সামনের রবিবার আলোর উৎসব দীপাবলি। আর এই দীপাবলির বিশেষ দিনেই আরাধনা করা হয় মা কালীর। কলকাতার বুকে মা কালীর যে মন্দির দুটি সাধারণ মানুষের কাছে খুবই পরিচিত তা হল কালীঘাট মন্দির এবং দক্ষিণেশ্বর মন্দির।
সারা বছরই দূর দূরান্ত থেকে এখানে ভক্তের সমাগম ঘটে। তবে শ্যামা পুজোর মতো এই বিশেষ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এইসব মন্দিরগুলিতে ভক্তের ঢল থাকে চোখে পড়ার মতো। তবে কেবল মাত্র কালীঘাট বা দক্ষিনেশ্বর মন্দিরই নয় পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বিভিন্ন নামজাদা কালী মন্দিরে এই শ্যামাপুজোর সময়ে রীতিমতো ভক্তদের ঢল নামে।
জেনে নিন রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী শ্যামা পুজোর গল্প
গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে রয়েছে অজস্র কালী মন্দির। তার মধ্যে থেকে বেছে বিশেষ ৫টি মন্দিদের নানা অজানা কাহিনী আজ আপনাদের শোনাবো। সত্যি কি মিথ্যা যাচাই না করে বরং লোক মুখে প্রচারিত সেই সব কাহিনী আসুন শোনা যাক।
১. কালীঘাট মন্দির
- কলকাতায় থাকেন কিন্তু কালীঘাটে যাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। ভারতের ইতিহাসে বহু প্রাচীন কালী মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম হল কালীঘাট মন্দির। কালীঘাটের মা কালীকে খুবই জাগ্রত বলে মনে করে ভক্তরা। আর সেই কারণেই মায়ের টানে প্রতি বছর এই পুজোর সময়ে সমাগম হয় কয়েক হাজার ভক্তের।
- কালীঘাটের এই কালী মন্দির নিয়ে রয়েছে এক ইতিহাস। কথিত রয়েছে সতীর ডান পায়ের পাতা এই স্থানে পড়ার কারণে একান্ন সতীপীঠের একটি হল এই কালীঘাট। লোকমুখে প্রচলিত যে, দুই সন্ন্যাসী ব্রহ্মানন্দ গিরি এবং আত্মারাম ব্রহ্মচারী একটি কালো কষ্টি পাথরের ওপর মা কালীর রূপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
- এরপর ১৮০৯ সালে বড়িশার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরির বংশের শিবদাস রায়চৌধুরি অধুনা কালীঘাটে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এই কাজে তাঁর সহযোগী হয়েছিলেন তাঁর পুত্র রামলাল চৌধুরি এবং ভাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্ত চৌধুরী। সাবেকি আটচালা রীতিতেই এই মন্দিরটি নির্মিত।
- বর্তমানে কালী মাতার মূর্তটির জিহ্বা, দাঁত এবং মাথার মুকুটটি সোনার তৈরি। বলা হয়, মন্দিরের একটি গোপন জায়গায় সতীদেহের সেই অংশটি আজও সংরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। যদিও সেই অংশটি প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হয়েছে। দেবীর এই দেহাবশেষ কখনওই সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে আসা হয় না।
২. দক্ষিণেশ্বর মন্দির
- সতীপিঠ না হলেও দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের মাহাত্মও কিন্তু কোনও অংশে কম নয়। জানবাজারের জমিদার বাড়ির বউ রানি রাসমণি দাসী মা কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে হুগলি নদীর তীরে ১৮৫৫ সালে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
- এখানে মা কালীকে দেবী ‘ভবতারিণী’ রূপে পুজো করা হয়। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সাধনাস্থল হয়ে উঠেছিল এই পুণ্যভূমি।
- মা ভবতারিণীর মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে একটি নাটমন্দির, শ্রী শ্রী রাধাকান্ত মন্দির (রাধা-কৃষ্ণ মন্দির) এবং ১২টি আটচালা ধাঁচের শিবমন্দির। জানলে হয়তো অবাক হবেন সেই সময়ে প্রায় ৯ লক্ষ টাকা ব্যয় করে তৈরি করা হয়েছিল এই মন্দির।
- এরপর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই মন্দিরে মায়ের পুজোর জন্য প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। সেই থেকে আজও শ্রী শ্রী ঠাকুরের মাহাত্ম জুড়ে রয়েছে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের সঙ্গে। সেই থেকে নিত্য পুজোর পাশাপাশি শ্যামা পুজোর দিনও বিশেষ আয়োজন করা হয়ে থাকে।
৩. মালদার গোবরজন্না কালাবাড়ি
- মালদার গোবরজন্না কালি মন্দিরের কথা অনেকেরই অজানা। কিন্তু প্রচারের আলো থেকে অনেকটাই দূরে হলেও এই কালিমন্দিরের মাহাত্ম্য কিন্তু অপরিসীম।
- বলা হয় যে, জলদস্যুদের ধরতে এসে এক পরিত্যক্ত বনাঞ্চল-ঘেরা জায়গায় এসে পড়েন ডাকাত সর্দার ভবানী পাঠক এবং দেবী চৌধুরাণি।
- সেখানে একটি পরিত্যক্ত কালী বেদিতে অবিকল মা কালীর অবয়ব কল্পনা করেন তিনি। এরপর কালিন্দী নদীর জলে স্নান করে সেখান থেকে মাটি তুলে এনে সেই মাটি দিয়েই মা কালীর মূর্তি গড়লেন তিনি। নিজের শরীর থেকে রক্ত দিয়ে পুজো করলেন দেবীর।
- প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই মা কালীর মন্দির, কিন্তু জাঁকযমকে কিন্তু এতটুকু ভাটা পড়েনি। আজও প্রত্যেক কার্তিক অমাবস্যা তিথিতে ধুমধাম করে দেবীর আরাধনা করা হয়।
৪. দক্ষিণ দিনাজপুরের বল্লা কালী মন্দির
- বালুরঘাট থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই ঐতিহ্যশালী বল্লা কালী মন্দির।
- বল্লা কালী মন্দিরের নেপথ্যে এক অদ্ভুত গল্প প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, এক জমিদার একবার কর দিতে না পারায়া তাঁকে গ্রেফতার করেন তৎকালীন ইংরেজ শাসক। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি মা কালীর শরণাপন্ন হন। এরপরই তিনি ছাড়া পেয়ে যান। তারপর থেকে ভক্তি ও নিষ্ঠা ভরে মা কালীর বন্দনা শুরু করেন ওই জমিদার।
- সেই শুরু আজও সেখানে দেবীরর নিত্যপুজোর পাশাপাশি, বিশেষ বিশেষ তিথিতে ভোগ নিবেদন করা হয় মাকে।
৫. কলকাতার চীনা কালী মন্দির
- নাম থেকে আপনাদের মনে হতে পারে মা কালী আবার চীনা হলেন কীভাবে? কিন্তু ওই যে কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর। মনে যদি বিশ্বাস থাকে তাহলে যে কেউ মায়ের পুজো করতে পারেন। অন্তত তেমনটাই প্রমাণ করেছেন কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলের মানুষরা।
- ধর্মের বেড়াজাল সেখানকারর মানুষকে আটকে রাখতে পারেননি মায়ের চরণে অঞ্জলি দেওয়া থেকে। আর সেই কারণেই এই তিলোত্তমার বুকে মা কালীর পুজো করে আসছেন চীনা সম্প্রদায়ের মানুষরা।
- কথিত আছে, একবার এক চীনা দম্পতির সন্তান চরম ব্যাধির শিকার হন, কোনওভাবেই তাকে সুস্থ করে তোলা না গেলে পথের ধারে পড়ে থাকা দুটির পাথরের সামনে হত্যে দিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। এরপর সুস্থ হয়ে ওঠে তাঁদের সন্তান। সেই থেকেই শক্তির আরাধনায় আত্মনিয়োগ করেন তাঁরা।
- এইভাবেই ধীরে ধীরে কলকাতার চীনা সম্প্রদায়ের মানুষরা গড়ে তোলেন এই চীনা কালী মন্দির। এই মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল মন্দিরের প্রসাদ। কারণ প্রসাদ হিসাবে এখানে মা কালীকে নিবেদন করা হয় ন্যুডুলস আর চপস্যুই। জানলে আরও অবাক হবেন যে, হিন্দুদের পাশাপাশি প্রত্যেকদিন মা কালীর দর্শন পেতে আসেন বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মের মানুষরা।