কলকাতা

কেমন হল ছবি ট্যাংরা ব্লুজ রইলো রিভিউ

কিছুদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে ছবি ‘ট্যাংরা ব্লুজ’। পরিচালনায় ছিলেন সুপ্রিয় সেন। মুখ্য ভূমিকায় মধুমিতা সরকার জয়ীর ভূমিকায় ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় সঞ্জীব মণ্ডলের ভূমিকায়। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সামিউল আলম সহ ছিল আরও অনেক নতুন মুখ। ছবি মুক্তির আগেই ছবির গান, ট্রেলার বেশ সাড়া ফেলেছিল দর্শক মহলে। কিন্তু মুক্তির পর কতটা সাড়া জাগাতে পারলো ট্যাংরা ব্লুজ?

যদিও অনেকেই ছবি দেখেছেন ছবির গল্প জানেন। আবার অনেকেই এখনো দেখেননি কিন্তু তারাও গল্প আন্দাজ করতে পারছেন। তাও ছবির গল্প নিয়ে আলাদা করে বলতেই হচ্ছে। কারণ এইধরনের গল্প নিয়ে আগে কখনো কাজ হয়নি।  পাশাপাশি ছবির চিত্রনাট্যও যথেষ্ট শক্তিশালী যেটা ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি দর্শককে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করে। অতি সহজ সাবলীলভাবে আমাদের চারপাশের সমাজের বেশ কিছু দিক তুলে ধরেছেন পরিচালক যেগুলো একই শহরে থেকেও আমরা খবর রাখি না।

 এক অন্য কলকাতা

কলকাতা শহরের ঝাঁ চকচকে অ্যাপার্টমেন্ট, শপিংমল, ফ্ল্যাট জীবনের পাশাপাশি আরও একটা জীবন বসবাস করে। যেটা আমাদের চোখে পড়ে না বললেই চলে। এইসমস্ত বড় বড় বাড়িগুলোর পাশে বা একটু দূরেই বাস করে এক অন্য কলকাতা। তারা কলকাতায় থাকলেও এই ঝাঁ চকচকে শহুরে জীবন থেকে বরাবরই আলাদা।

শহরের জঞ্জাল ফেলা হয় এই জায়গাগুলোতে। নোংরার সাথে সাথে জমা হয় নানান ক্ষোভ, না পাওয়ার চিৎকারও। কারণ এদের সমাজ আলাদা করে রাখে। আলাদা চোখে দেখে। আর এখান থেকেই উঠে আসেন সঞ্জয় মণ্ডলের মত মানুষেরা। যারা এদের মধ্যে থেকেই খুঁজে বার করেন চাপা পড়ে থাকা প্রতিভাদের। চাপা পড়ে থাকা স্বপ্নগুলোকে।    

অলিগলির না জানা গল্প

ছবিতেও দেখানো হয়েছে কলকাতার সেরকমই এক বস্তি জীবনের কথা।  ছবিতে গল্পের প্রেক্ষাপট হল কলকাতার ট্যাংরা বস্তি। যেখানে সঞ্জয় মণ্ডল নামে একজন সেই বস্তির কিছু ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা আলাদা কিছু করার চেষ্টা করেন। তাদের নিয়ে শুরু করেন একটি গানের দল। ১০ বছর আগে সেই দল শুরু হয়। তবে গানের দলে যে ধরণের আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকে সেগুলো জোগাড় করা কঠিন হলেও থেমে থাকেনি ওরা, তাই টিনের কৌটো, ড্রাম, লাঠি, বাসনপত্র ইত্যাদি দিয়ে বানিয়ে নেয় নানান বাজনা।

এইভাবেই চলতে থাকে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার লড়াই। কিছু আলাদা করে দেখাবার লড়াই। ২০১০ সালে এই দলটি ইন্ডিয়াস গট ট্যালেন্ট শোয়ে অংশগ্রহণ করে এবং রানার্স আপ হয়। এইটুকুর সাথেই বাস্তবের মিল আছে বাকিটা তৈরি করা হয়েছে। সঞ্জয় মণ্ডল এবং তার দল থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি এই ছবি। যদিয় ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ কিন্তু সঞ্জয় মণ্ডলের বায়পিক নয়। সেইজন্যই গল্পে প্রধান চরিত্রের নাম বদলে সঞ্জীব মণ্ডল রাখা হয়েছে। কিন্তু এই ছবির প্রধান উৎস সঞ্জয় মণ্ডলই। সঞ্জীব মণ্ডল চরিত্রটি তাকেই অনুসরণ করেছে।

জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক সুপ্রিয় সেন খুব সুন্দরভাবেই বাস্তবকে তুলে ধরেছেন। অন্ধকার জগতকে তুলে ধরতে গিয়ে, খুব বেশী নাটকীয় কিছু দেখানো হয়নি। বরং আশপাশের বাস্তব জগতটা যেমন ঠিক তেমনটাই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তুলে এনেছেন বস্তি জীবনের চাপা পড়ে থাকা অলিগলির গল্প। যে গল্পগুলোর সাথে শহুরে মানুষ খুব একটা অভ্যস্ত নন। সেই গল্পগুলো সকলের সামনে আনার যথেষ্ট দরকার ছিল।

ভেঙে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়ানো

চালু ট্যাংরার বস্তি অঞ্চলে থাকে। একদিকে সে পাশের বহুতলের ময়লা কুড়নোর কাজ করে আবার অন্যদিকে সে কবিতা বানায় গান বানায়। তার সাথেই রয়েছে আরও কয়েকজন। যাদের নিয়ে সঞ্জীব মণ্ডল করেছেন একটি গানের দল। ১০ বছর আগেই শুরু হয় এই দল। কিন্তু ভেঙে যায় তার দল। সঞ্জীবকে ছেড়ে চলে যায় তার দলের সদস্যরা। সাথে সঞ্জীবের পিছু ছাড়েনা তার এক অন্ধকার অতীত। কিন্তু আবার চালুর মত ট্যালেন্টদের নিয়ে আবার দলকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে সে। আবারও এগিয়ে যেতে চায়।  

এরমাঝেই এসে পরে জয়ী। যে মুম্বাইয়ের সঙ্গীত পরিচালক। সে গান তো ভালোবাসেই সাথে নতুন নতুন ট্যালেন্টের খোঁজেও থাকে সে। চালুদের সাথে পরিচয় হতেই সে বেশ উৎসাহিত হয়ে পরে। চালুদের মত ট্যালেন্টদের সমাজে একটা আলাদা পরিচয় গড়ে তুলতে সে পাশে দাঁড়ায় দলের। তাদের প্রচারের আলোয় আনতে চায় সে। দশ বছরের আগের গানগুলিকে নতুন রূপ দিতে চায় জয়ী। সেই গানে নতুন প্রান আনতে চায়। কিন্তু সেটা পছন্দ হয়না সঞ্জীবের। এইভাবেই এগোতে থাকে গল্প। এবং শেষে আবারও তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জার্নিটা সকলকে অনুপ্রেরণা যোগায় নতুন কিছু করার।

সাবলীল অভিনয়

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় নিয়ে আশা ছিলই। তার অভিনয় দক্ষতা দর্শক জানে। অন্যদিকে চিনি দেখার পর মধুমিতা সরকারের থেকে আবারও যে ভালো কিছু পাওয়া যাবে সে আশা দর্শকের ছিল। এবং পূরণও হয়েছে। এদের সাথে অভিনয়ে সামঞ্জস্য রেখেছে সামিউল, ঐশানী সহ একঝাঁক নতুন মুখ। বিশেষ করে সামিউলের কথা আলাদা করে বলতেই হচ্ছে। তার অভিনয় বেশ পরিণত হয়েছে। তার ডায়লগ বলার ভঙ্গিমা, তাকানো সবই নজর কেড়েছে সকলের। অভিনয়ে প্রতেকেই নিজের জেয়গায় একদম ঠিক ভাবে সকলের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখেছে। কারুর অভিনয় অতি নাটকীয় নয়। সেই জন্যই বোধয় আরও নজর কেড়েছে দর্শকের।

নজর কেড়েছে গান

চিত্রনাট্য, অভিনয় ছাড়াও আলাদা করে যেটা না বললেই নয়, তা হল এ ছবির গান। অসাধারণ কাজ করেছেন নবারুণ বসু বলতেই হচ্ছে। কারণ মুক্তির আগেই ছবির গান যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। বাংলা র‍্যাপকে দারুণভাবে বাস্তবের মোড়কে পরিবেশন করে যথেষ্ট সফল হয়েছেন তিনি। ‘এই তো আমার দেশ’ কিংবা ‘বাপুরাম সাপুড়ে’ মনে দাগ কেটেছে। অন্যান্য গানগুলিও বেশ ভালো।

এছাড়াও ভীষণ ভালো কাজ করেছে রঞ্জন পালিতের ক্যামেরাও। পরিবেশ ঘটনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ক্যামেরার আলোর কাজ খুব ভালো। ঘটনা অনুযায়ী কখনো আলো আঁধার, কখনো কালো, আবার কখনো উজ্জ্বল রঙ বেশ লেগেছে। অন্যদিকে ক্লোজআপে ক্যামেরা ব্যবহার করে চরিত্রগুলিকে বেশ জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি। সঙ্গে শার্প এডিটিং পর্দায় চোখ রাখতে বাধ্য করে।

পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়, ভালো কনটেন্ট, অভিনয়, গান এসব দিয়েও একটা ছবি দিব্যি বাজিমাত করতে পারে কোন সুপারস্টার ছাড়াই। ট্যাংরা ব্লুজ তারই প্রমান। সমাজ শহরের যে বিষয়গুলো সবাই দেখেও দেখে না, এই ছবি সেই বাস্তব, সেই সত্য গুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছে।  পরিচালক সহ পুরো টিমের এই চেষ্টার জন্য একবার দেখা উচিৎ এই ছবি। কুর্নিশ জানাই সেই চেষ্টাকে এবং এরম ছবি আরও আরও হোক।  

সুস্মিতা দাস ঘোষ

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 বছর ago