বা উৎসব তাই মহালয়ার অন্য অর্থ হচ্ছে পুজো উৎসবের আলয় অর্থাৎ আশ্রয়।

যেহেতু দুর্গা পুজো বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব আর সেই পুজোর সূচনায় হচ্ছে মহালয়া থেকে, তাই মহালয়া শব্দটি এই অর্থেও প্রযোজ্য। একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে যে, মহালয়ার দিন দেবীপক্ষের সূচনা হয়, এটি কিন্তু ঠিক নয়। মহালয়ার দিন‌ই পিতৃপক্ষের শেষ দিন, এর পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীপক্ষের সূচনা হয়।

পিতৃপক্ষের অবসানের পর অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে গিয়ে আমরা যখন আলোকিত দেবীপক্ষের আগমনেকে প্রত্যক্ষ করি, সেই মহালগ্ন‌ই ‌‌‌‌‌‌‌‌আমাদের জীবনে মহালয়ার বার্তা নিয়ে আসে। দেবী দুর্গাই এই ক্ষেত্রে মহান আশ্রয় তাই উত্তরণের লগ্ন টির নাম মহালয়া।

৩. ২০২১ সালে মহালয়াঃ

২০২১ সালে ৬ই অক্টোবর ১৯ শে আশ্বিন হলো মহালয়া। মহালয়ার ৬ দিন পর অর্থাৎ ১২ই অক্টোবর হচ্ছে মহাসপ্তমী। মহা সপ্তমীরদিন নবপত্রিকা স্থাপন থেকে শুরু করে দেবীর মহাস্নান , প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও চক্ষুদান হয়।

৪. তর্পণ সম্পর্কিত পৌরাণিক ঘটনাঃ

মহাভারত অনুযায়ী, তর্পণ সম্পর্কিত একটি বিশেষ কাহিনীর উল্লেখ আছে। মহাভারতের কর্ণ যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধ করার পর দেহত্যাগ করে স্বর্গে গমন করেন তখন সেখানে তার আত্মাকে খাদ্য হিসেবে শুধুই গয়না উৎসর্গ করা হতো। এই দেখে দানশীল কর্ণ বিস্মিত হয়ে যান!

কেন তাকে খাদ্য ও পানীয়ের পরিবর্তে শুধুমাত্র গহনা দেওয়া হচ্ছে, এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে দেবরাজ ইন্দ্র কর্ণকে জানান যে “ আপনি জীবদ্দশায় কখনো প্রয়াত পূর্ব পুরুষদের স্মরণ করেন নি, তাদের আত্মার উদ্দেশ্যে খাবার জল অর্পণ করেন নি, তাই পুণ্য ফলে আপনি স্বর্গে আসতে পারলেও খাদ্য-পানীয় পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হননি।

আপনি সারাজীবন মানুষকে সোনা দান করে গিয়েছেন তাই সেই কর্মফল‌ই আজ আপনার কাছে ফিরে এসেছে” কর্ণ এর উত্তরে বলেন যে, এই বিষয়ে তার কোনো রকম দোষ নেই। কারণ কুমারী মায়ের সন্তান ছিলেন বলে তার জন্ম মুহুর্তেই তার মা কুন্তি তাকে ত্যাগ করেছিলেন।

এরপর সূত বংশজাত অধিরথ ও তার স্ত্রী কর্ণকে সন্তান স্নেহে মানুষ করেছিলেন। পরবর্তীতে দুর্যোধন তাকে আশ্রয় দেন এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরম্ভের আগের দিন প্রথমে কৃষ্ণ ও তারপরে তার নিজের মা-বোন এসে তাকে জন্ম পরিচয় ও বংশ পরিচয় জানান।

এরপর যুদ্ধ আরম্ভ হ‌ওয়ার পর মাত্র ১৬ থেকে ১৭ দিন তিনি বেঁচে ছিলেন, তাই পিতৃ-পুরুষকে জল দেওয়ার সময় তিনি পাননি। কর্ণকে একটি সুযোগ দেওয়া হয় তার ভুল সংশোধনের জন্য।

কর্ণ তার কী করনীয় তা জানতে চাইলে কর্ণকে বলা হয় তাকে পুনরায় মর্তলোকে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও খাদ্য দান করে আসতে হবে, তবেই তিনি স্বর্গে খাদ্য ও পানীয় পাবেন।

এরপর কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসবার সুযোগ দেওয়া হয় যাতে তিনি পিতৃপুরুষকে জলখাবার অর্পণ করতে পারেন। এই সময়কালটিই পিতৃপক্ষ হিসেবে পরিচিত আর পিতৃপক্ষের শেষ দিন‌ই হলো মহালয়া। এইদিন পিতৃপুরুষকে তিল জল দান করলে পাপস্খলন হয়।

উল্লেখ্য, মহালয়া পক্ষের ১৫টি তিথি হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও মহালয়া অমাবস্যা।

Sangita Chowdhury

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 বছর ago