আমাদের মুখের ত্বকের লোমের নিচের রয়েছে খুবই ছোট ছোট গর্ত, যা লোমকূপ বা পোর নামে পরিচিত। লোমকূপের মাধ্যমে ত্বক তার প্রয়োজনীয় তেল ও আর্দ্রতা পেয়ে থাকে। এমনিতে পোর খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু বিভিন্ন কারণে লোমকূপ স্বাভাবিকের চাইতে বড় হয়ে যায়, আর তখনই দেখা দেয় সমস্যা।
লোমকূপ বড় হয়ে গেলে মুখের স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে মুখ দেখায় মলিন। বড় লোমকূপে ময়লা ও মেকআপ আটকে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয় এবং ব্ল্যাকহেডস, হোয়াইটহেডস, ও পিম্পলে স্কিন ভরে যায়। আজকের পর্বে থাকছে বেড়ে যাওয়া লোমকূপ বন্ধ করতে ৬টি টিপস নিয়ে আলোচনা। তবে তার আগে জানব কেন লোমকূপ বড় হয়।
কি কি কারণে লোমকূপ বড় হতে পারে
- হরমোনের পরিবর্তন এবং স্ট্রেস। টিনেজ, গর্ভবতী ও প্রসূতি মা, চাকরিজীবী মহিলারা এই জাতীয় সমস্যায় বেশি ভোগেন এবং ওপেন পোরের শিকার হন। অনেকে জন্মগতভাবে হরমোন ও জিনের সমস্যায় ভোগেন তাই তাদের পোর সবসময় বড় দেখায় সঠিক যত্ন নেয়ার পরেও।
- অতিরিক্ত সিবাম ক্ষরণ। লোমকূপের ঠিক নিচেই থাকে সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড, সেখান থেকে উৎপাদিত তেল ত্বকে উঠে আসে এবং ত্বককে ময়েশ্চারাইজড রাখে। প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত তেল বেরিয়ে আসলে তৈলাক্ত ত্বক আরো তেলতেলে হয় এবং পোরগুলো বড় দেখায়। এছাড়াও ডেড স্কিন সেলস জমে পোর বড় দেখায়।
- যখন ত্বকে সিবাম নিঃসরণ বেশি হয়, তখন বাইরের ধুলাবালি ইত্যাদি খুব সহজে মুখে আটকে যায়। তখন দুয়ে মিলে লোমকূপে ব্লকেজের সৃষ্টি করে। এই ব্লকেজের কারণে ত্বকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয় এবং লোমকূপের উপর প্রেসার তৈরি হয় ও বেড়ে যায়।
- হেয়ার ফলিকলের ভলিউম বৃদ্ধি। মুখের লোমের ফলিকল মোটা হতে শুরু করলে লোমকূপ বড় হয়।
- বয়সের কারণেও লোমকূপ বেড়ে যায়। আমাদের ত্বক ন্যাচারালি কোষ পুনর্গঠন করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই ক্ষমতা কমে যায়। ত্বকের টিস্যু তখন ঢিলে হতে শুরু করে এবং লোমকূপ আকারে বড় হয়ে যায়।
- সূর্যের আলোর নিচে বেশিক্ষণ থাকলে ত্বকের কোলাজেন তৈরির হার কমে যায় এবং লোমকূপ আয়তনে বড় হয়ে যায়।
প্রসারিত লোমকূপ সংকুচিত করে আগের অবস্থায় আনাটা কিন্তু বেশি কঠিন না। কয়েকটি টিপস মেনে চললেই বেড়ে যাওয়া পোর ঠিক করা সম্ভব। এবারে বিস্তারিত জানব সেই সম্পর্কে।
১. ত্বক সবসময় পরিষ্কার রাখুন
- প্রতিদিন দুইবেলা মুখ পরিষ্কার রাখা হচ্ছে বেসিক স্কিন কেয়ার এবং এটি লোমকূপ ঠিক রাখতে সবচেয়ে কার্যকরী। সকালে ও রাতে ক্লিনজার দিয়ে মুখ ধুয়ে নিবেন, হেভি ওয়ার্কআউট বা খেলাধুলার পরেও। যদি দুইবেলা ক্লিনজিং সম্ভব না হয়, তাহলে শুধু রাতে ক্লিনজার ব্যবহার করবেন। কারণ রাতে আমাদের স্কিন গভীর থেকে হিল করে, তাই ঘুমের আগে ক্লিনজিং করা জরুরি।
- মুখ ধোয়ার জন্য কুসুম গরম পানি ব্যবহার করলে ভালো ফল পাবেন। আর ক্লিনজারটা হতে হবে জেন্টেল এবং অ্যালকোহলমুক্ত। কখনোই জোরে জোরে মুখ ঘষবেন না, আলতো হাতে ক্লিনজিং করবেন। এমনকি মুখ ধোয়ার পরেও আলতো করে চেপে চেপে মুখ মুছবেন। নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার করলে পোরের তেল-ময়লা পরিষ্কার হয় এবং পোর বড় দেখায় না।
- রাতে ঘুমানোর আগে মেকআপ ঠিকমতো না তুললে সেগুলোই জমে লোমকূপ ব্লক করে দেয়। তাই অবশ্যই মেকআপ তুলে নিবেন। চটজলদি মেকআপ তোলার জন্য ক্লিনজিং ওয়াইপস ব্যবহার করতে পারেন।
২. সঠিক প্রসাধনী বাছাই করুন
- তৈলাক্ত ত্বকের জন্য সঠিক প্রসাধনী ব্যবহার করলে ওপেন পোরের সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা যায়। ময়েশ্চারাইজার এবং মেকআপ কিট যেন ওয়াটার-বেইজড হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আর ক্লিনজারটা হতে হবে জেল-বেইজড। এগুলো অতিরিক্ত সেবাম ক্ষরণ কমায় এবং লোমকূপের স্বাভাবিক আকার নিশ্চিত করে।
- অয়েল-বেইজড প্রোডাক্টের মূল উপাদান তেল বিধায় সেগুলো তৈলাক্ত ত্বক আর লার্জ পোরের জন্য ক্ষতিকর। আর অ্যালকোহল-বেইজড ক্লিনজার ব্যবহারে ত্বকের তৈলাক্ততা বাড়িয়ে দেয়। এসব কারণে ত্বকের ন্যাচারাল তেলের সাথে বাড়তি তেল জমে লোমকূপের উপর চাপ পড়ে এবং অতিরিক্ত বড় হয়ে যায়। তাই অয়েল-বেইজড মেকআপ প্রোডাক্ট পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন।
রেটিনয়েড ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন লোমকূপের সমস্যা দূর করার জন্য। এই ক্রিম ত্বকের কোষগুলোর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে, বড় হয়ে যাওয়া পোরগুলোকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো কয়েক সপ্তাহ ব্যবহার করলেই পার্থক্য টের পাবেন।
৩. ব্যবহার করুন ন্যাচারাল প্রোডাক্ট
- ধুলাবালি, মেকআপ, অতিরিক্ত সিবাম, ডেড স্কিন সেল ইত্যাদি জমে পোর ক্লগড হয়ে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বড় দেখায়৷ এসব পরিষ্কার করার জন্য ভালো মানের এক্সফোলিয়েটর ব্যবহার করতে হবে। গ্লাইকোলিক অ্যাসিড, বেটা হাইড্রক্সি অ্যাসিড, পলিহাইড্রক্সি অ্যাসিড, অথবা ম্যান্ডেলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ এক্সফোলিয়েটর দেখে কিনবেন।
- এছাড়াও ঘরোয়া অনেক উপাদান আছে যা দিয়ে ত্বককে ন্যাচারালি ডিপ ক্লিন এবং ওপেন পোরগুলো টাইট করা সম্ভব। তবে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে এক্সফোলিয়েট করলে সপ্তাহে দুইবারের বেশি করবেন না। প্রতিদিন করলে ত্বক ড্রাই হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি।
- মেকআপ করার পরিষ্কার ত্বকে বরফের টুকরা ঘষে নিলে লার্জ পোরগুলো সংকুচিত হয়, ত্বক টানটান হয়, এবং রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। তোয়ালেতে বরফের টুকরা পেঁচিয়ে মুখে ঘষবেন অথবা সরাসরিই বরফ ঘষে নিবেন। চাইলে বরফ ঠান্ডা পানিতেও মুখ ধুয়ে নিতে পারেন।
- ২ চা চামচ পানিতে ১ চা চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে নিন। এরপরে এতে তুলা ভিজিয়ে মুখে লাগিয়ে ৫-১০ মিনিট রেখে দিন। তারপরে মুখ ধুয়ে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন। ভিনেগারে থাকা অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান অ্যাকনের প্রকোপ কমায়, ত্বকের পিএইচ ব্যালেন্স ঠিক রাখে, এবং বেড়ে যাওয়া পোর বন্ধ করে দেয়।
- সপ্তাহে দুইবার ডিমের সাদা অংশের মাস্ক ব্যবহারে স্কিন টাইট হয়, যার কারণে প্রসারিত লোমকূপ সংকুচিত হয়ে আসে। এর পাশাপাশি ত্বকের অতিরিক্ত তৈলাক্ততাও কমে আসে। ডিমের সাদা অংশ আলাদা করে ভালো করে ফেটিয়ে নিন। ফেটানো অংশ পুরো মুখে সমান করে লাগিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলুন। শুকিয়ে আসলে পিল-অফ করুন এবং ধুয়ে ফেলুন।
- ত্বককে এক্সফোলিয়েট করার জন্য চিনির জুড়ি নেই। চিনি লোমকূপ থেকে তেল ও ময়লা পরিষ্কার করে। এক টুকরা লেবু কেটে উপরে এক চিমটি চিনি ছড়িয়ে পুরো মুখে ঘষে নিন। ১৫ মিনিট পরে পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
- চিনির মতো বেকিং সোডাও পিএইচ লেভেল ঠিক রেখে পিম্পল ও অ্যাকনে কমায়। ২ টেবিল চামচ কুসুম গরম পানিতে ২ টেবিল চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে মুখে সার্কুলার মোশনে মাসাজ করে নিন। ৫ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিন-চারবার করলে অল্পদিনেই লোমকূপ টাইট হয়ে আসবে।
- পরিমাণমতো মুলতানি মাটি ১ চা চামচ গোলাপজলে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। মুখে সমান করে লাগিয়ে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। শুকিয়ে গেলে হালকা পানির সাহায্যে সার্কুলার মোশনে স্ক্রাব করে তুলে ফেলুন। সবশেষে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলুন। মুলতানি মাটি অয়েলি স্কিনের জন্য ভালো।
- ১ টেবিল চামচ টমেটোর রসে ৩-৪ ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে স্কিনে অ্যাপ্লাই করুন। ২০ মিনিট পরে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে নিন। লাইকোপেন, অ্যাস্ট্রিনজেন্ট, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর টমেটো সেবাম এবং লার্জ পোর নিয়ন্ত্রণ করে, স্কিনকে টাইট রাখে, এবং অকালে বুড়িয়ে যাওয়া থেকে আটকায়।
৪. ময়েশ্চারাইজ করুন
- অয়েলি স্কিন এবং কম্বিনেশন স্কিনের নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে লার্জ পোরের সমস্যা কমে যায়। এটি স্কিনকে হাইড্রেটেড রাখে এবং মসৃণ রাখে। এটি সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড থেকে উৎপাদিত তেলকে লোমকূপের উপর জমতে না দিয়ে ত্বকের গভীরে যেতে সাহায্য করে। তাই পোর বড় দেখায় না।
- অয়েল-বেইজড ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারে স্কিন ইনস্ট্যান্টলি হাইড্রেটেড হলেও সেটা স্কিনে জমে থাকে। তাই প্ল্যান্ট-বেইজড বা ওয়াটার-বেইজড ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। ভালো হয় যদি লাইট ময়েশ্চারাইজার হিসেবে হারবাল ফেসিয়াল অয়েল ব্যবহার করেন। এর উপাদান ক্লগিং ঠেকায় এবং হাইড্রেট করে।
৫. সানস্ক্রিন এড়িয়েছেন তো মরেছেন!
- হ্যাঁ, সানস্ক্রিন ত্বকের লোমকূপ ঠিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি ত্বকের কোলাজেন ও ইলাস্টিন ভেঙে দেয়। ফলে ত্বকের স্বাভাবিক টাইটনেস হারিয়ে যায় এবং পোর বড় হয়ে যায়। আবার রোদের কারণে ত্বক শুষ্ক হয়েও পোর বড় হয়ে যায়। তাই বাইরে বেরোনোর আগে সানস্ক্রিন মাখতে ভুলবেন না যেন।
- সানস্ক্রিন কেনার আগে SPF এর মাত্রা দেখে কিনবেন, সর্বনিম্ন ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ থাকতে হবে। জিঙ্ক অক্সাইড সমৃদ্ধ সানস্ক্রিন সব ঋতুতে ব্যবহারের উপযোগী। অনেক ময়েশ্চারাইজারে সানস্ক্রিন থাকে। না থাকলে আলাদা করে সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করে নিবেন। মেকআপ করার জন্য SPF যুক্ত প্রাইমার বা ফাউন্ডেশন ব্যবহার করবেন।
- শুধু সানস্ক্রিন যথেষ্ট না, বাইরে বের হলে ছাতা ও বড় হ্যাট ব্যবহার করবেন যাতে মুখ সহ শরীরের অনাবৃত অংশ কিছুটা রক্ষা হয়। কড়া রোদে বাইরে কম বের হবার চেষ্টা করবেন এবং সবসময় ছায়ায় থাকার চেষ্টা করবেন।
৬. বদঅভ্যাস পরিহার করুন, সুঅভ্যাস গড়ে তুলুন
- কিছু বদঅভ্যাস লোমকূপ বড় করার জন্য দায়ী, যেমন নখ দিয়ে ব্রণ খোঁটা। ব্রণ একটু শক্ত হলে বা পাকা শুরু করলে আমরা অনেকেই সেটা খুঁটে বের করার চেষ্টা করি। এটা করতে হয়তো মজা লাগে কিন্তু যখন ভিতরের ময়লাটা বের হয়ে যায়, তখন সেই স্থানের লোমকূপ বড় হয়ে যায়। তাই নখ দিয়ে ব্রণ খোঁটার বদঅভ্যাস ত্যাগ করুন, অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে।
- সেই সাথে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস পালনের চেষ্টা করুন, যেমন পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান, সঠিক ঘুম ইত্যাদি। প্রতিদিন ৭-৮ গ্লাস পানি খেলে রক্ত পরিষ্কার তো হবেই, সাথে ত্বকের কোষ গুলোর পানির প্রয়োজনীয়তা পূরণ হবে। এতে করে লোমকূপের মধ্যকার গ্যাপ কমে যাবে, আর সেগুলো বড়ও দেখাবেনা।