আমাদের সনাতন ধর্মে বারো মাসে তেরো পার্বণ আর এই সকল পার্বণের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় পার্বণটি হলো দুর্গোৎসব। দুর্গাপুজোকে নিয়ে মানুষের তাই উৎসাহের শেষ নেই। ঢাকে কাঠি পরার পর থেকে বিসর্জনের আগের মুহূর্ত অবধি বাঙালির মধ্যে যেন এক উন্মাদনা কাজ করে।
এইসবের মধ্যে আবার দুর্গাপুজোর একাধিক নিয়ম কানুন, রীতিনীতি জড়িয়ে থাকে, যেগুলি পালন করার সাথে ঘর-সংসারের মঙ্গল ও চিরাচরিত ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকে। দুর্গাপুজোর এরকমই একটি আবশ্যিক রীতি হলো ১০৮ টি পদ্ম দিয়ে সন্ধি পুজা। ১০৮ পদ্ম ছাড়া সন্ধিপুজোর কথা ভাবাই যায় না। কিন্তু কেন দুর্গা পুজোতে এই পদ্মফুলের এত গুরুত্ব?
দুর্গাপুজোতে পদ্মফুলের কেন এত গুরুত্ব তা জানতে গেলে আমাদের রামায়ণের যুগে ফিরে যেতে হবে। আগে দুর্গাপূজা হতো বসন্তকালে, তাই দেবী দুর্গাকে বাসন্তী বলা হয়।
রাম রাবণের যুদ্ধের সময় রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করার জন্য রামকে দেবী দুর্গার পুজো করতে বলা হয়, কারণ রাবনের লঙ্কাপুরী ভদ্রকালীর আশীর্বাদ প্রাপ্ত ছিলো যার ফলে দেবীর আশীর্বাদ ভিন্ন কেউই রাবনকে পরাজিত করতে পারতেন না, তাই রাবনকে পরাজিত করার জন্য শ্রীরামের দেবী দুর্গার আশীর্বাদের প্রয়োজন ছিলো কিন্তু তখন সময়টা ছিলো শরৎকাল, শরৎকালে দেবী দুর্গার পুজো হত না, তাই শ্রীরাম অকালবোধন করলেন।
রাবনকে ধ্বংস করার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করলেন তিনি। দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিভীষণ তখন শ্রীরামকে পরামর্শ দিলেন যে ১০৮ টি নীল পদ্ম দিয়ে দেবীর পুজো করতে।
রামের আদেশে তখনই হনুমান দেবীদহে ছুটলো নীল পদ্ম সংগ্রহ করার জন্য। দেবীদহে গিয়ে হনুমান ১০৭টি পদ্ম পেয়েছিলেন। একটি পদ্ম পাননি এই ১ টি পদ্ম সম্পর্কে ও কাহিনী আছে, বলা হয় ১০৮ নং পদ্মটি স্বয়ং দেবী হরণ করেছিলেন। কারণ সেই পদ্মটি ছিলো দেবাদিদেব মহাদেবের অশ্রু।
হ্যাঁ দীর্ঘদিন ধরে অসুর নিধন যঞ্জে দেবী দুর্গার ক্ষতবিক্ষত দেহে অসহ্য জ্বালা সৃষ্টি হয়। কারণ মায়ের শ্রী অঙ্গে ১০৮ টি স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিলো। দেবীর শ্রী অঙ্গের সেই জ্বালা দেখে দেবাদিদেব মহাদেব কাতর হন। তিনি দেবীকে বলেন তার অঙ্গের জ্বালা কমানোর জন্য দেবীদহে স্নান করতে। তারপর দেবী দেবীদহে স্নান করেন।
দেবীদেহে মায়ের অবতরণের পর ১০৭ টি ক্ষত থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ১০৭টি পদ্মের। দেবীর এই অসহ্য জ্বালা সহ্য করতে না পারায় মহাদেবের চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু নিক্ষিপ্ত হয় মায়ের একশো আটতম ক্ষতের ওপর। দেবীদহে স্নানের সময় সেই অশ্রুসিক্ত ক্ষতটির থেকেই ১০৮ তম পদ্মের সৃষ্টি হয়েছিল। স্বামীর অশ্রুসিক্ত পদ্মফুলটি দেবী মা কেমন ভাবে নিজের চরণে নিতেন? তাই সেটি দেবী নিজেই হরণ করেছিলেন।
হনুমান পদ্ম আনার পর যখন শ্রী রাম পুজো করতে শুরু করলেন তখন শ্রী রাম দেখলেন যে একটি পদ্ম নেই। তখন রাম তার নীল পদ্মের মতো চোখ দুটির মধ্যে একটি উৎপাটিত করে দেবীর চরণে দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দেবী তখন স্বয়ং আবির্ভূত হন ও শ্রী রামকে এই কার্য করা থেকে বিরত করেন ও জানান যে, শ্রীরামের পুজোয় তিনি সন্তুষ্ট।
এরপর দেবী শ্রীরামচন্দ্রকে বরদান করেন যে, রাবনের লঙ্কা পুরী থেকে ও রাবণের থেকে তিনি নিজের সুরক্ষা বলয় সরিয়ে নেবো। কৃত্তিবাসের রামায়ণে লেখা আছে যে, রাবণ নিধনযজ্ঞের আগে দেবীকে তুষ্ট করতে রামচন্দ্র বলেছিলেন, “যুগল নয়ন ফুল্ল নীলোৎপল। সংকল্প করিব পূর্ণ বুঝিয়ে সকল।। এক চক্ষু দিবো আমি দেবীর চরণে।” এই বলে রাম ধনুর্বান নিয়ে নিজের নীলোৎপল সদৃশ একটি চোখ উৎপাটন করতে উদ্যত হলে দেবী স্বয়ং রামচন্দ্রের সম্মুখে আবির্ভূতা হয়ে হাত ধরে তাকে নিবৃত করে বলেন,“অকাল বোধনে পূজা কৈলে তুমি, দশভুজা বিধিমতে করিলা বিন্যাস। লোকে জানাবার জন্য আমারে করিতে ধন্য অবনীতে করিলে প্রকাশ।। রাবণে ছাড়িনু আমি, বিনাশ করহ তুমি, এত বলি হৈলা অন্তর্ধান”
রাম দেবীর পুজো করেছিলেন ষষ্ঠীতে, অষ্টমী নবমী তিথির মাঝে রামের অস্ত্রে দেবী প্রবেশ করলেন স্বয়ং এবং দশমীর দিন সেই অস্ত্র দ্বারাই রাবন বধ হয় অর্থাৎ অশুভ শক্তির বিনাশ হয় ও শুভশক্তির যাত্রা সূচিত হয়।
১০৮ টি পদ্ম দিয়ে পুজো করেই শ্রীরাম দেবীকে তুষ্ট করেছিলেন তাই সনাতন ধর্মে দেবীর পুজোয় ১০৮টি পদ্মের এত গুরুত্ব। ১০৮টি পদ্ম সন্ধি পূজার সময় শুদ্ধচিত্তে দেবীর পায়ে নিবেদন করলে মহা পুণ্য ফল লাভ হয় ও মনোবাসনা পূরণ হয়,সেইসাথে দেবী দুষ্টের দমন করবার শক্তি দিয়ে থাকেন।
দুর্গাপুজোয় ষষ্ঠী,সপ্তমী,অষ্টমী,নবমী প্রতিদিনই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেবীর আরাধনা করা হয় তবে সন্ধিপুজো হল দুর্গা পুজোর মধ্যে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট মিলিয়ে যে ৪৮ মিনিট হয়, সেটাই হলো সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিপুজো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, বলা হয় অষ্টমীর সন্ধিপুজো নিয়ম মেনে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা সহকারে করলে সারা বছরের দূর্গা পূজার ফলপ্রাপ্তি হয়।
অর্থাৎ অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় যে ব্যক্তি উপোস করে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন দেবী দুর্গার আশীর্বাদ সব সময় তার মাথার উপর থাকে দেবী দুর্গার কৃপায় কোনো শত্রু তার কোন ক্ষতি করতে পারে না, তার জীবনে বিপদ-আপদ এলেও দেবীর কৃপায় তা দেখতে দেখতেই কেটে যায়, শত্রু তার ক্ষতি করার চেষ্টা করলেও সে চির নিরাপদ থাকে ও তার সংসার সুখ ও শান্তিতে ভরে ওঠে।
পুরাণে বলা হয় যে, দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধে সংগ্রাম রত অবস্থায় ছিলেন তখন মহিষাসুরের ২ জন সেনা চন্ড ও মুন্ড এসে দেবীকে আক্রমণ করে তখন দেবী দুর্গার তৃতীয় নয়ন থেকে একজন দেবীর আবির্ভাব হয় তার নাম দেবী চামুন্ডা। এই দেবী চন্ড মুন্ডকে বধ করেন। সন্ধিক্ষণে ১০৮ পদ্ম ও ১০৮ নীল প্রদীপ দিয়ে এই দেবী চামুন্ডারই আরাধনা করা হয়।
এখন দেবী দুর্গার পুজোই পদ্ম ফুলেরই কেন এত গুরুত্ব এই প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো পদ্ম আসলে প্রতীকস্বরূপ। পদ্ম পবিত্রতার প্রতীক। পাঁকের মধ্যে জন্মগ্রহণ করার পরেও পদ্ম ফুলের গায়ে পাকের দাগ থাকেনা। আসলে পদ্ম ফুল পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নয় অন্তরের সৌন্দর্যের কথা বলে, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়া সত্ত্বেও অন্তর যদি নির্মল হয় তাহলে সেই ব্যক্তি যে দেবী পুজোর জন্য উপযুক্ত এই কথায় বোঝানো হয় পদ্মফুলের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে দিয়ে।
ঠিক যেমন ভাবে কাদায় জন্মগ্রহণ করার পরেও নিজের শরীরে কাদা না লাগিয়ে পদ্ম বেড়ে ওঠে ঠিক তেমনভাবেই এই ফুল মানুষকে শিক্ষা দেয় যে সংসারের আবর্জনার মধ্যে থেকেও সংসারের আবর্জনার অতলে তলিয়ে না গিয়ে সুন্দর ভাবে বিকশিত হতে হবে। অন্তর থেকে সুন্দর হতে হবে কোনরকম কাদা লাগানো চলবে না অন্তরে, পরিবেশ ময়লা ক্ষতি নেই, অন্তর যেন সব সময় কোমল ও স্বচ্ছ থাকে। পদ্ম ফুল এমনই শিক্ষা দেয় সংসারকে, মলিনাতার মধ্যেও স্বচ্ছতার শিক্ষা দেয় সে,তাই দেবীর পুজোয় পদ্মের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্মে ১০৮ সংখ্যাটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ১০৮ দ্বারা ব্রহ্মকে নির্দেশ করে। হ্যাঁ ব্রহ্ম শব্দটি ভাঙলে হয় ব+র+হ+ম। এখন এই ব শব্দটি বাংলা অক্ষর মালার ২৩ তম শব্দ। এইভাবে যদি প্রত্যেকটি শব্দকে বিচার করা যায় তাহলে ব+র+হ+ম=২৩+২৭+৩৩+২৫=১০৮ হয়। আবার প্রাচীন কালের সংস্কৃত ভাষায় প্রতিটি বর্ণের পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ বর্তমান অর্থাৎ ৫৪*২=১০৮ হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বর্ণের পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ অর্থাৎ শিব ও শক্তিকে বোঝায়।
আবার আমাদের হিন্দু ধর্মের যে পঞ্চ দেবদেবীর শাস্ত্রানুসারে সবার আগে পুজো হয় অর্থাৎ গণেশ, বিষ্ণু, শিব, কৌশিকী বা চন্ডী এবং সূর্য তাদের প্রত্যেকেরই ১০৮ টি নাম। তাই ১০৮ দিয়ে যেমন ব্রহ্মকে সূচিত করা যায় তেমনই শিব শক্তিকে বোঝানো যায়, তেমনি পঞ্চ দেবদেবীকে বোঝানো যায় আবার এই ১০৮ শব্দ দ্বারা সময়কেও নির্দেশ করা হয়। কারণ প্রাচীন মুহূর্ত শাস্ত্র অনুযায়ী, সময় ১০৮ ভাগে বিভাজিত, (৩৬- অতীত ৩৬-বর্তমান ৩৬-ভবিষ্যৎ)। আবার আয়ুর্বেদ ও যোগ শাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের শরীরে ১০৮ টি পথ ধরেই চালিকাশক্তি এসে হৃৎপিণ্ড কে সচল রাখে। তাই সনাতন হিন্দু ধর্মে ১০৮ অর্থে সমগ্রতাকে বোঝায়।
আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…
পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…
আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…
বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…
ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…
প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…