গৃহ ও জীবনযাপন

মাকড়শার উপদ্রব! ঘর থেকে মাকড়শা তাড়ানোর সহজ উপায়

প্রতি সপ্তাহে বা মাসে একবার সারা বাড়ি পরিষ্কার করতে গেলে ধুলাবালি ও ঝুলের সাথে মাকড়শার জালও দেখতে পাওয়া যায়৷ মাকড়শা আমরা কমবেশি সবাই ভয় পাই, কিন্তু বাড়িতে থাকা ‘হাউজ স্পাইডার’কে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। এগুলো আকারে ছোট, খুবই নিরীহ স্বভাবের হয়, এবং এরা কোন ধরণের বিষ বা জীবাণু ছড়ায় না। মজার ব্যাপার হল, হাউজ স্পাইডার হচ্ছে প্রাকৃতিক কীটনাশক।

এরা আপনাকে আক্রমণ তো করবেই না, বরং আপনার ঘরে এবং বাগানে থাকা ক্ষতিকারক পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ খেয়ে ফেলে। এদিক থেকে হাউজ স্পাইডার অবশ্যই বাহবা পাওয়ার যোগ্য। এছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশ ও আবহাওয়া থেকে বাঁচার জন্যও মাকড়শা বসতবাড়িতে বাসা বাঁধে। বাসস্থানে এই উপকারী প্রাণীটির উপস্থিতি যদি সহ্যসীমার বাইরে চলে যায়, তখনই সমস্যা দেখা দেয়।

ঘর থেকে মাকড়শা তাড়ানোর সহজ উপায় হচ্ছে ঘরে পোকামাকড়ের আমদানি কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা৷ বাড়িতে পোকামাকড়ের আনাগোনা থাকলেই মাকড়শা সেগুলোকে খাওয়ার জন্য চলে আসবে। তাই পোকামাকড় ঠেকাতে পারলে মাকড়শাকেও ঠেকানো যাবে। আজকে কথা বলবো বাড়িতে মাকড়শার উপদ্রব কমানোর সহজ কিছু উপায় নিয়ে৷

১. ভিনেগার

ভিনেগার বিশেষভাবে মাকড়শার উপদ্রব কমানোর জন্য খুবই কার্যকরী। এতে আছে অ্যাসিটিক অ্যাসিড, যার টক স্বাদ ও গন্ধ মাকড়শা সহ্য করতে পারে না৷ ১ কাপ স্বচ্ছ ভিনেগারের সাথে ১ কাপ পানি মিশিয়ে স্প্রে করা যায় এমন বোতলে ঢেলে নিন। এবার এই মিশ্রণ ঘরের যেসব জায়গায় মাকড়শার ঝুল আছে সেখানে স্প্রে করে দিন।
যেখান দিয়ে ঘরে পোকামাকড় বেশি ঢোকে সেখানে বেশি করে স্প্রে করবেন, কারণ পোকামাকড়ের প্রবেশ আটকাতে পারলে মাকড়শার আগমনও ঠেকানো যাবে। এছাড়াও ভিনেগার ক্লিনিং এজেন্ট হিসেবেও ব্যবহার করে রান্নাঘর ও বাথরুম পরিষ্কার করতে পারবেন। ঘরও পরিষ্কার হলো, মাকড়শা ও কমে গেলো।

২. এসেনশিয়াল অয়েল

তীব্র সুগন্ধযুক্ত তেল মাকড়শা একেবারেই পছন্দ করে না। কাজেই এসেনশিয়াল অয়েল হতে পারে ঘর থেকে মাকড়শা তাড়ানোর একটি মোক্ষম অস্ত্র। পিপারমিন্ট অয়েল, টি ট্রি অয়েল, ল্যাভেন্ডার বা রোজ এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। ১ কাপ পানির সাথে ১৫-২০ ফোঁটা যেকোন একটি এসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে স্প্রে বোতলে ভরে নিন এবং সারা ঘরে স্প্রে করুন।

এসেনশিয়াল অয়েল শুধু মাকড়শার উপদ্রব কমাবে না, তার সাথে আপনার ঘরকেও সুগন্ধে ভরে রাখবে। একেক সময়ে একেক ধরণের এসেনশিয়াল তেল ব্যবহার করতে পারেন এই পদ্ধতি দীর্ঘসময় ধরে কার্যকরী করার জন্য।

৩. পুদিনা

পিপারমিন্ট এসেনশিয়াল অয়েলের পরিবর্তে শুধু পুদিনাপাতাও ব্যবহার করতে পারেন। পুদিনা প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কাজ করে। কিছু তাজা পুদিনাপাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে কাপড়ের পুঁটলিতে ভরে রান্নাঘরে ঝুলিয়ে রাখতে পারেন৷ অথবা পুদিনাপাতা না থাকলে মিন্ট টি ব্যাগও ব্যবহার করতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় যদি ঘরের আশেপাশেই পুদিনার গাছ লাগাতে পারেন।

৪. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল

ভিনেগারের মত ভিটামিন সি জাতীয় ফলের গন্ধ ও স্বাদ মাকড়শার চক্ষুশূল। আস্ত লেবু, মাল্টা, বা কমলালেবু টেবিলের উপর বা রান্নাঘরে রাখতে পারেন। তাহলে মাকড়শা ঘরে ঢোকার সাহস করতে পারবেনা। আবার টক ফলের খোসা ছাড়িয়ে চৌকাঠে, জানালার গরাদে, বইয়ের তাকে ঘষে দিতে পারেন। চাইলে লেবুর গন্ধযুক্ত গ্লাস কিনার বা ফার্নিচার পলিশ অথবা মোমবাতি ব্যবহার করতে পারেন।

ভিনেগার-পানির মিশ্রণে কমলালেবু বা মাল্টার খোসা সারারাত ভিজিয়ে রাখতে পারেন। ভিনেগারের গন্ধে আপনার অস্বস্তি থাকলে এই পদ্ধতিতে গন্ধের তীব্রতা কিছুটা কমবে কিন্তু ভিনেগার আর ভিটামিন সি-র ডাবল অ্যাকশনে মাকড়শার বারোটা বেজে যাবে নিশ্চিত। তার পাশাপাশি ঘরের কোণায় জমে থাকা ময়লাও পরিষ্কার হবে আর পোকামাকড়ের যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি পাবেন।

৫. দারচিনি

মাকড়শা তাড়াতে দারচিনি নানাভাবে ব্যবহার করতে পারেন। দারচিনির বড় বড় টুকরা পুঁটলি করে রেখে দিতে পারেন। আবার সিনামন অয়েল বা দারচিনির গন্ধযুক্ত মোমবাতি ঘরের ভিতর ও বাইরে জ্বালিয়ে রাখতে পারেন।

৬. রসুন

কথিত আছে, রসুনের গন্ধে ভুত, পিশাচ, রক্তখেকো দানব ইত্যাদি অশুভ শক্তি পালায়, এখন থেকে জানুন মাকড়শাও পালায়। রসুনের গন্ধ খুবই কড়া। আপনার যদি রসুনে কোনরকম অসুবিধা না থাকে, তাহলে রসুনের আস্ত ১০-১২টি কোয়া বা পর্যাপ্ত রসুন কুচি পানিভর্তি বোতলে ঢেলে স্প্রে করুন। ঘরের কোণা, মেঝে, জানালা, দরজা অর্থাৎ যেসব রাস্তা দিয়ে পোকামাকড় বা মাকড়শা আসতে পারে এবং বাসা বাঁধতে পারে সেখানে রসুনের টোটকা ব্যবহার করবেন।

৭. ইউক্যালিপটাস

ইউক্যালিপটাস গাছ ওষুধ হিসেবে শরীরের পাশাপাশি মাকড়শার প্রতিকার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এই গাছের পরিচর্যা করা খুব সহজ, এবং এর কড়া সুগন্ধ মাকড়শাকে জ্বালাতন করতেও ছাড়ে না। জানালার কাছে একটি ইউক্যালিপটাস গাছই যথেষ্ট। ইউক্যালিপটাস এসেনশিয়াল অয়েল সহজলভ্য থাকলে সেটাও ব্যবহার করতে পারেন।

৮. সিডার

সিডার নামক বিশেষ একধরণের গাছ আছে যার গন্ধ পোকামাকড় ও মাকড়শা সহ্য করতে পারেনা। এই গাছ অনেকটা দেবদারু গাছের মতো। সিডার গাছের ছাল-বাকল বা কাঠের গুঁড়া ঘরের ভিতরে বা বাইরে ছড়িয়ে রাখতে পারেন। আবার ছাল বা কাঠের গুঁড়া পুঁটলি করে আলমারি বা ড্রয়ারেও রেখে দিতে পারেন। এতে করে কাপড় কাটা পোকার উপদ্রব কম হবে। বাড়িতে সিডার গাছের উচ্ছিষ্ট ব্যবহারে বেশ একটা সুন্দর কাঠের গন্ধ তৈরি হবে। অবশ্য আপনার কাঠের গন্ধ ভালো না লাগলে ব্যবহার করার দরকার নেই।

৯. হর্স চেস্টনাট

হর্স চেস্টনাট নামে এক ধরণের লালচে বাদামি রঙের শক্ত বাদাম আছে যেটা মাকড়শাকে ঘরে প্রবেশ করতে দিবেনা। আপনি অনলাইনে কিনতে পাবেন এই বাদাম। কয়েকটি হর্স চেস্টনাট জানালার গরাদে বা ঘরের কোণায় ফেলে রাখুন। এই ধরণের বাদাম সহজে পচে না এবং অনেকক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকে। তাই একবার ব্যবহারে মাকড়শার উপদ্রব থেকে বেশ কিছুদিন রক্ষা পাওয়া যাবে।

১০. বিড়াল

মাকড়শার উপদ্রব কমানোর সবচাইতে সহজ ও মজার উপায় হচ্ছে বিড়াল পোষা। বিড়ালের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে ইঁদুর, তেলাপোকা, মাকড়শাসহ ক্ষতিকর প্রাণী শিকার করা। বাড়িতে পোকামাকড়ের উৎপাত বেড়ে গেলে দেরি না করে নিয়ে আসুন এই ঝানু শিকারীকে। এতে করে আপনার কীটনাশক কেনার পয়সাটা কিন্তু বেঁচে যাবে।

১১. ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার রাখুন

অপরিষ্কার বাড়ি পোকামাকড়, কীটপতঙ্গের পছন্দের জায়গা। তাই আপনার বাসস্থান নিয়মিত পরিষ্কার করুন। মাকড়শা অন্ধকার এবং নোংরা জায়গায় থাকতে ভালোবাসে। তাই ঘরে পর্যাপ্ত আলোবাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা রাখুন। দেয়ালে ঝুল জমতে দিবেন না এবং মেঝে সবসময় পরিষ্কার রাখবেন। যেসব জায়গায় জিনিসপত্র বহুদিন ধরে জড়ো করে রাখা আছে সেগুলো পরিষ্কার রাখবেন। বাড়িতে আলাদা স্টোরেজ রুম থাকলে সেদিকেও মনোযোগ দিবেন।

এমনকি ময়লা ফেলার ঝুড়ির দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। প্লাস্টিকের ঢাকনাওয়ালা ডাস্টবিন ব্যবহার করুন যাতে মাকড়শা ডাস্টবিনে ঢুকে লুকিয়ে থাকতে না পারে। ময়লার ঝুড়ি দরজা থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখবেন। ঘরে অপ্রয়োজনীয় কোন কাগজ, কাঠ, বা প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের স্তুপ থাকলে যতদ্রুত সম্ভব তা ফেলে দিন।

ফেলে দেয়া খাবার, মাছ-মাংস বা সবজির উচ্ছিষ্টে পোকামাকড় খুব তাড়াতাড়ি আকৃষ্ট হয়, সাথে মাকড়শাও। তাই এসব আবর্জনা পারলে দূরে কোথাও ফেলে আসবেন। অথবা আলাদা পলিথিনে ফেলে শক্ত করে গিঁট দিয়ে রাখবেন। চিমনি থাকলে চিমনির দেয়ালের ভিতরটা ভালোমত পরিষ্কার করবেন।

বাড়ির ভিতরের সাথে সাথে বাইরের চারপাশটাও পরিষ্কার রাখবেন। ঘাস, কাগজের টুকরা, কাঠের আবর্জনা, ঝরা পাতা থাকলে সেগুলো সরিয়ে ফেলুন। ঘরের বাইরে ময়লার স্তুপ পরিষ্কার রাখলে মাকড়শা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ বাড়িতে ঢুকতে পারবে না।

১২. বাড়িকে রাখুন সুরক্ষিত

বাড়ি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রাখলেই মাকড়শার প্রবেশ ঠেকানো সম্ভব। দরজা-জানালা কোথাও ভাঙা থাকলে সারিয়ে নিন। একইসাথে জানালা ঠিকমতো আটকানো যাচ্ছে কিনা তাও দেখুন। অনেকসময় দরজার নিচে একটু ফাঁকা থাকে, আপনার দরজা সেরকম থাকলে ফাঁকা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন। দেয়ালে, দরজায়, জানালায় ফাটল থাকলে পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ খুব সহজেই ঘরে ঢুকতে পারবে। তাই ফাটলের সমাধান করে ফেলবেন যাতে করে পোকামাকড়ও না ঢোকে আর ঘরের ভিতরটাও উষ্ণ থাকে।

১৩. খাবার ঢেকে রাখুন

নিজেদের খাবার, এমনকি পোষা প্রাণী থাকলে তার খাবারও ঢেকে রাখুন যাতে খাবারের গন্ধে মাছি, পোকার সাথে মাকড়শা ও ঘরে ঢুকে না পড়ে। অনেকে খাবার টেবিলে ফলের ঝুড়ি রাখেন। যদি আপনিও সেরকম করেন, তাহলে খেয়াল রাখবেন ঝুড়ির ফলগুলো অক্ষত আছে কিনা। ফলে আকৃষ্ট হয় এমন মাছি বা ‘ফ্রুট ফ্লাই’ মাকড়শার কাছে খুবই সুস্বাদু খাবার৷ ফলের গায়ে খাওয়া-খাওয়া ভাব দেখলেই বুঝে যাবেন বাড়িতে ফ্রুট ফ্লাই ঢুকে পড়েছে, ব্যস তার পিছন পিছন মাকড়শাও হাজির হয়ে যাবে।

১৪. বাতি নিভিয়ে রাখুন

কিছু কিছু কীটপতঙ্গ আছে যেগুলো আর্টিফিশিয়াল লাইটে বেশি আকৃষ্ট হয়। আপনার ঘরের বাতিতে এসব কীটপতঙ্গ আকৃষ্ট হয় এবং ঘরে প্রবেশ করে। আর মাকড়শা এই পোকাগুলোই বেশি খায়। তাই সবার আগে বাতি প্রয়োজন ছাড়া জ্বালানো বন্ধ করুন।

ঘরের ভিতরকার আলো জানালায় প্রতিফলিত হয়েও পোকামাকড়কে আকৃষ্ট করতে পারে। তাই প্রতিফলন ঠেকানোর জন্য জানালায় বিশেষ ধরণের কালো কাচ ব্যবহার করতে পারেন। অথবা পর্দা দিয়ে জানালা ঢেকে রাখুন। সোডিয়াম বাতি হচ্ছে এই জাতীয় পরিস্থিতির জন্য উত্তম সমাধান।

আফরোজ হেলাল

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 বছর ago