গাড়ির কাঁচটা খুলতেই মুখে এসে ঝাপটা মারল ধোঁয়া ধোঁয়া নীল কুয়াশা। গাড়ির ভিতর ম্রিদুস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে ওম মনি পদ্মে হুম, সামনে রাখা তথাগত শ্রী গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। সামনের বিশাল কাঁচটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ঘন কুয়াশায়। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে কার্সিয়াং এর ডাওহিল স্কুলের দিকে।
সকালের সুন্দর রোদটাকে কালো এক বিশাল মেঘ ঢেকে পাহাড়ের মুখকে গোমড়া করে দিয়েছে। যত গাড়ি এগোচ্ছে তত যেন কুয়াশার মেঘের দেশে প্রবেশ করছি মাকড়শার জালে বন্দী থাকা শিকারের মত। আরে কি মুশকিল চলার রাস্তায় একটাও গাড়ি চোখে পরেনি, দোকানপাট যা দেখলাম সব বন্ধ, সবে দুপুর ৩’টে বাজে এখনই যেন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে।
কার্সিয়াং রেল স্টেশন থেকে মেরেকেটে ৫ কিলোমিটার রাস্তা তবু এই ঘন কুয়াশায় গাড়ি আস্তে আস্তে চলছে। গাড়ির হেড লাইট জ্বালানো হয়েছে সামনে স্তব্ধ কুয়াশা। হঠাৎ যেন সামনে একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল কুয়াশা মাখা জঙ্গলে, এই নির্জন স্থানেকে এই ছায়ামূর্তি? পাশে বসা ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে অবাক, দেখি রক্তশূন্য সেই দাজুর মুখ। ভয়ার্ত গলায় বলল –”আপ প্যায়দাল চালে যাও স্যার , গাড়ি ওর নেহি জায়েগা”।
সামনের রাস্তাটা চলে গেছে ডাওহিল স্কুলের দিকে, এই সেই অদ্ভুত অলৌকিক রাস্তা। এই রাস্তাতেই দেখা মেলে মেঘ ছায়া মেশানো অশরীরী ছায়ামূর্তিদের। বহুবার পাহাড়ে গেছি, অনেক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি প্রতিবারই রোমাঞ্চিত হয়েছি। এবারও ডাওহিলের অলৌকিক টানে চলে এসেছি। ড্রাইভার দাজুকে ভাড়ার টাকা দিতে গেলে ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘সামকে প্যাহলে সিটি মে লট যানা স্যার’। আমাকে পুরো নিস্তব্ধ রাস্তায় ঘন পাইন, রডডেনড্রন জঙ্গলের মাঝে একা রেখে গাড়িটা আস্তে আস্তে পাহাড়ের বাঁকে মিলিয়ে গেল। এখন শুধু আমি, কুয়াশা , নীল মেঘ মাখা পাইনের জঙ্গল আর আলো আঁধারী মেশানো অলৌকিক রাস্তা।
ছোট পাহাড়ি শহর কার্সিয়াং’এর মধ্যে ডাওহিল খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেই অংশের মধ্যে ডাওহিল গার্লস স্কুল, যেটা আমার গন্তব্য। অসাধারণ তার গঠনশৈলী। এখন এই স্কুল হেরিটেজ সম্মানপ্রাপ্ত। ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ আমলে স্যার অ্যাশলি ইডেন এই স্কুল তৈরি করেন। প্রথমে এই স্কুলে শুধু ছেলেরা পড়ত। তারপর সেই ছেলেদের ভিক্টোরিয়া স্কুলে নিয়ে যাওয়া হলে মেয়েদের পড়া এখানে শুরু হয়।
টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিশাল বিশাল পাইনের জঙ্গলের মাঝে কালো পীচের রাস্তা আঁকা বাঁকা পথে উঠে গেছে উপরের পথে। মেঘগুলো নেমে এসেছে অনেক নীচে যেন স্পর্শ করতে চায় আমার শরীর। ঘন কুয়াশায় সামনে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। দুপাশের ফার্ন গাছগুলো কেমন যেন ফ্যাকাসে মেরে গেছে। এত নিস্তব্ধ চারপাশ যে, আমি পাইন গাছ থেকে ঝরে পড়া জলবিন্দুর শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
এক নিমেষের লহমায় মনে হল ডানদিকের পাইন গাছের জঙ্গলে একটা মানুষের মত অবয়ব ক্ষণিকের মধ্যে মিলিয়ে গেল কুয়াশায়। নিজের চারপাশে মনে হতে লাগলো কারোর একটা অদ্ভুত অশরীরী উপস্থিতি। মনে পড়তে লাগলো এই ডাওহিল স্কুল নিয়ে নানান চর্চিত কাহিনী। কেউ কেউ এখানে একজন বুড়ী নার্সকে দেখতে পায়। কেউ কেউ দেখেছে ছোট একটা বাচ্চা তার পা নেই সে ভেসে বেড়ায় জঙ্গলের মাঝে। শোনা যায় একটু দুরের পরিত্যাক্ত গির্জার ভীতর থেকে ভেসে আসে ছোট ছেলেমেয়েদের ক্যারল। যত এইসব ভাবছিলাম তত কেমন যেন একটা ভীতি আমার উপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করছিল।
“আপনি কি একা?”, চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি রংবাহারি ছাতা হাতে নীচ থেকে উঠে আসছে নেপালি এক সুন্দরী মেয়ে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । অবশেষে একজন মানুষের দেখা পেলাম, তাও আবার বেশ সুন্দরী পথের সাথী। আলাপে আলাপে জানলাম ওর নাম রিংচেন, দার্জিলিঙের কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করছে। এই সুন্দরী পাহাড়ি কন্যাও এখানে একা ঘুরতে এসেছে। আমি পাহাড় ভালোবাসি শুনে খুব খুশী। হেসে বলল “আমি বুঝতে পারছি আপনি পাহাড় ভালবাসেন আর তাই একা চলে এসেছেন এখানে। জানেন, একা যারা ঘুরে বেড়ায় তারা বিশ্বের সেরা দার্শনিক”I
কথার মাঝেই হঠাৎ সব মেঘ কুয়াশা কেটে রোদ উঠল, আমরা স্কুল এর ভিতর প্রবেশ করলাম। সত্যি খুব সুন্দর মনে করিয়ে দিচ্ছিল রোমের সেই প্রাচীন গির্জাদের গরিমার কথা। স্কুল ঘিরে রেখেছে চারপাশের সবুজ পাহাড় আর জঙ্গল। মনে মনে ঈর্ষা বোধ করলাম এই স্কুলের ছাত্রী আর শিক্ষকদের প্রতি।
” চলুন ডিয়ার পার্কে যাওয়া যাক। এখান থেকে হেঁটে অল্পখানি পথ। যদি আপনি আমার সাথে হাঁটতে বিরক্ত না হন!” রিংচেনের প্রশ্নে আমি হেসে বললাম, “আমি আপনার সাথে এই পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা খুবই উপভোগ করবো আশাকরি। আর হাঁটতে আমিও খুব পছন্দ করি”।
পাইনের পাতায়, ভিজে শ্যাওলা ধরা কাণ্ডে দুপুরের নরম পাহাড়ি রোদ এসে জড়িয়ে ধরেছে। নেতিয়ে যাওয়া ফার্নের দল যেন নতুন স্বপ্নের সন্ধান পেয়েছে সূর্যের আলোয়। মাথার উপর নীল আকাশ ,সিক্ত পাহাড়ি পথে হেঁটে চলেছি আমি আর রিংচেন। কিছুটা এগোতেই দেখি দুটো কাঠের জনশূন্য বাড়ি, পাহাড়ের গায়ে ফুটে আছে নাম না জানা অসংখ্য রঙ বেরঙের ফুল তার মধ্যে মাঝে মাঝে হয়ে আছে বুনো স্ট্রবেরি। সময় যেন কেমন থমকে গেছে। রোদ, পাইনের বন, নানান পাহাড়ি ফুল, হঠাৎ করে চলার সঙ্গী রিংচেন, ওর চ্যাপ্টা ঠোঁটের মিষ্টি হাসি, সব যেন সময়কে থমকে দিয়েছিল।
বেশ কিছুটা চলার পর একটা ছোট কাঠের বাড়ি এলো। রিংচেন মায়াবী চোখে জিজ্ঞাসা করল ” হোমাগ্নি কফি খাবেন?” আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম এই নির্জন বাড়িটায় তো কোন মানুষের চিহ্ন নেই, কফি আসবে কোথা থেকে? রিংচেন জানালো ওই বাড়িতে একটা বুড়ী থাকেন যাকে ও চেনে । ওর ওখান থেকে কফি আনতে চলে গেল রিংচেন আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম একটা পাথরের উপর বসে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেছে এদিকে রিংচেন এর কোন পাত্তা নেই। দুত্তোর বলে এগিয়ে গেলাম বাড়িটার দিকে। কিন্তু একি বাড়িটায় তো তালা দেওয়া, কোন লোকজন নেই। বেশ কয়েকবার চীৎকার করে রিংচেন এর নাম ধরে ডাকলাম। কোন সাড়া শব্দ নেই সারা পাহাড়টা যেন বোবা হয়ে গেছে। পিছনে গেছে নাকি? এদিকে তো আসেইনি, সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির পিছনে গেলাম। গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। যা দেখলাম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আওয়াজ করার শক্তিটুকুও নেই আর আমার।
বাড়ির পিছনে ২০০ ফুট গভীর খাদ। যেন সাক্ষাৎ গিলে খাবে! কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই দিক দিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাহলে রিংচেন কই গেল? রিংচেন কে?
হঠাৎ করে আবিস্কার করলাম পুরো পাহাড়ি জঙ্গল মুখ ঢেকেছে কুয়াশার ঘোমটায়। সন্ধ্যা নামবে ঝুপ করে। নিভে যাওয়া বিকেলের আলোয় আমি একা দাড়িয়ে সেই কাঠের বাড়িটার সামনে। এই শীতেও আমার সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে ঘামে। ভাবার অবকাশ নেই আমি ছুটতে শুরু করলাম সেই অলৌকিক রাস্তা ধরে শহরের দিকে। অন্ধকার নামতে আর বেশী বাকি নেই।
আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…
পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…
আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…
বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…
ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…
প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…